‘পরিকল্পনাকারী ও অর্থের যোগানদাতা নুর হোসেন’
নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সেভেন মার্ডারের মামলার প্রধান ৪ আসামিকে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়েছে। অভিযোগ শোনানোর পর তাদের কাছ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। গতকাল সকালে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে গ্রেপ্তার ২৩ আসামির উপস্থিতিতে প্রধান ৪ আসামি নূর হোসেন, র্যাব-১১’র সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব) তারেক সাঈদ মুহাম্মদ, মেজর (অব) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব) মাসুদ রানাকে দণ্ডবিধি ৩৪২ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ পড়ে শোনান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন। ৪ আসামির মধ্যে নূর হোসেন ও তারেক সাঈদ মুহাম্মদ নিজেদের নির্দোষ দাবি করে আত্মপক্ষ সমর্থনে কোন সাফাই সাক্ষী বা লিখিত বক্তব্য না দিয়ে বিচারকের কাছে ন্যায় ও সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন। অপর ২ আসামি আরিফ হোসেন ও মাসুদ রানা নিজেদের নির্দোষ দাবির পাশাপাশি নিজেদের পক্ষে সাফাই হিসেবে আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য বিচারকের কাছে উপস্থাপন করেন। বাকি আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আগামী ৩১শে অক্টোবর পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে। সকাল সোয়া ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত আদালতের কার্যক্রম চলে। গতকাল সকাল সোয়া ১০টায় আসামিদের উপস্থিতিতে প্রথমে মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে তার বিরুদ্ধে অন্যান্য আসামির জবানবন্দি ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে উত্থাপিত অভিযোগ পড়ে শোনান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন। মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ৭ জনকে হত্যার পরিকল্পনাকারী ও অর্থের যোগানদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অর্থের বিনিময়ে র্যাবকে ব্যবহার করে তার চির শত্রু কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ ৫ জনকে অপহরণের পর হত্যা করায় বলে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিয়মান হয়েছে। সেই সময় ঘটনার প্রতিবাদকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার সরকারকেও অপহরণের পর হত্যা করা হয়। নূর হোসেনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৩৬৪/৩০২/২০১/১০৯/১২০(খ)/৩৪ অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানানো হয়। তবে অভিযোগ পড়ে শোনানোর সময় কাঠগড়ায় নূর হোসেন ছিলেন নির্লিপ্ত, তার ঠোঁটের কোণে ছিল স্মিত হাসি। ২ মামলায় অভিযোগ পড়ে শোনানোর পর আইন অনুযায়ী নূর হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়- অভিযোগের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি? উত্তরে নূর হোসেন বলেন, আমি নির্দোষ। এরপর প্রশ্ন করা হয় আপনি সাফাই সাক্ষী দিবেন কি না? নূর হোসেন না সূচক উত্তর দেন। এরপর তার কাছে আবারও জানতে চাওয়া হয়- এর বাইরে আর কিছু বলবেন কিনা? উত্তরে নূর হোসেন বলেন, আমি বিচারকের কাছে ন্যায় বিচার চাই। এরপর একইভাবে মামলার অন্যতম আসামি র্যাব-১১’র সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মুহাম্মদকে তার বিরুদ্ধে ২ মামলায় উত্থাপিত অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। তারেক সাঈদকে পরিকল্পনাকারী, হুকুমদাতা হিসেবে আখ্যায়িত করে অর্থের বিনিময়ে ৭ জনকে খুনের অভিযোগ আনা হয়। তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি-৩৬২/৩০২/২০১/১০৯/১২০(খ)/৩৪ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানানো হয়। অভিযোগ পড়ে শোনানোর পর তার কাছে জানতে চাওয়া হয়- এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কি? উত্তরে তারেক সাঈদ বলেন আমি নির্দোষ। আপনার সমর্থনে আপনি সাফাই সাক্ষী দিবেন কিনা? তারেক সাঈদ না সূচক উত্তর দেন। সর্বশেষ তার আর কিছু বলার আছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। ওই সময় তারেক সাঈদ বলেন, আমি আদালতের কাছে সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার চাই। অভিযোগে যেসব জবানবন্দির কথা বলা হচ্ছে তা সত্য ও স্বপ্রণোদিত নয়। তারপর মেজর (অব) আরিফ হোসেনকে তার বিরুদ্ধে ২ মামলায় উত্থাপিত অভিযোগ পড়ে শোনান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। অভিযোগে আরিফ হোসেনের বিরুদ্ধে ৭ জনকে অপহরণ, হত্যা ও লাশ গুমের অভিযোগ আনা হয়। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে অর্থের বিনিময়ে নজরুলসহ ৫ জন ও ঘটনার প্রতিবাদকারী আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুমের জন্য ইটের বস্তা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি-৩৬৪/৩০২/২০১/১১৪/১২০(খ)/৩৪ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। এরপর তার কাছে এ ব্যাপারে তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে আরিফ বলেন, আমি নির্দোষ। সাফাই সাক্ষী দিবেন কিনা জানতে চাইলে না সূচক উত্তর দেন আরিফ। এরপর আরও কিছু বলার আছে কিনা জানতে চাইলে আরিফ হোসেন আইনজীবীর মাধ্যমে এ ব্যাপারে লিখিত বিবৃতি বিচারকের কাছে উপস্থাপন করেন। ওই সময় বিচারক বলেন, এ বিবৃতি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় দেবেন। তখন আরিফের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ ভূঁইয়া বলেন, ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সময়ই আসামি তার পক্ষে যা বলার বা যা উপস্থাপনের সেসব বিষয় উপস্থাপন করবেন। এরপর বিচারক আরিফের লিখিত বিবৃতি গ্রহণ করেন। সর্বশেষ লে. কমান্ডার (অব) মাসুদ রানাকে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। তার বিরুদ্ধে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে অর্থের বিনিময়ে অন্যান্য র্যাব কর্মকর্তা ও সদস্যদের সহযোগিতায় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি-৩৬২/৩০২/২০১/১২০ (খ)/৩৪ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানানো হয়। এরপর এ ব্যাপারে তার বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে মাসুদ রানা নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তিনি কোন সাফাই সাক্ষী দিবেন কিনা জানতে চাওয়া হয়। উত্তরে তিনি বলেন, তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত বিবৃতি দেবেন। এর বাইরে তিনি আর কিছু বলবেন কিনা জানতে চাওয়া হলে, তিনি আবারো লিখিত বিবৃতি দেয়া কথা বলেন এবং আইনজীবীর মাধ্যমে তার লিখিত বক্তব্য বিচারকের কাছে পেশ করেন। তবে মাসুদ রানার আইনজীবীরা তার লিখিত বক্তব্যর কপি সাংবাদিকদের কাছে দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। নারায়ণগঞ্জ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, গতকাল প্রধান ৪ আসামিকে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। এরপর তাদের ৩টি করে প্রশ্ন করা হয়। তারা সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। বাকি আসামিদের আগামী ৩১শে অক্টোবর তাদের বিরুদ্ধে উত্খাপিত অভিযোগ পড়ে শোনানো হবে। তাদেরও ৩টি করে প্রশ্ন করা হবে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নাসিকের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ তার ৫ সহযোগীকে অপহরণ করা হয়। একই সময় একই স্থান থেকে অপর একটি গাড়িতে থাকা নারায়ণগঞ্জ আদালতের প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট চজন্দন কুমার সরকারকে নজরুলের সহযোগি ভেবে তাকে ও তার গাড়ির চালককেও অপহরণ করা হয়। ঘটনার ৩ দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর উপজেলা শান্তির চর এলাকার তীর থেকে হাত-পা বাধা অবস্থায় তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি এবং নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ের জামাতা বাদী হয়ে একই থানায় অপর একটি মামলা দায়ের করেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.