গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর বাড়তি চাপে পড়েছে পুলিশ। ভিআইপিদের নিরাপত্তা, হাউস গার্ড ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা বাড়াতে হয়েছে। পাশাপাশি চেক পোস্ট ও টহলে রাত-দিন ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। এতে আসামি গ্রেফতার, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক দ্রব্য উদ্ধার, মামলার তদন্তসহ পুলিশের রুটিন কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।
গুলশান হামলার পর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সংসদ সদস্য (এমপি) ও ভিআইপিরা পুলিশের কাছে গানম্যান চেয়েছেন। বাড়তি পুলিশ মোতায়েনের অনুরোধ জানিয়ে প্রতিনিয়ত চিঠি আসছে পুলিশের কাছে।
এসব কারণে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বর্তমানে পুলিশের কাজের চাপ বেড়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসানোসহ ৯ দফা পরামর্শ দেয়া হয়। এর মধ্যে স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ পথে আর্চওয়ে বসানো, মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে দেহ তল্লাশি, গাড়ি তল্লাশির জন্য ভেহিকেল সার্চ মিররের ব্যবস্থা করা, লাগেজ স্ক্যান করা অন্যতম। প্রতিষ্ঠানে আগতদের নাম রেজিস্ট্রারে ফোন নম্বর ও ঠিকানা লিখে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি একেএম শহীদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি পুলিশকে রুটিন কাজও করতে হচ্ছে। পুলিশের প্রত্যেকটি সদস্য দিন-রাত পরিশ্রম করছেন। এতে তাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। মেট্রোপলিটন এলাকা, জেলা বা থানায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার জন্য স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে পুলিশ চাওয়া হচ্ছে। এই চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট ইউনিটের প্রধানরা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরিস্থিতি ও ঝুঁকি বিবেচনা করে চাহিদা অনুযায়ী পুলিশ মোতায়েন করছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যে জনবল আছে তাই দিয়েই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা হচ্ছে। রাজধানীতে বাড়তি চাহিদার জন্য ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় জনবল আনা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে রকম কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।’ সংকট মোকাবেলায় নতুন জনবল নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি পুলিশে জনবল বেড়েছে। জনবল নিয়োগ পুলিশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। নতুন ৫০ হাজার জনবল নিয়োগের অংশ হিসেবে আরও ২০ হাজার পুলিশ নেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।’
রাজধানীর রমনা থানা পুলিশের এসআই ও এএসআই ৭০, আর কনস্টেবল ৩৫ জন। পুলিশের পাশাপাশি থানায় কাজ করছেন ৮০ জন আনসার সদস্য। চেকপোস্ট, টহল ডিউটিতে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে প্রায় আশি শতাংশ পুলিশ সদস্যকে। এছাড়া গির্জা, মন্দির, বিভিন্ন স্কুল ও শপিং মলের নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক পুলিশ মোতায়েন রাখতে হচ্ছে। ভিআইপি অধ্যুষিত এলাকাতেও পুলিশকে অতিরিক্ত টহল দিতে হচ্ছে। সবই করতে হয় এই স্বল্পসংখ্যক পুলিশ দিয়ে। এতে মামলার তদন্ত, আসামি গ্রেফতারে অভিযানসহ দৈনন্দিন রুটিন কাজে ব্যাঘাত ঘটছে।
এই পরিস্থিতিতে কোনো সংকট তৈরি হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে থানার ওসি মশিউর রহমান বলেন, ‘সংকট নেই। তবে আমাদের সব সদস্য বাড়তি কাজ করছেন। কিছু ক্ষেত্রে থানার জনবলকে টানা ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে।
একই থানার এক এসআই বলেন, একটি হত্যাসহ ৯টি মামলার তদন্তের ভার তাকে দেয়া হয়েছে। এসব মামলার তদন্তে ঢাকার বাইরেও যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু গুলশান হামলার পর টহল, তল্লাশি এবং নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় মামলাগুলোর তদন্ত পিছিয়ে যাচ্ছে।
থানা পুলিশই নয় রিজার্ভ পুলিশকেও বাড়তি ডিউটি করতে হচ্ছে। রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে রমনা পার্কের কাছে ডিউটি করছেন কনস্টেবল মহসিন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় ডিউটি শুরু করে শুক্রবার সকাল ৯টায় শেষ করেছেন। টানা ১৪ ঘণ্টা ডিউটি শেষে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ফিরছিলেন তিনি।
