বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুর নাম মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন। মার্কিনিরা তো বটেই, বলতে গেলে সারা বিশ্বই নজর রাখছে এই নির্বাচনে। এই নির্বাচনের দুই প্রার্থী ডেমোক্রেট দলের হিলারি ক্লিনটন আর রিপাবলিকান দলের ডনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে চলছে লড়াই। তাদের এই লড়াইকে কেমনভাবে দেখছে বাকি বিশ্ব? প্রভাবশালী বৃটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের ১৫টি দেশের প্রতিনিধিরা খোঁজ করেছেন তারই। তারা তুলে ধরেছেন সেসব দেশে হিলারি বা ট্রাম্পকে নিয়ে ভাবনাগুলো এবং সার্বিকভাবে মার্কিন নির্বাচনকে কীভাবে দেখা হচ্ছে। ১৫টি দেশের মধ্যে আজকের লেখায় তুলে ধরা হলো পাঁচটি দেশের কথা। বাকি দেশগুলোর কথা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হবে। গার্ডিয়ান অবলম্বনে লিখেছেন তরিকুর রহমান সজীব রাশিয়া এবারের মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়া অপ্রত্যাশিতভাবে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে। যদিও ডেমোক্রেটদের সার্ভার হ্যাকিংয়ের ক্রেমলিনের সংশ্লিষ্টতা বা উইকিলিকসের ফাঁস করা নথির বিষয়গুলো হয়তো কখনই জানা যাবে না। এটা স্পষ্ট যে মস্কো এই সমস্যাগুলো তৈরি হওয়ায় খুশি। হিলারি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তখন থেকেই তাকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করে আসছেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। অন্যদিকে রাশিয়া যেসব প্রার্থী বা নেতাকে অন্যান্য পশ্চিমা দেশে সমর্থন করে আসছে, ডনাল্ড ট্রাম্প ঠিক তেমনই একজন ‘গোলমেলে প্রার্থী’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রকৃত অর্থে ‘উপকারী নির্বোধ’ নন, বরং ক্রেমলিনের একজন ভাঁড়- এমনটি বিশ্বাস করার জন্য ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিকল্প নেই। তবে রাশিয়াতেও অনেকেই মনে করেন, হিলারি ক্ষমতায় এলে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যতটা সাংঘর্ষিক হবে, ট্রাম্প এলে তার চেয়ে হয়তো বেশিই হবে। হিলারির অধীনে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুব একটা সুখকর হবে না। বরং দুই দেশের মধ্যে সম্ভবত দীর্ঘদিনকার চর্চিত পারস্পরিক আস্থাহীনতা আর সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে সহায়তার সীমাবদ্ধতাই বজায় থাকবে। মার্কিন রাজনীতিকে রাশিয়াতে দেখা হয় ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের বিবেচনায়। এখানে ব্যক্তিত্বের হিসাবটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর সে কারণেই বেশির ভাগ রাশিয়ান মনে করেন, নির্বাচনে যিনিই জয়ী হোন না কেন, দুই দেশের সম্পর্কে পরিবর্তন খুব অল্পই আসবে। তা সত্ত্বেও পুতিনকে নিয়ে ট্রাম্পের প্রশংসাসূচক কথাবার্তা এবং রাশিয়ার টিভি চ্যানেলগুলোতে রিপাবলিকান এই প্রার্থী সম্পর্কে খানিকটা ইতিবাচক প্রচারণার বিষয়টি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। গ্রীষ্মজুড়ে চালানো এক জনমত জরিপে দেখা যায়, ২২ শতাংশ রাশিয়ানের মনোভাব ট্রাম্পের প্রতি ইতিবাচক, হিলারির পক্ষে তা ৮ শতাংশ। মেক্সিকো ট্রাম্পের উত্থান অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় মেক্সিকোকে অনেক বেশি অস্বস্তিতে ফেলেছে এবং দেশটিকে ক্ষুব্ধ করেছে। তার নির্বাচনী প্রচারণার শুরুটাই হয়েছে মেক্সিকান শরণার্থীদের ধর্ষক ও ডাকাত বলে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মেক্সিকো সীমান্তে তুলবেন দেয়াল। তার খরচও আবার নেয়া হবে মেক্সিকোর কাছ থেকেই। মেক্সিকো সীমান্তের ওই দেয়াল, নাফটা চুক্তিকে না মানা, মেক্সিকায় উৎপন্ন পণ্যে বিশেষ শুল্ক আরোপের মতো বিষয়গুলো মেক্সিকোর ব্যবসায়িক মহলকেও অস্বস্তিতে ফেলেছে, যদিও তারা গত ২৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ওপর আস্থা রেখেই