দখল আর দূষণের মহোৎসব চলছে শীতলক্ষ্যায়। একটি প্রভাবশালী মহল যে যার মতো দখল করছে, আরেক মহল নিজের ইচ্ছেমত বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলছে। এই দুই কারণে মরতে বসেছে শান্ত স্বভাবের শীতলক্ষ্যা। শিল্প-কারখানার ক্যামিকেলযুক্ত বিষাক্ত বর্জ্যে স্বচ্ছ সুপেয় পানি এখন পরিণত হয়েছে বিষে। পান করা তো দূরের কথা, শীতলক্ষ্যার কুচকুচে কালো পানির পচা পূতি দুর্গন্ধের কারণে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে নদী পারাপার হতে হয়। নদীর পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ায় তীরবর্তী মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। বিপন্ন হয়ে পড়ছে নাগরিক জীবন। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নদীতে শিল্পবর্জ্য ফেলা আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হলেও বাস্তবে অপরাধীদের সামাল দেয়ার কোনো উদ্যোগই নেই। শীতলক্ষ্যা মরে গেলেই যেন তারা বেঁচে যান, ভাবটা এমন। কিন্তু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দাদের। তারা যে কোনো উপায়ে নদীটিকে রক্ষা করতে চান। কিন্তু কথায় আছে ‘সাধ আছে সাধ্য নেই’। নদীয় রক্ষায় সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, দখলদার ও দূষণকারীরা অনেক শক্তিশালী। ২০১১ সালে এক রায়ে মহামান্য হাইকোর্ট নদীতে সংযুক্ত সব পয়ঃপ্রণালীর লাইন ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য নিঃসরণ লাইন অবিলম্বে বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট সব মহলকে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে নদী দূষণমুক্ত রাখাসহ ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিআইডব্লিউটিএ’কে এবং নদীতে বর্জ্য ফেলা রোধে সচেতনতা সৃষ্টিসহ বর্জ্য অপসারণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করেন। পাশাপাশি জেলা প্রশাসককে প্রতি মাসে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করারও নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে উচ্চ আদালতের এসব আদেশ-নির্দেশ বাস্তবায়নের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আদালতের আদেশে নদীর সীমানা নির্ধারণের সিএস নকশা অনুসরণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা প্রতিপালন করা হয়নি। দূষণ যেভাবে সূত্রমতে, নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার কলাগাছিয়া থেকে ময়মনসিংহ জেলার টোক-বর্মী এলাকা পর্যন্ত ৬৫ মাইল বিস্তৃত শীতলক্ষ্যা নদী। নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ জেলায় এ নদী অতিবাহিত হয়ে মুন্সীগঞ্জের মেঘনায় মিলিত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জ থেকে নরসিংদীর ঘোড়াশাল পর্যন্ত গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কল-কারখানা। এছাড়া জেলার ৭টি থানা এলাকায় প্রায় তিন শতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের ডাইং রয়েছে। এসব কারখানায় কাজই হয় মূলত কেমিকেল দিয়ে। তিন শতাধিক ডাইং শিল্প-কারখানার বর্জ্যই ৮০ শতাংশ। এছাড়া রয়েছে বোর্ড মিল, ডাইং, অয়েল রিফাইনারি কারখানা, লেদার প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, পাল্প অ্যান্ড পেপার মিল। এ কারখানাগুলোর বর্জ্যের ড্রেনের লাইন রয়েছে সরাসরি শীতলক্ষ্যা নদীতে। ফলে সব কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই এসব নদীতে এসে পড়ে। তার সঙ্গে এ নদীতে পড়ছে নারায়ণগঞ্জ শহর ও শহরতলির নাগরিক বর্জ্য। এছাড়া ঢাকা শহরের উত্তরাঞ্চলের সব কারখানা ও নাগরিক বর্জ্য বালু নদীতে পড়ে। সেখান থেকে স্রোতের