এ সময় যুগান্তর প্রতিনিধিকে বলেন, ‘ব্যারাকে ফিরে কিছু সময় ঘুমাবেন। আবার বিকাল হলেই ডিউটিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেবেন। এভাবেই প্রতিদিন কমপক্ষে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করছেন তিনিসহ তার সহকর্মী পুলিশ সদস্যরা। অতিরিক্ত ডিউটির জন্য বাড়তি কোনো ভাতার ব্যবস্থাও (ওভারটাইম) নেই তাদের। বাতিল করা হয়েছে সব ধরনের ছুটিও।
১৩ জুলাই বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনারের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেয়া হয়। এতে বলা হয়, ‘হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী আক্রমণের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন স্থাপনা, প্রতিষ্ঠানের মালিক তাদের প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নিরাপত্তার জন্য ক্রমাগতভাবে অধিক হারে পুলিশ নিয়োগের জন্য চাহিদা দিচ্ছেন। কিন্তু ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার আইনশৃংখলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় পেট্রোলিং, চেকপোস্ট, ব্লকরেইড, তল্লাশি অভিযানের পাশাপাশি দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
বিভিন্ন দূতাবাস, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যালয়, আবাসিক এলাকা, আন্তর্জাতিক সংস্থার স্থানীয় কার্যালয়সহ ঢাকায় বসবাসকারী বিভিন্ন কমিউনিটির সদস্যদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা গ্রহণ করা হয়েছে। ভিভিআইপি, ভিআইপি ও বিচারপতিদের হাউস গার্ড প্রদান, ক্লোজড প্রটেকশন বৃদ্ধি করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থাপনার নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ফোর্সের স্বল্পতায় স্থায়ীভাবে পুলিশ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ সংকট কাটাতে পুলিশের গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসানোসহ ৯ দফা পরামর্শ দেয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, বর্তমানে চাহিদার তুলনায় পুলিশে স্বল্পতা আছে; তবে সংকট নেই। দূতাবাস, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নিরাপত্তার জন্য স্থায়ীভাবে পুলিশ চাইছে।’ বাড়তি চাপের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘পুলিশের কনস্টেবল থেকে আইজি পর্যন্ত সবাই চাপে আছেন। এসবের পাশাপাশি পুলিশের রুটিন কাজগুলো সময়মতো করার চেষ্টা চলছে।’
গুলশান হামলার প্রেক্ষাপটে বাড়তি চাপে পড়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রোটেকশন ও প্রটোকল বিভাগে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও স্থাপনার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে এই বিভাগ। তাদের কাছে বাড়তি জনবল চাওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে নতুন করে এমপিদের জন্য গানম্যান দেয়ার জন্যও সংসদে আলোচনা হয়েছে। ফলে এই বিভাগে জনবলের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রোটেকশন অ্যান্ড প্রোটোকল বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহিম খান যুগান্তরকে বলেন, এ শাখায় প্রায় ৩ হাজার জনবল কাজ করে। অধিক ডিউটির কারণে তাদের ওপর চাপ বেড়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনবল বাড়াতে গেলে সেটা হুট করেই সম্ভব নয়। কারণ জনবল বাড়াতে হলে ডিএমপির কাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হবে।’ এমপিদের জন্য গানম্যান দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি সংসদে আলোচনা হয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাইনি। পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পহেলা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা হয়। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন প্রাণ হারান। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতের কাছে জঙ্গি হামলায় এক গৃহবধূসহ দুই পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়। আলাদা দুটি ঘটনায় সাত জঙ্গি মারা গেছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.