খাদিজার ওপর হামলা
সিলেটে কলেজছাত্রী খাদিজার ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার চার্জশিট প্রস্তুত করেছে পুলিশ। আজকালের মধ্যে আদালতে পুলিশ চার্জশিট দাখিল করবে। চার্জশিটে আসামি করা হয়েছে হামলাকারী শাবি ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলমকে। ইতিমধ্যে পুলিশের হাতে খাদিজার মেডিকেল রিপোর্ট এসে পুলিশের হাতে পৌঁছেছে। মেডিকেল রিপোর্ট প্রাপ্তির পর পুলিশ তদন্ত রিপোর্ট চূড়ান্ত করেছে। এদিকে, কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিস আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ। ধীরে ধীরে আশঙ্কামুক্ত হচ্ছেন খাদিজা। খুলে ফেলা হয় তার সব সাপোর্টও। দেয়া হচ্ছে তরল খাবার। দু-একদিনের মধ্যে খাদিজাকে কেবিনে দেয়া যেতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন চিকিৎসকরা। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজা আক্তার। বাড়ি সিলেট শহরতলীর টুকেরবাজারের আউশা গ্রামে। পিতা মাসুক মিয়া সৌদি আরব প্রবাসী। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান খাদিজা গত ৩রা অক্টোবর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ এমসি কলেজে পরীক্ষা দিতে যায়। ওই দিন বিকাল ৫টার একটু পরে চাপাতি দিয়ে হামলা চালায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলম। বদরুল আলম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি ছাতক উপজেলায়। ঘটনার পরপরই স্থানীয় লোকজন ধাওয়া করে বদরুলকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে। আর গুরুতর আহত অবস্থায় খাদিজাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু খাদিজার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় রাতেই তাকে পাঠানো হয় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে। অস্ত্রোপচারের পর আইসিইউতে ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে রাখা হয় খাদিজাকে। ৭২ ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা খাদিজার শারীরিক অবস্থার উন্নতির আশা প্রকাশ করেন। ওদিকে, খাদিজার ওপর হামলার ঘটনার দুদিন পর সিলেটের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বদরুল আলম। জবানবন্দিতে সে জানিয়েছে, প্রেমে সাড়া না দেয়ায় সে খাদিজাকে কুপিয়েছে। ঘটনার দিন দুপুরেও সে ক্যাম্পাসে গিয়েছিল। ওই সময় সে খাদিজার হাতে পানির বোতল তুলে দিতে চাইলে খাদিজা পানির বোতল নেয়নি। এ কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে সে ক্যাম্পাস থেকে ফিরে আসে। এরপর নগরীর আম্বরখানা থেকে আড়াইশ টাকা দিয়ে চাপাতি কিনে ক্যাম্পাসে যায়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পুকুর পাড়ে সে খাদিজাকে কুপিয়েছে। খাদিজার ওপর নির্মমতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায় ঘটনাকালীন সময়ের ভিডিও ফুটেজ ও ছবি। মোবাইল ফোনে ধারণ করা ওই ভিডিও ছবি দেখে গোটা দেশেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। রাজন হত্যার পর সিলেটে খাদিজার ওপর হামলার ঘটনায় আন্দোলন শুরু হয়। সিলেট সরকারী মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা টানা তিনদিনের আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে। কিন্তু কর্মসূচির শেষ দিনে আন্দোলনকারী কয়েকজন ছাত্রীকে হুমকি প্রদান করা হয়। এই হুমকির ঘটনার পর ছাত্রীদের মধ্য আতঙ্ক দেখা দেয়। এ কারণে ১৭ই অক্টোবর পর্যন্ত তারা আলটিমেটাম দিয়ে আন্দোলন শেষ করলেও পরবর্তীকালে খাদিজার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় তারা আন্দোলন থেকে সরে আসেন। পাশাপাশি বদরুলের দ্রুত বিচারের আশ্বাস সরকার থেকে প্রদান করায় সিলেটেও আন্দোলনের মাত্রা কমে আসে। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের এক শিক্ষক জানিয়েছেন, যেহেতু শিক্ষার্থীদের দাবি মানার আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে সে কারণে শিক্ষার্থীরা আর আন্দোলনে নামেননি। শিক্ষকরা বিষয়টি শিক্ষার্থীদের বুঝিয়েছেন। এদিকে, ঘটনার দিনই সিলেটের শাহপরান থানা পুলিশ এমসি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে রক্তমাখা চাপাতি উদ্ধার করে। আর বদরুল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করে। সিলেট মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই তদন্তের মনিটরিং করেন। তদন্তকালে ঘটনার সময় যারা ক্যাম্পাসে ছিল, যারা খাদিজাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে এবং যারা বদরুলকে আটক করে পুলিশে সোর্পদ করেছে, তাদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ঘটনাকালীন সময়ে ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ ও ছবি সংগ্রহ করেছে পুলিশ। এসব ভিডিও ফুটেজ ও ছবি পর্যালোচনা করা হয়েছে। সিলেটের শাহপরান থানার এসি সাজ্জাদুল আলম গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, খাদিজার ওপর হামলার ঘটনার চার্জশিট তারা প্রস্তুত করেছেন। আজকালের মধ্যে চার্জশিট আদালতে প্রদান করা হবে। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। ন্যায়বিচার যাতে নিশ্চিত হয় সে ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ত্রুটি রাখা হয়নি। তিনি জানান, তদন্তকালেই খাদিজার মেডিকেল রিপোর্ট শাহপরান থানা পুলিশের হাতে এসে পৌঁছে। মেডিকেল রিপোর্টও পর্যালোচনা করা হয়েছে বলে জানান তিনি। ওদিকে, খাদিজার ওপর হামলার ঘটনার পরপরই সৌদি আরব থেকে দেশে ছুটে আসেন তার পিতা মাসুক মিয়া। আর চীন থেকে দেশে আসেন খাদিজার মেডিকেল পড়ুয়া ভাই শাহীন আহমদ। গত চার দিন থেকে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন মাসুক মিয়া। গতকাল তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন, খাদিজা এখন অনেকখানি সুস্থ। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সময় গেলে খাদিজা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। সরকার খাদিজার চিকিৎসার সব ব্যয়ভাব বহন করছে। আর চিকিৎসকরা আশার বাণী শুনিয়েছেন। এ কারণে তারা এই মুহূর্তে খাদিজাকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন না বলে জানান মাসুক মিয়া। তিনি বলেন, খাদিজার জ্ঞান ফিরেছে। সে মাঝে মাঝে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ওই সময় কাউকে চিনতে পারে না। তবে, বেশিরভাগ সময়ই সে সবাইকে চিনেছে। কথা বলতে পারছে না। মাঝে মধ্যে মাকে ডাকছে। তিনি ধারণা করেন, খাদিজা তার শরীরে ব্যথা অনুভব করছে। তার শরীরের বাম পাশটা এখনও কাজ করছে না। তবে, চিকিৎসরা মাসুক মিয়াকে জানিয়েছেন, তারা ব্যথা দিয়ে দেখেছেন বা অংশও রেসপন্স করছে। গতকাল হাসপাতালে খাদিজাকে হুইল চেয়ারে বসানো হয়েছে। এ সময় তাকে তরল খাবার খাওয়ানো হয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.