একসময় জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। বিগত ১০ বছরে এ চিত্রটা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন পড়ছেন বাংলাদেশের প্রায় পনেরো শ শিক্ষার্থী। প্রযুক্তি ও প্রকৌশল-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি শেষ করে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, এমন তরুণের সংখ্যাও প্রায় দুই শ। অনেকেই সিমেন্স, বিএমডব্লিউ, ইনটেল, ইনোবেজ, ডাইমলার বা মার্সিডিজ বেঞ্জসহ বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করছেন। জার্মানিতে তাঁরা উজ্জ্বল করছেন বাংলাদেশের মুখ। ‘স্বপ্ন নিয়ে’র পাঠকদের সঙ্গে এমনই কিছু মানুষের পরিচয় করিয়ে দেব। নারায়ণগঞ্জের ছেলে মোহাম্মদ আবু ফাহিম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে তড়িৎকৌশলে স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তর করেছেন জার্মানির উলম বিশ্ববিদ্যালয়ে, কমিউনিকেশন টেকনোলজি বিষয়ে। ফুজিয়টসু, ইনফিনিয়নসহ ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউটে গবেষণার কাজ করেছেন তিনি। ২০১২ সাল থেকে মিউনিখ শহরের বিখ্যাত মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইনটেলে ওয়্যারলেস আইপি সাব সিস্টেম বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকার মাহফুজা সুলতানা ও রেজা সালেহ দুজনই আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। জার্মানির ডার্মসডাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। মাহফুজা এখানকার বিখ্যাত গবেষণাকেন্দ্র ফাউনহোফার ইনস্টিটিউটের গবেষক ছিলেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি সিমেন্সের সেন্সর ও কমিউনিকেশন সফটওয়্যার ডেভেলপার বিভাগে দলনেতা হিসেবে কাজ করছেন। একই প্রতিষ্ঠানের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন সিস্টেম বিভাগের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন রেজা সালেহ। মাহফুজা বলছিলেন, ‘জার্মানিতে নারীর নিরাপত্তা আর সম-অধিকারের বিষয়টি খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমার মতে. বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য এখানে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার ভালো পরিবেশ আছে।’ উচ্চশিক্ষার সুযোগ থাকলেও, কয়েক বছর আগেও জার্মানিতে কাজের তেমন সুযোগ ছিল না। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের অভাব পূরণ করতে জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডার ২০০০ সালে আমেরিকা ও কানাডার মতো ‘সবুজ কার্ড’ চালু করার প্রস্তাব করেছিলেন। পরে তাঁর উত্তরসূরি চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেল বাইরের দেশের নাগরিকদের চাকরিবিষয়ক আইনকানুন শিথিল করেন। ২০০৮ সাল থেকে প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের চাকরির সুবিধার্থে ‘নীল কার্ড’ কার্যক্রম চালু হয়। ‘প্রযুক্তিভিত্তিক কাজে জার্মান ভাষার ব্যবহার কম। কিন্তু দৈনন্দিন কাজের জন্য এ দেশের ভাষাটা জানতেই হয়।’ বললেন ইনোব্রেজের ‘ম্যাটেরিয়ালস ডেভেলপমেন্ট’ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী, রাজশাহীর ছেলে শেখ মিনহাজ উদ্দিন। বুয়েটে ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করে তিনি অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন জার্মানির উলম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন এ বিশ্ববিদ্যালয়েই পিএইচডি গবেষণার কাজ করছেন। জার্মান ভাষা শেখার গুরুত্বের কথা অবশ্য মোহাম্মদ আবু ফাহিমও বলছিলেন। সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে জার্মানিতে নিজের একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন বাংলাদেশের অনেকেই। তাঁদের একজন সোহরাব হোসেন। বাড়ি চাঁদপুরে। ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ থেকে স্নাতক শেষ করে সফটওয়্যার টেকনোলজি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন স্টুটগার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সোনা, রুপা বা প্লাটিনামের মতো মূল্যবান ধাতু পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলে যে প্রতিষ্ঠান হেনসেল গ্রুপ, সেখানে সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন তিনি। এ দেশের বিখ্যাত মোটরগাড়ির কোম্পানিগুলোতেও আছেন লাল-সবুজের প্রতিনিধি। বুয়েটের দুই সাবেক ছাত্র—কাজী খালেদ আল জাহিদ ও রেজওয়ানুল কবীর। দুজন কাজ করছেন যথাক্রমে বিএমডব্লিউ (ব্যাভেরিয়া মোটর ওয়ার্কস) ও মার্সিডিজ বেঞ্জে (ডাইমলার)। কাজী খালেদ দায়িত্ব পালন করছেন রিসার্চ অ্যান্ড অটোমোটিভ ডেভেলপমেন্ট বিভাগে। রেজওয়ানুল মার্সিডিজ বেঞ্জের আইটি আর্কিটেক্ট। বাংলাদেশের এই ছেলেমেয়েরা জার্মানির মতো শিল্পোন্নত দেশে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা দেখিয়েই জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যাশা—শুধু জার্মানি নয়, সারা বিশ্বেই একদিন আধিপত্য বিস্তার করবেন বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.