গায়ত্রী রমাপ্রসাদকে ২৬ বছর বয়সে ভুত তাড়ানোর অজুহাতে যৌন নিপীড়ন করেছিল এক ওঁঝা। কারণ তিনি অবসাদ ও উদ্বেগজনিত মানসিক বিশৃঙ্খলায় আক্রান্ত ছিলেন। গায়ত্রী বলেন, আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ধর্মীয়ভাবে চরম রক্ষণশীল এবং কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের বিশ্বাস ছিল যারা মানসিক রোগে আক্রান্ত হন তাদের ওপর ভুতে আছর করে। ফলে তারা ওঁঝা ডেকে আমার ভুত তাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ওঁঝা ভুত তাড়ানোর নাম করে তার ওপর যৌন নিপীড়ন চালান। গায়ত্রী বলেন, “আমি বিষয়টি কাউকে বলতে পারিনি। কারণ ওঁঝা হলেন গিয়ে ঈশ্বরের লোক। আর তাছাড়া আমি বললেও বিষয়টি কেউ বিশ্বাস করবেন না। আমার মাও আমাকে ওঁঝার চিকিৎসা চলাকালে কারো সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছেন।” ২২ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার এক বছর পর গায়ত্রী তার স্বামীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগনে চলে যান। কিন্তু অবসাদ ও উদ্বেগজনিত মানসিক বিশৃঙ্খলার কারণে পরের বছরই তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ১৮ বছর বয়সে গায়ত্রী সামাজিক উদ্বেগজনিত মানসিক বিশৃঙ্খলায় আক্রান্ত হলে তার প্যানিক অ্যাটাক হয়। গায়ত্রী বলেন, আমি বুঝতে পারছিলাম আমার ভয়াবহ কোনো সমস্যা হয়েছে। কিন্তু তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিলাম না। ওঁঝার হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর গায়ত্রী বুঝতে পারেন তিনি পাগল নন বরং মানসিকভাবে অসুস্থ। তিনি বলেন, আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম যে, আমি শয়তান না, অলস না, আমার ওপর ভুত চাপেনি। বরং আমি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছি। নিজেকে আমার শিক্ষিত করে গড়ে তোলা এবং নিজের ক্ষমতায়ন করার দরকার। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরও গায়ত্রী এবং তার স্বামী তার মানসিক রোগের বিষয়টি গোপন রাখেন। “আমেরিকান স্বপ্নের” স্বাভাবিকতা বজায় রাখার জন্যই বিষয়টি গোপন রাখতে হয় বলে কটাক্ষ করেন গায়ত্রী। গায়ত্রীর বয়স এখন ৫৬। স্বামীর সঙ্গে ঘর করছেন ৩৩ বছর ধরে। প্রথমে তার স্বামীও তার সমস্যাটি বুঝতে পারেন নি বলে জানান গায়ত্রী। তবে মানসিক স্বাস্থ্য ইস্যুতে পড়াশোনা করার পর তার স্বামী তার প্রতি অনেক যত্নবান হয়ে ওঠেন বলে জানান গায়ত্রী। মানসিক রোগ থেকে মুক্তিতে রোগীদের প্রচুর পরিমাণ সহমর্মিতা ও যত্ন এবং ভালোবাসা ও সহযোগিতার দরকার হয়। ওঁঝার হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার দু্ই বছর পর গ্রায়ত্রীকে পোর্টল্যান্ডের একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গায়ত্রী প্রথমে ঘাবড়ে যান। কিন্তু পরে তিন দেখতে পান যে সেখানকার মানুষেরাই বরং তার প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন। তথাকথিত সুস্থ্য-স্বাভাবিক মানুষদের চেয়ে বরং মানসিক রোগীরাই তার সমস্যাটি হৃদয়ঙ্গম করছেন সহজে। গায়ত্রী বলেন, “মানসিকভাবে অসুস্থ বা ওই পাগলদের কাছে আমি যে ভালোবাসা ও আদর-যত্ন পেয়েছি স্বাভাবিক দুনিয়ার মানুষদের কাছে তার কিছুই পাইনি।” সেখানে গায়ত্রীর একবার গর্ভপাতের ঘটনাও ঘটে। কিন্তু নার্সদের সহযোগিতায় তিনি সে বিপর্যয়ও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। গায়ত্রী বলেন, সেখানকারা নার্সরা আমাকে আমার নিজের ভেতরকার শক্তি আবিষ্কারে সহায়তা করেন। সেখানকার সামষ্টিক চেষ্টার ফলেই আমি পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হই। এবং আমার নিজের ও আমার মতো অন্যদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে শামিল হই। গায়ত্রী বলেন, “ওষুধ খেয়ে আমার কেনো উপকার হয়নি। ওষুধে রোগ নিরাময় না হয়ে বরং রোগের লক্ষণগুলো বারবার ফিরে আসে। ওষুধ বরং আমাকে আরো বেশি উদ্বিগ্ন, অবসাদগ্রস্ত এবং দূর্বল করে তোলে। এতে আমি আরো বেশি নিদ্রাহীন হয়ে পড়ি। ফলে দীর্ঘদিন ওষুধ সেবনের পর আমি ভিন্ন কোনো উপায়ে নিজেকে সুস্থ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এই পদ্ধতিটির নাম কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি বা জ্ঞানীয় আচরণগত চিকিৎসা। গায়ত্রী বলেন, ঈশ্বরপ্রেরিত এক চিকিৎসক আমাকে আমাদের চিন্তার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা সম্পর্কে শিক্ষা দেন। চিন্তা কীকরে আমাদের অনুভূতি এবং আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে সে বিষয়টি তিনি আমাকে বুঝিয়ে বলেন। গায়ত্রী বলেন এ থেকে আমি বুঝতে শিখি যে, কোনো পরিস্থিতিতে কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হবে তা নির্ধারণের ক্ষমতা আমাদের নিজেদের মধ্যেই রয়েছে। তিনি তুরীয় ধ্যান, যোগ ব্যায়াম এবং প্রাণয়মার চর্চাও করেন। গায়ত্রী বলেন, “নির্মম পরিহাসটি হলো আমার নিজ দেশ ভারতে এসবের জন্ম হয়েছে। অথচ আমাকে এসব শিখতে হচ্ছে আমেরিকান শিক্ষকদের কাছে। এসবের চর্চা করে আমার জীবনটা আমূল বদলে গেছে।” নিজে সুস্থ্য হওয়ার পর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গায়ত্রী আশা ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মানসিক অবসাদ এবং সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত লোকদেরকে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি অবিরাম পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মানসিক সমস্যায় আক্রান্তদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, শুধু নিজের ভেতরের শক্তিটুকু উপলব্ধি করুন তাহলেই আপনি মানসিক রোগ থেকে মুক্তির এবং পুনরায় জীবন সংগ্রামে নামার পথটি পেয়ে যাবেন।”
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.