কুষ্টিয়া শহরের আশরাফুল উলুম মাদরাসার ছাত্র। ২৮ জানুয়ারি সাদা পেশাকে র্যাব পরিচয়ে ‘ঢাকা মেট্রো গ-১৩-৭২৬৭’ নম্বর মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যায়। চার মাস পার হলেও আবুজর গিফারীর কোনো সন্ধান মেলেনি।
শুধু মাদরাসা ছাত্র নয়, কুষ্টিয়ায় গুমের তালিকা থেকে বাদ যায়নি ক্ষমতাশীন দলের নেতা থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম পর্যন্ত। গত ১১ মাসে কুষ্টিয়ায় গুম হয়েছে কুমারগাড়া মসজিদের ইমাম এসএম রকিব, মাদরাসা ছাত্র আবুজর গিফারী, কোর্টপাড়া এলাকার সরোয়ার হোসেন, কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজ, কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামের জাফর ইকবাল ও সদর উপজেলার বালিয়াপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম।
জেলায় প্রতিনিয়ত গুমের তালিকা দীর্ঘ হওয়ায় সাধারণ মানুষজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। নিখোঁজ এসব ব্যক্তিদের শেষ পরিণতি কি হয়েছে সে সম্পর্কে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও সঠিক কোনো তথ্য নেই।
সর্বশেষ ১৫ জুন রাতে কুষ্টিয়া ডিবি পুলিশ এক বছর আগে নিখোঁজ হওয়া বিএনপি নেতা কুমারখালী উপজেলার গড়াই ইটভাটার মালিক মিরাজুল ইসলাম মিরাজের কংকাল উদ্ধার করে তারই ইটভাটার পার্শ্ববর্তী গড়াই নদীর চর থেকে। এই মামলায় গ্রেফতার হওয়া দুই আসামির আদালতে প্রদান করা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর ভিত্তিতে পুলিশ মাটি খুঁড়ে তার কংকাল উদ্ধার করে। ইউনিয়ন নির্বাচনে কুমারখালীর চাপড়া ইউনিয়নের সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন মিরাজ। নিখোঁজ মিরাজ কুমারখালীর চাপড়া ইউনিয়নের লাহিনীপাড়ার মৃত আব্দুল গণি শেখের ছেলে।
গত বছর ৪ জুন বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে মিরাজ নিখোঁজ হন। ওই দিন সর্বশেষ মিরাজ তার ব্যবসায়ের অংশীদার কোহিনুরের মোটরসাইকেলে লাহিনী বটতলা মোড়ে আসার পর নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় মিরাজের স্ত্রী শখি খাতুন গত ৫ জুন কুমারখালী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ডায়েরী নং-১৫৭।
চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল কুষ্টিয়া শহরতলীর কুমারগাড়া মসজিদের ইমাম এসএম রকিবকে সাদা পোশাকে র্যাব পরিচয় দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে যায়। মসজিদের মোয়াজ্জিন নুর ইসলাম সুজন জানান, রাত সাড়ে ১২টার দিকে সাদা পোশাকে কয়েকজন লোক নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে মসজিদের পাশে নিজ রুম থেকে এসএম রকিবকে তুলে নিয়ে যায়।
তিনি আরো বলেন, কালো রং এর একটি জিপ গাড়িসহ মোট ৪টি গাড়ি নিয়ে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন লোক রাস্তার দুই পাশ বন্ধ করে দিয়ে আমাদের মসজিদের চার পাশ ঘিরে ফেলে। এ সময় আমি এবং রকিব ভাই এক রুমে ঘুমিয়েছিলাম। পানি পড়া নেয়ার কথা বলে তারা আমাদের দরজা খুলতে বলে।
আমি দরজা খুলে দিলে প্রায় ১০-১২ জন লোক ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে আমার এবং রকিব ভাইয়ের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। তাদের মধ্যে একজনের হাতে ওয়ারলেস ফোন ও আরেকজনের হাতে ট্যাব ছিল।
মোয়াজ্জিন সুজন আরো জানান, ট্যাবের মধ্যে আমার এবং রকিব ভাইয়ের সিমের নম্বর তুলে চেক করার পর রকিবকে তুলে নিয়ে চলে যায়। রকিবের ভাই আবুল হাসান জানান, আমার ভাইকে গত ২৯ এপ্রিল কুমারগাড়া মসজিদ থেকে সাদা পোশাকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে আমার ভাইয়ের কোনো সন্ধান নেই। কুষ্টিয়া মডেল থানায় তিন দফা জিডি নিয়ে গেলেও পুলিশ তা গ্রহণ করেনি। পুলিশ বলেছে এ ব্যাপারে আমরা জিডি নিতে পারব না। রকিব ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার ভবানিপুর গ্রামের আমিরুল ইসলামের ছেলে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আলামপুর ইউনিয়নের বালিয়াপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম চলতি বছরের ৩ ফেব্র“য়ারি বেলা ১১টার দিকে মোটরসাইকেলযোগে নিজ বাড়ি থেকে কুষ্টিয়া শহরের উদ্দেশ্যে বের হন। পথিমধ্যে জিকে ক্যানেলের ব্রিজ থেকে ৪ জন লোক মোটরসাইকেলে রফিকুলকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন।
কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামের সামসুদ্দিনের ছেলে জাফর ইকবাল নিখোঁজ রয়েছে সাত মাস যাবত। জাফরের স্ত্রী ববি আক্তার জানান, গত বছর ৯ নভেম্বর রাত ১টার দিকে পুলিশের পোশাক পরিহিত ৫/৬ জন লোক ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। এ সময় তারা পুলিশ পরিচয় দিয়ে জাফরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।
যাওয়ার সময় কুমারখালী থানার এসআই রাজিব বলেন, সকাল বেলা থানায় আসেন। সকালে আমার ভাসুর শফি থানায় গেলে বলে বিকালে আসেন কথা হবে। বিকাল চারটায় গেলে বলে আমি ধরতে যাইনি।
এ ব্যাপারে এসআই রাজিব জানান, ওই দিন আমার কোনো ডিউটি ছিল না। তাই ধরার প্রশ্নই আসে না। গত বছরের ৫ অক্টোবর সাদা পোশাকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে নিজ বাড়ির সামনে থেকে কুষ্টিয়া শহরের নতুন কোর্টপাড়া এলাকার আব্দুল মান্নানের ছেলে সরোয়ার হোসেন সরোকে তুলে নিয়ে যায়। নিখোঁজের সাত মাস পার হলেও সরোর কোন সন্ধান মেলেনি।
নিখোঁজ সরোর স্ত্রী জিনিয়া আক্তার জানান, গত বছরের ৫ অক্টোবর রাত পৌনে ১১টার দিকে বাসার নিচে দোকানে বসে আমার স্বামী সিগারেট খাচ্ছিল। এ সময় কুষ্টিয়া মডেল থানার এসআই ওবাইদুল, তারেক আজিজ, সাহেব আলী ও মমিন আমার স্বামীকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
আমার স্বামী মা মা বলে চিৎকার করলে আমরা নিচে নেমে দেখি ওই চার কর্মকর্তা দুই মোটরসাইকেলে করে আমার স্বামীকে নিয়ে যাচ্ছে। পরে আমরা থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশ বলে আপনারা খোঁজ খবর করেন আপনার স্বামীকে পেয়ে যাবেন। গত সাত মাসে আমি প্রায় এক’শ বার থানায় গেছি কিন্তু পুলিশ আমাকে কোনো পাত্তা দেয়নি।
কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজ নিখোঁজ রয়েছে প্রায় ৯ মাস যাবত। গত বছরের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে যুবলীগ কর্মী সবুজ খুন হয় এবং ওই হত্যা মামলায় প্রধান আসামি করা হয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজকে। হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পর পরই তিনি আত্মগোপন করেন।
পরিবারের দাবি, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আক্তরুজ্জামান লাবু ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজকে র্যাব আটক করে। তবে র্যাব তাদের আটকের বিষয়টি এখন পর্যন্ত অস্বীকার করে আসছে।
ওই ঘটনার পর গত বছরের ২৬ আগস্ট স্বেচ্ছাসেবকলীগ সভাপতি লাবু কুষ্টিয়ায় ফিরে আসলেও সবজু ফিরে আসেনি। সবুজের সন্ধান চেয়ে তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া আদালতে পিটিশন দাখিল করে। ওই পিটিশনের বিষয়ে আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করেছে। সে প্রতিবেদনে পুলিশ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, সবুজ ও লাবুকে তারা আটক বা গ্রেফতার করেনি। সবুজের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া জানান, ক্রমেই বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা বাড়ছে। কেউ কোনো দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। এদিকে ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের মেধাবী দুই ছাত্র ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা আল মোকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহ এবং ২০১০ সালের ২ এপ্রিল কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাচিত কাউন্সিলর আল্লেক মাহমুদ অপহৃত হওয়ার কয়েক বছর পার হলেও এখনো তাদের কোনাে হদিস মেলেনি।
এছাড়াও শহরের ডিশ ব্যবসায়ী টাক আলমকে কয়েক বছর আগে সাদা পোশাকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে আমলমের কোনো সন্ধান নেই। অপহরণের পর তাদের উদ্ধার কিংবা অপহৃতদের ভাগ্যে কি ঘটেছে পুলিশের কাছে ওই সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এদের উদ্ধার করতে পারেনি। এদের হত্যার পর মরদেহ গুম করা হয়েছে বলে ওই সকল পরিবারের অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম জানান, সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া এসব ব্যক্তিদের বিষয়ে পুলিশের কাছে তেমন কোএা তথ্য নেই। তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে অবশ্যই আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.