রাজনীতিতে ওবায়দুল কাদেরের উত্থান হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তিনি এখানে এসেছেন। ছাত্রনেতা থেকে আজ তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। যে অর্জনকে তিনি নিজে বর্ণনা করেছেন তার জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হিসেবে। সেই ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি। ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন আর ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে ছিলেন সক্রিয় সেনানী। মহান মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনের এক হিরণ্ময় অধ্যায়। ছিলেন মুজিববাহিনীর কোম্পানিগঞ্জ এলাকার কমান্ডার। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর পরিস্থিতির পটপরিবর্তন হলে কারাগারে ঠাঁই হয় ওবায়দুল কাদেরের। কারাগার থেকেই নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ নেতা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঠাঁই পান মন্ত্রিসভায়। জরুরি জমানায় কঠিন সময় অতিক্রম করতে হয়েছে তাকে। যে সময় থেকে শিক্ষা নেয়ার কথা বলেছেন বারবার। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালের ৫ই ডিসেম্বর যোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান ওবায়দুল কাদের। যোগাযোগ মন্ত্রী হওয়ার পর অবিরাম হেঁটেছেন তিনি। পথে পথে শুনেছেন জনগণের কথা। চেষ্টা করেছেন জনগণের দুর্ভোগ লাগবের। যে চেষ্টায় সফলতা-ব্যর্থতা দুটোই তার সঙ্গী। কখনও হয়েছেন প্রশংসিত। কখনওবা সমালোচিত। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করলে ফের মন্ত্রিসভায় স্থান মিলে ওবায়দুল কাদেরের। চেষ্টা অবশ্য তার থামেনি। এক সময় ছিলেন সাংবাদিক। লেখালেখি তার নেশা। তবে ওবায়দুল কাদেরের জীবনের সবচেয়ে বড় দিনটি ২৩শে অক্টোবর, ২০১৬, রোববার। যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার নাম প্রস্তাব করেন দলটির বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বিপুল সমর্থন আর করতালির মধ্য দিয়ে ঘোষিত হয় এক রাজনীতিবিদের জীবনের সর্বোচ্চ সম্মাননা। প্রথমদিন গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। তবে গতকাল যখন আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলনে এলেন তখন দেখা মেলে উচ্ছ্বসিত, সাবধানী, নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আর স্বপ্নবাজ এক রাজনীতিবিদের। নিজের সাধারণ সম্পাদক হওয়াকে তিনি মনে করেন পরিশ্রমের পুরস্কার। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। পশ্চিমা দুনিয়ার রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের একটি ব্যবধান ধরা পড়ে সমালোচনা সহ্য করার ব্যাপারে। সাধারণত আমাদের রাজনীতিবিদেরা সমালোচকদের প্রতি নিষ্ঠুর হন। কিন্তু প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই ওবায়দুল কাদের ইঙ্গিত দিলেন ভিন্নকিছুর। পত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় গত কিছুদিনে তার বিরুদ্ধেও কিছু আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সেই সমালোচকদের সমালোচনায় মুখর হননি তিনি। বরং উল্টো বলেছেন, সমালোচনা সহ্য করা উচিত। যে সইতে পারে সে শুদ্ধ হয়। সমালোচনা নেতাদের শুদ্ধ করে। নিজের সাংবাদিকতা আর লেখালেখির প্রসঙ্গ টেনে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো ধরনের আঞ্চলিকতাকে প্রশ্রয় দিবেন না। তিনি সারা দেশের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, কোনো অঞ্চলের নয়। বেশ কয়েকবারই স্মরণ করে দিয়েছেন তা। তার ভাষায়, আমি কোনো অঞ্চলের নই। আমি সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন, তেঁতুলিয়া থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত গোটা বাংলাদেশের সুবিশাল দায়িত্ব পেয়েছি। এখানে ব্যক্তির ঊর্ধ্বে পার্টি, পার্টির ঊর্ধ্বে দেশ। আমি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে চাই। তিনি বলেন, আমি নিজেকে মন্ত্রী ভাবি না। জনগণের সেবক ভাবি। সেভাবেই সামনে কাজ করে যেতে চাই। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদেরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তার সংযম। প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা সম্পর্কে তিনি কোনো কটু কথা বলেননি। সমালোচনায় বিদ্ধ করেননি কাউকে। বিএনপি’র অভিনন্দনের জবাবে দলটিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা আরো গভীরভাবে তাদের শুভেচ্ছা জানাতে পারতাম যদি তারা সম্মেলনে অংশ নিতেন। কারণ আমাদের নেতারা দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিলেন। তারা কথা দিয়েছিলেন। কথা রাখেননি। দলের সদ্য বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রশংসায় সরব ছিলেন ওবায়দুল কাদের। বলেছেন, দল পরিচালনায় তার পরামর্শ নিবেন। আর নিজের কর্মক্ষেত্রও নির্ধারণ করেছেন আওয়ামী লীগের নতুন সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার রাজনীতির কথা বলেছেন তিনি। বলেছেন, দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করার কথা। কর্মীদের আচার-আচরণে সংযমী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বহু অর্জন কীভাবে খারাপ আচরণের জন্য বিলীন হয়ে যেতে পারে সে ব্যাপারে উচ্চারণ করেছেন সতর্কবার্তা। বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারে পথচলা শুরু হয়েছে ওবায়দুল কাদেরের। যে চেয়ারটি অত্যন্ত ভারী। বাংলাদেশের ইতিহাসের সব উজ্জ্বল রাজনীতিবিদেরা বসেছেন এ চেয়ারে। মন্ত্রী হিসেবে হাল-জমানায় ওবায়দুল কাদের পরিচিতি পেয়েছেন ফাটাকেস্ট হিসেবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার পথচলা কেমন হয় সেদিকেই এখন সবার দৃষ্টি। তবে শুরুতেই প্রত্যাশার বেলুন ওড়ালেন তিনি। বাড়ালেন আশা। বদলা নয়, বদলের সুর শোনা গেছে এক রাজনীতিবিদের কণ্ঠে। পরিশ্রম যাকে নিয়ে গেছে শিখরে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.