আগামী নভেম্বরে জোরেশোরে মাঠে নামার পরিকল্পনা করছে বিএনপি। মূলত নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুকে কেন্দ্র করেই রাজপথে নামতে চায় দলটি। এ ইস্যুতে জনমত তৈরিতে নভেম্বর-ডিসেম্বরজুড়ে বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করবেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর জানুয়ারিতে ঢাকায় মহাসমাবেশ করার চিন্তা রয়েছে দলটির হাইকমান্ডের। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা জানান, নতুন করে রাজপথে নামার মহড়া হিসেবে ৮ থেকে ১২ নভেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আন্দোলন কর্মসূচির নতুন রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। হিলারি ক্লিনটন জয়ী হলে কর্মসূচির মেজাজ ভিন্ন রকম হতে পারে। তবে গোপন এ পরিকল্পনার বিষয়ে দলটির কোনো নীতিনির্ধারক পরিচয় প্রকাশ করে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এদিকে বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা শনিবার যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ব্যাপক লোকসমাগমের পর তারাও একই স্থানে পাল্টা শোডাউন করতে চান। যাতে সারা দেশের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হন। বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে এ ধরনের একটি সমাবেশ আয়োজনের কথা তারা ভাবছেন। আর এ সমাবেশটি হবে জোরেশোরে রাজপথে নামার আগাম সংকেত। কিন্তু রাজপথে আন্দোলনের নামে বিএনপি কোনোভাবে সহিংস হবে না। তৃতীয় কোনো পক্ষ নাশকতা করে যাতে দলটির ওপর দায় চাপাতে না পারে সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন তারা।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ইসি পুনর্গঠনের দাবি শুধু বিএনপির একার নয়। সব রাজনৈতিক দল এ দাবিতে সোচ্চার। তাই আশা করব, সরকার সবার মতামত নিয়ে ইসি পুনর্গঠন করবে। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোও বাংলাদেশে একটি স্বাধীন কমিশনের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে দ্রুত একটি জাতীয় নির্বাচন দেখতে চায়।
তিনি বলেন, সরকার যদি সবার মতামত ছাড়া একতরফাভাবে ইসি পুনর্গঠন করে তবে তা কেউ মানবে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। আর বিএনপি আন্দোলনের মধ্যেই আছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘ইসি পুনর্গঠনসহ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে দ্রুতই আমরা রাজপথে নামব। এ লক্ষ্যে আমরা সারা দেশে জনমত সৃষ্টি করব। সবার মতামতের ওপর ভিত্তি করে ইসি পুনর্গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে। আবারও একই দাবি জানানো হবে। এরপরও সরকার যদি তাতে সাড়া না দেয় তবে বিএনপির পক্ষ থেকে একটি রূপরেখা দেয়া হতে পারে। কীভাবে গঠন করলে ইসি আরও গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ হবে তা ওই রূপরেখায় থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার এরপরও যদি আমাদের দাবি না মানে তবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের পরবর্তী কর্মসূচি দেয়া হবে। তবে সে কর্মসূচি হবে অবশ্যই অহিংস।’
এদিকে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে দলের পক্ষ থেকে সহসা একটি রূপরেখা দেয়া হবে। সরকার এতে কর্ণপাত না করলে জনগণকে সঙ্গ নিয়ে রাজপথে নামা হবে। আর এ আন্দোলনকে রূপ দেয়া হবে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদায়ের চূড়ান্ত আন্দোলন হিসেবে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এবার আন্দোলনের নতুন কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন জয়লাভ করলে আন্দোলনের কৌশল হবে ভিন্ন মেজাজের। যেহেতু নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের সঙ্গে হিলারি ক্লিনটন পরিবারের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক রয়েছে এবং হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার দেখতে চায় সেহেতু বিএনপির নীতিনির্ধারক মহল মনে করছে, হিলারি জয়ী হলে এ বিষয়ে ইতিবাচক প্রেক্ষাপট তৈরি হতে পারে।
তাই হিলারি ক্লিনটন জয়লাভ করলে দ্রুত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির নেতাকর্মীরা জোরালোভাবে সোচ্চার হবেন। অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারের ওপর দেশীয় সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক নানা চাপ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হবে। তারা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পর এ দেশের রাজনীতিতেও নতুন মেরুকরণ হতে পারে।
