ইলেকট্রুনিক ক্যাশ রেজিস্টার মেশিন (ইসিআর) ব্যবহার না করে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে ৮ হাজার প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুসন্ধানে এসব প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা হয়। ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকাসহ একটি প্রতিবেদন অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এনবিআরের মতে, এসব প্রতিষ্ঠানে ইসিআর মেশিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও ভ্যাট ফাঁকি দিতে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব রোধে এনবিআর থেকে ইসিআর মেশিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরবরাহ করা হবে। সম্প্রতি এনবিআর থেকে মাঠ পর্যায়ের ভ্যাট কমিশনারেটে চিঠি পাঠিয়ে ইসিআর মেশিন ব্যবহার উপযোগী প্রতিষ্ঠানের তথ্য চাওয়া হয়। ১১টি ভ্যাট কমিশনারেটের তথ্যমতে, সারা দেশে মাত্র ৮ হাজার ৭টি ইসিআর ব্যবহারযোগ্য প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেয়েছেন কর্মকর্তারা। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠান ইসিআর মেশিন ব্যবহারযোগ্য হলেও তা না করে কৌশলে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইসিআর ব্যবহার উপযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেটের আওতায় ৪ হাজার ২৮৩টি। এরপরের অবস্থানে রয়েছে ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট। সেখানে ১ হাজার ৭৯১টি ইসিআর মেশিন ব্যবহার উপযোগী প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা পূর্বে ১২১টি, পশ্চিমে ৫৮১টি, চট্টগ্রাম কমিশনারেটে ২৪৬টি, কুমিল্লা কমিশনারেটে ৪৯টি, যশোর কমিশনারেটে ১৮৩টি, রাজশাহী কমিশনারেটে ১১৯টি, খুুলনা কমিশনারেটে ৩৭৪টি, সিলেট কমিশনারেটে ২৩৯টি ও সবচেয়ে কম ২১টি ইসিআর ব্যবহার উপযোগী প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে পেরেছে রংপুর ভ্যাট কমিশনারেট। সূত্রমতে, এ তথ্য জানার পর সেবার খাতের ভ্যাট ফাঁকি রোধে অর্থমন্ত্রী তৎক্ষণাৎ ১০ হাজার ইসিআর মেশিন কিনতে এনবিআরকে নির্দেশ দিয়েছেন। ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের মাধ্যমে ইসিআর মেশিন আমদানি করা হবে। পরে ক্রয়মূল্যে এগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরবরাহ করা হবে ব্যবহারের জন্য। একইসঙ্গে ইসিআর মেশিন ব্যবহার বাড়াতে এনবিআরকে অনুশাসন জারির নির্দেশ দিয়েছেন। প্রসঙ্গত, সেবা ও ব্যবসা খাতে ইসিআর মেশিন বাধ্যতামূলক করে ২০০৮ সালের ১৫ এপ্রিল একটি সাধারণ আদেশ জারি করে এনবিআর। এ আদেশের মাধ্যমে হোটেল, রেস্তোরাঁ, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, আসবাবপত্রের বিক্রয় কেন্দ্র, বিউটি পার্লার, কমিউনিটি সেন্টার, মেট্রোপলিটন এলাকার অভিজাত শপিংমল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, জেনারেল স্টোর, স্বর্ণ ও রুপার দোকান এবং বড় ও মাঝারি (পাইকারি ও খুচরা) দোকানে ইসিআর মেশিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এনবিআরের বর্তমান ও সাবেক কয়েক কর্মকর্তা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে দেশব্যাপী ইসিআর মেশিন ব্যবহার উপযোগী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। শুধু ঢাকার অলিগলি বাদে প্রধান সড়কে অবস্থিত রেস্তোরাঁ রয়েছে ২০ হাজারের উপরে। বড় বিভাগীয় শহরগুলোতে একই চিত্র পাওয়া যাবে। এনবিআরের ভ্যাট কমিশনারেট থেকে যে তথ্য পাঠানো হয়েছে তা মাঠ পর্যায় থেকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই পাঠানো হয়েছে বলে মনে করেন তারা। এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, এ সংখ্যা সঠিক বলে প্রতীয়মান হয় না। যেসব মানদণ্ডের ভিত্তিতে ইসিআর ব্যবহার উপযোগী প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে সেটি পুনর্যাচাই করে দেখা উচিত। অন্যদিকে সম্প্রতি বড়-মাঝারি সেবা প্রদানকারী ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ইসিআর মেশিন স্থাপনের বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর রাজনৈতিক নির্দেশনা চেয়ে সার-সংক্ষেপ পাঠায় এনবিআর। এতে বলা হয়েছে, ইসিআর মেশিনের মূল্য ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। মাঠ পর্যায়ের চিহ্নিত ৮ হাজার ৭টি প্রতিষ্ঠানের জন্য মেশিন আমদানিতে খরচ হবে ১৬ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকা। এ অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেলে এনবিআর নিজ উদ্যোগে মেশিন আমদানি করবে। পরে ক্রয়মূল্যেই সেটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করবে। বিক্রীত অর্থ পুনঃঅর্থায়নের মাধ্যমে পরবর্তীতে ব্যবহার করা হবে। এ কাজ ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের মাধ্যমে করা যাবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী ১০ হাজার ইসিআর মেশিন আমদানির অনুমোদন দেন। এসব মেশিন শুল্ক-করমুক্তভাবে আমদানি করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ও এগুলো যারা বর্তমানে ভ্যাট দিচ্ছে তাদের কাছে ক্রয়মূল্যেই বিক্রয়ের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ইসিআর ব্যবহারে পৃথক অনুশাসন জারির নির্দেশ দেন। চলতি বছরের বাজেট বক্তৃতায় এর আভাস দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘জেলা শহরের বাইরে অবস্থিত বড় রিসোর্ট, হোটেল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ইসিআর/পিওএস সংক্রান্ত আদেশ সংশোধনের প্রস্তাব করছি। কী উপায়ে এ যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, সে বিষয়ে ভাবনা হচ্ছে যে এই যন্ত্রটিকে সরকার সংগ্রহ করে ক্রয়মূল্যেই সরবরাহ করবে।’ এ পরিপ্রেক্ষিতে ২ জুন এনবিআর থেকে ইসিআর ব্যবহার সংক্রান্ত সাধারণ আদেশটি সংশোধন করা হয়। এর মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন ও জেলা শহরের ভেতরে অথবা বাইরে অবস্থিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ইসিআর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। আগে সিটি কর্পোরেশন ও জেলা শহরের ভেতরে অবস্থিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ইসিআর ব্যবহার বাধ্যতামূলক ছিল। এ বিষয়ে আবদুল মজিদ বলেন, ইসিআর মেশিন ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে ভ্যাট আদায় বাড়বে। এটি ভ্যাট কর্মকর্তা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উভয়ের জন্য উপকারী। তবে যে সব মেশিন বর্তমানে রয়েছে সেগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটা মনিটরিং করা উচিত। ইসিআর মেশিন বসিয়ে ব্যবহার না করলে কোনো লাভ হবে না। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানের ইসিআর মেশিন ব্যবহার করার সক্ষমতা রয়েছে। এনবিআর থেকে যদি বিনামূল্যে ব্যবসায়ীদের ইসিআর মেশিন দেয় তাহলে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.