ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে আর সেই সঙ্গে বিস্মিতও হতে হচ্ছে, স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে কী কাণ্ডটাই না ঘটানো হয়েছে! মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার একটি অন্যতম ভিত্তি লাল মুক্তিবার্তা। অথচ ১৯৭২ সালে কোলাবরেটর (দালাল) স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে যার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, তিনিও একজন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন, তার নাম রয়েছে লাল মুক্তিবার্তায়ও। অবশ্য তথ্য-প্রমাণ যাচাইয়ের পর সরকারি গেজেট ও সনদ বাতিল এবং লাল মুক্তিবার্তা থেকে তার নাম বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেছেন, লাল মুক্তিবার্তা থেকে সব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু প্রশ্ন, এই তলিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত? দ্বিতীয় প্রশ্ন, এতদিন ধরে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নামসংবলিত এই তালিকাটিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হল কীভাবে? স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ৫টি তালিকা করা হয়েছে। ৭১ হাজার নাম সংবলিত প্রথম তালিকাটি করেছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ, যা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে সংরক্ষিত রয়েছে। এরপর বিভিন্ন সরকারের আমলে যখনই তালিকা হয়েছে, তখনই দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ১৯৯৮ সালে জেলা ও উপজেলা কমান্ডারদের নেতৃত্বে গঠিত যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে তৈরি করা তালিকাটিই লাল মুক্তিবার্তার তালিকা। এতে রয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম। এরপর চারদলীয় জোট ও মহাজোট সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দু’দফা আরও বেড়েছে। বর্তমানে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৯ হাজার ৫০০। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ও পুনঃতালিকা প্রণয়নের সময় যে নানা রকম চাতুরি ও কারচুপি হয়েছে, তার প্রমাণ আমরা অতীতে অনেকবার পেয়েছি। ইতিমধ্যেই ২৫০ সরকারি কর্মকর্তাসহ ২ হাজার ৬১৯ ব্যক্তির মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করা হয়েছে। সরকারি শীর্ষস্থানীয় পদগুলোর কর্মকর্তারাও ভুয়া সনদের মাধ্যমে চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন বলে প্রমাণ মিলেছে।
গতকাল যুগান্তরের শীর্ষ খবরে লাল মুক্তিবার্তায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকার খবরটির পাশাপাশি তৃতীয় পাতায় ছাপা হয়েছে কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ ব্যুরো অফিস থেকে পাঠানো দুটি হৃদয়বিদারক খবর। প্রথম খবরটিতে দেখা যাচ্ছে, ৭০ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা চাঁন মিয়া এখন ভিক্ষা করছেন আর দ্বিতীয় খবরে মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রশীদ চালাচ্ছেন রিকশা। প্রথমজন পাননি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি, দ্বিতীয়জন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকলেও পাচ্ছেন না ভাতা।
মানে কী দাঁড়াচ্ছে? কিছু লোক মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও পাচ্ছেন সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সামাজিক মর্যাদা আর অনেকেই সত্যি সত্যি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিতই হচ্ছেন না শুধু, পাচ্ছেন না মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদাও।
অবাক কাণ্ডই বটে। এক মহান যুদ্ধ অথচ নেই সেই যুদ্ধের বীরদের একটি নির্ভুল পূর্ণাঙ্গ তালিকা। নেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদেরও নির্ভুল তালিকা, এমনকি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকাও। এই যুগান্তরেই খবর বেরিয়েছে মাত্র ৬১টি পরিবার শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবার হিসেবে সরকারি অনুষ্ঠানগুলোয় আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন। অথচ শহীদ হয়েছেন আরও অনেক বুদ্ধিজীবী। আমরা চাইব, লাল মুক্তিবার্তা, সরকারি গেজেট- সব তালিকা থেকেই ভুয়াদের অপসারণ করে প্রকৃতদের নাম প্রতিস্থাপন করা হবে। একইসঙ্গে ভুয়া নাম অন্তর্ভুক্তকরণ প্রক্রিয়ায় যারা জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে যথাযথ ব্যবস্থা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.