বিএনপির নেতারা বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে বৈঠককালে ধারণা দিয়েছেন- হিলারি ক্ষমতায় এলে এ দেশের গণতন্ত্রের জন্য শুভ বার্তা অপেক্ষা করছে। বিভিন্ন বিষয়ে ইঙ্গিত করে কেরি সংগঠন শক্তিশালী করার পাশাপাশি বিএনপিকে জনমত সৃষ্টিতে কাজ করার আহ্বান জানান। এ ছাড়া কোনো ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে দলটির হাইকমান্ডকে পরামর্শ দেন প্রভাবশালী দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার এমন বার্তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েই পরবর্তী কৌশল প্রণয়ন করছে বিএনপির হাইকমান্ড। দল পুনর্গঠনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে নেয়া হয়েছে নানা কৌশল।
সূত্র জানায়, আপাতত ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচির পাশাপাশি তৃণমূলকে শক্তিশালী করার দিকেই নজর দলটির হাইকমান্ডের। দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে পরিকল্পিতভাবে মাঠে নামতে চান তারা। ইতিমধ্যে জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে মহিলা দলের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি ঘোষণার অপেক্ষায়। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব জেলায় সম্মেলন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক জেলার সম্মেলনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়েছে। কেন্দ্রের পাশাপাশি তৃণমূলেও তরুণ নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখতে চায় দলটি। বিশেষ করে নব্বইয়ের সাবেক ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
সূত্র জানায়, সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সরকারবিরোধী জনমত সৃষ্টির ওপর জোর দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। মধ্য নভেম্বর থেকে বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করার পক্ষে দলের বড় একটি অংশ মতামত দিয়েছে। দলের চেয়ারপারসনও এতে মৌন সম্মতি জানিয়েছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিভাগীয় শহরে কয়েকটি সমাবেশ করবে দলটি। এসব সমাবেশে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুকেই প্রাধান্য দেয়া হবে। একই সঙ্গে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ও জনগণের কাছে তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি ইসি পুনর্গঠন ইস্যুতে বিএনপির দাবির সঙ্গে সহমত রয়েছে এমন দলগুলোকে কাছে পেতে চায় দলটির হাইকমান্ড। এ ইস্যুতে যুগপৎ আন্দোলন তৈরি করতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করা হয়েছে।
নীতিনির্ধারকদের মতে, দেশের পাশাপাশি সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের চাপও বাড়াতে চান তারা। কারণ, প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দেশের দাবি- সবার মতামতের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে হবে। এবং সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায় তারা। প্রভাবশালী দেশের এমন চাওয়াকে কীভাবে আরও কার্যকরী করা যায় সে পরিকল্পনাও তাদের আছে। ওইসব দেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে আগামী মাসে দলের একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। কূটনৈতিক উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা এ লক্ষ্যে কাজ করছেন। পাশাপাশি লন্ডনে অবস্থানরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও নানা মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
দলের অপর একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি জন কেরির ঢাকা সফরকালে দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত করেন তারেক রহমান। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত তার এক উপদেষ্টার মাধ্যমে এ লবিং করা হয়। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা অব্যাহত আছে। স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের দাবিতে দেশটির সমর্থন পাবে বলে প্রত্যাশা তাদের। কারণ, ভারতের নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। নানা কারণে তারাও এখন বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়। ইসি পুনর্গঠন নিয়ে আগামী ২০ ডিসেম্বর ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বৈঠকের দিকেও নজর রাখছে বিএনপি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.