আসছিলেন। মেক্সিকানরা ট্রাম্পকে নিয়ে বিদ্রূপ করেছেন। তার কুশপুত্তলিকাও দাহ করেছেন। তবে ট্রাম্প বরং মেক্সিকোর প্রেসিডেন্টকে নিজ দেশের জনগণের কাছে ঘৃণিত করে তুলেছেন। আগস্ট মাসে এক ঝটিকা সফরে ট্রাম্প বৈঠক করেন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট এনরিক পেনা নিয়েটোর সঙ্গে। ট্রাম্পকে কড়া জবাব না দিতে পারায় নিয়েটো ব্যাপক সমালোচিত হন। এ ছাড়া ট্রাম্পকে মেক্সিকোর বামপন্থি নেতা আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওবরাডোরের সঙ্গেও তুলনা করছেন কেউ কেউ। লোপেজও ট্রাম্পের মতো নির্বাচনের ফলাফল নিজের পক্ষে না এলে অস্বীকার করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর বাইরে প্রতিপক্ষকে কারাগারে ঢোকানোর মতো বিষয়গুলো মেক্সিকানদের কাছে সম্পূর্ণভাবেই পরিচিত। ইরান তেহ্রানে একটি বিষয় সুনিশ্চিত: যে প্রার্থীই মার্কিন নির্বাচনে জয়ী হোন না কেন, ইরানকে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। দুই প্রার্থীর মধ্যে হিলারি ক্লিনটনকেই তুলনামূলকভাবে কম দুষ্ট মনে করে ইরান। তারপরও বারাক ওবামার চেয়েও হিলারি ইরানের প্রতি অধিক কঠোর হবেন। ইরানিরা অবশ্য নির্বাচনে হিলারি আর ট্রাম্পের মধ্যেকার কুৎসিত প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে উপভোগই করছেন। ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত টিভি দুই প্রার্থীদের মধ্যেকার শেষ টিভি বিতর্ক সম্প্রচার করে, যা ইরানের ইতিহাসে বিরল। ট্রাম্প যেভাবে এই বিতর্কে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনেছে, তাতে ইরানিরা মজা পেয়েছেন বলা যায়। ২০০৯ সালে ওয়াশিংটন অভিযোগ করেছিল যে ইরানের ভোটে কারচুপি হয়েছিল। ওই স্মৃতির কথাও মনে করেছেন কেউ কেউ। আবার ট্রাম্পের বাগাড়ম্বর আর গণমাধ্যম ব্যবহারের বিষয়গুলো আবার কাউকে কাউকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের কথা। বারাক ওবামার অধীনে হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কাজ করলেও ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জন্য দেশটি দায়ী করে থাকে হিলারিকেই। পরে এই নিষেধাজ্ঞা থেকে ইরানের বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে তারা কৃতিত্ব দিয়ে থাকে হিলারির উত্তরসূরি জন কেরিকে। ইরান সম্পর্কে হিলারির মন্তব্যগুলো তারা ভোলেননি। ২০০৮ সালে এবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারেও হিলারির কথাগুলো ভুলতে পারেন না ইরানিরা। ওই সাক্ষাৎকারে হিলারি বলেছিলেন, ‘আমি ইরানিদের এটা বলতে চাই, আমি প্রেসিডেন্ট হলে ইরানে আক্রমণ চালাবো। আমরা তাদের ধ্বংস করে দেয়ার সক্ষমতা রাখি।’ রাজনৈতিক বিশ্লেষক আহমাদ শিরজাদ শারগ সংবাদপত্রকে বলেন, সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য ওবামা ছিলেন ‘ইরানের সবচেয়ে ভালো পছন্দ’। হিলারি তেমনটি হবেন না বলেই মনে করেন তিনি। চীন একদলীয় শাসনের দেশ চীনে সাধারণ জনগণের নিজ দেশের নেতাদের সম্পর্কে ভাবনা প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। মার্কিন নির্বাচন নিয়েও চীনে কোনো ধরনের জনমত জরিপ পরিচালিত হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন নিয়ে চলমান ঘোলাটে পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের আনন্দিত অনুভূতির কথাও লুকায়নি দেশটির কমিউনিস্ট পার্টি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমকে একজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই অনেক আমেরিকান তাদের গণতন্ত্রকে বিশ্বমানের বলে মনে করে আসছেন। কিন্তু আরো অনেক মার্কিনি এই ধরনের গণতন্ত্র ও এ বছরের নির্বাচন নিয়ে লজ্জিত।’ পিউ রিসার্চ সেন্টার গত মাসে এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, চীনে ভোট দেয়ার সুযোগ থাকলে হিলারিই বিজয়ী হতেন। ওই ফলাফলে দেখা যায়, হিলারির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন ৩৭ শতাংশ চাইনিজ, ট্রাম্পের ক্ষেত্রে তা ২২ শতাংশ। আবার ৪০ শতাংশ রয়েছেন ট্রাম্পের বিপক্ষে, হিলারির বিপক্ষে রয়েছেন ৩৫ শতাংশ। নির্বাচনী প্রচারণার সময় চীনকে নিয়ে যেসব মন্তব্য ট্রাম্প করেছেন, জরিপের ফলাফলে তারই প্রতিফলন দেখা যায়। ট্রাম্প বলেছিলেন, চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ধর্ষণ’ করে চলেছে। বলেছিলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ‘ধাপ্পাবাজি’ বৈ কিছুই নয়। নাগরিক অধিকার নিয়ে হিরারির স্পষ্ট অবস্থানের কারণেও তার প্রতি সমর্থন চীনে বেশি থাকতে পারে। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে জাতিসংঘের এক সম্মেলনে হিলারি বলেছিলেন, ‘মানবাধিকারই নারীর অধিকার, এবং নারীর অধিকারই মানবাধিকার।’ তার সেই বিখ্যাত উক্তির কারণেই এখনও চীনের নারী অধিকারকর্মীরা তাকে সম্মানের চোখে দেখেন। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে হিলারির জনপ্রিয়তা বেশি থাকলেও, কেউ কেউ মনে করেন দেশটির কমিউনিস্ট পার্টি গোপনে ট্রাম্পকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চায়। কানাডা আমেরিকার উত্তর সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী কানাডাতে মার্কিন নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কানাডার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। ফলে মার্কিন নির্বাচনে কে বিজয়ী হবেন, তা নিয়ে কানাডায় জল্পনা-কল্পনা থেমে নেই। ২০১৪ সালে কানাডার মোট বাণিজ্যের ৬০ শতাংশই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। এর পিছনে মূল ভূমিকা ছিল নাফটা চুক্তির। তবে ট্রাম্প ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘নাফটা হলো ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বাণিজ্য চুক্তি।’ তিনি হুমকি দিয়ে রেখেছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এই চুক্তিতে সংশোধনী আনবেন। আর সেই সংশোধনী মানতে কানাডা ও মেক্সিকো অস্বীকৃতি জানালে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই নাফটা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিবে। ট্রাম্পের এমন অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই কানাডার বাণিজ্য স্বার্থের বিরোধী। এই বিবেচনায় কানাডাতে ট্রাম্পের পক্ষে সমর্থন দুর্বল। দেশটিতে পরিচালিত এক জনমত জরিপে দেখা যায়, বেশির ভাগ কানাডিয়ানই হিলারির সমর্থক। সুযোগ থাকলে তাদের ৮০ শতাংশই ভোট দিতেন ডেমোক্রেট এই প্রার্থীকে। তবে কিছু সমর্থন রয়েছে ট্রাম্পের পক্ষেও। তারা বলছেন, ট্রাম্প কিস্টোন এক্সএল পাইপলাইন নিয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাতে করে তিনি প্রেসিডেন্ট হলেই কানাডা লাভবান হবে। হিলারির নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে কানাডায় আলোচনা কমই রয়েছে। কানাডার ডানপন্থি ও বামপন্থি- উভয় ঘরানার রাজনীতিবিদদের মধ্যেই ট্রাম্পকে নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ। তবে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এখনও পর্যন্ত কোনো প্রার্থী সম্পর্কেই তার নিজের অবস্থানের কথা জানাননি। মার্চে এক ফোরামে তিনি বলেন, ‘আমি এখন ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কোনো বিবাদে জড়াতে চাই না। নিশ্চিতভাবেই তাকে আমি সমর্থনও করছি না।’ এর আগে অবশ্য ডিসেম্বর মাসে তিনি ট্রাম্পের মুসলিমদের প্রতি নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাবনাকে ‘মূর্খামি ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে অভিহিত করেন। মার্চের বক্তব্যে স্পষ্টতই তিনি নরম সুরে কথা বলেছেন। আর তারপর থেকে দুই প্রার্থী সম্পর্কে মুখে কুলুপ এঁটেই রয়েছেন তিনি। মার্কিন নির্বাচনে কানাডার কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না- উপদেষ্টাদের এমন পরামর্শকেও মেনেই চলছেন তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.