টানে সোজা চলে আসে শীতলক্ষ্যায়। নারায়ণগঞ্জ ও এর আশপাশের শিল্প-কারখানা থেকে ৬২ ধরনের রাসায়নিক বর্জ্য নদীর পানিতে মিশছে। এসব বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, পারদ, ক্লোরিন, নানা ধরনের এসি দস্তা, নিকেল, সিসা, ফসফোজিপসাম, ক্যাডমিয়াম, লোগা অ্যালকালি ইত্যাদি। সরজমিন শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত বর্জ্য মিশ্রিত পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা। নদীর দুই তীরের অসংখ্য ছোট-বড় শিল্পকারখানা থেকে পাইপ, ড্রেন ও খাল দিয়ে বিষাক্ত কেমিক্যাল ও বর্জ্য মিশিত পানি শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হচ্ছে। সাধারণত শীতলক্ষ্যার দুই তীরে গড়ে উঠা সার, তেল, পাস্টিক, ডাইং, নিটিং ও পেপার মিলসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি রিফাইনিং না করেই শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে নদীর বারোটা বাজিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে একদিকে পরিবেশ বিপর্যস্ত অন্যদিকে পানির রং কালচে হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পানির দুর্গন্ধে মুখে রুমাল চেপে নদী পারাপার হচ্ছে নৌযাত্রীরা। আগের মতো নদীপাড়ের মানুষদের দেদার গোসল করতেও দেখা যায় না। হারিয়ে গেছে নানা প্রজাতির মাছ।
ডিএনডির অভ্যন্তর থেকেই ৩২১ কোটি ঘনফুট বর্জ্য সূত্রমতে, উন্নতজাতের ইরি ধানের প্রকল্প বাস্তবায়নে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) প্রজেক্টটি ১৯৬৫-৬৮ সালে ৫ হাজার ৮৬০ হেক্টর আয়তনের জায়গা নিয়ে গড়ে উঠে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত প্রকল্পটি লাভের মুখ দেখে। কিন্তু ১৯৮৮ সালে দেশের ৮০ ভাগ ভূমি বন্যাকবলিত হলেও ডিএনডি থাকে বন্যামুক্ত। ফলে কারখানা মালিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে ডিএনডিতে। গড়ে তোলে অপকল্পিত শিল্প-কারখানা। প্লাস্টিক, ডাইং, নিটিং ও পেপারসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প কারখানায় ঢাকা পড়ে ইরি ধান চাষের প্রকল্প। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিএনডির ডেমরা, শ্যামপুর, কদমতলী, যাত্রবাড়ি, ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানার বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা অসংখ্য মিল কারখানার বর্জ্য মিশ্রিত পানি সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলস্থ পাম্প হাউজের ১২৮ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন ৪টি পাম্প দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ডিএনডির অভ্যন্তরের মিল কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল ও বর্জ্য মিশ্রিত পানি রিফাইনিং না করেই ডিএনডির নিষ্কাশনে খালে ফেলা হয়। ডিএনডির প্রধান নিষ্কাশন খাল দিয়ে বিষাক্ত ও বর্জ্য মিশ্রিত পানি শিমরাইলস্থ পাম্প হাউজের ৪টি মেশিনের সাহায্যে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলা হয়ে থাকে। পাম্প হাউজ সূত্রে জানায়, শীত মৌসুমে ডিএনডি প্রজেক্টে পানি নিষ্কাশনের তেমন কোনো প্রয়োজন হয় না। শুষ্ক মৌসুমে পাম্প হাউজের গেট খুলে দিয়ে অনবরত শীতলক্ষ্যা নদীতে পানি পড়ছে। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করা হয়। এক বছরে আনুমানিক ৮ হাজার ৭১৪ ঘণ্টা পাম্প চালানো হয়। আবার কোনো কোনো বছর কম-বেশিও পাম্প চালানো হয়ে থাকে। বিশেষ করে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিলে ও বৃষ্টিপাত বেশি হলে অতিরিক্ত পানি শীতলক্ষ্যায় নিষ্কাশন করা হয়। ডিএনডির একটি সূত্র জানায়, এক বছরে আনুমানিক ৩২১ কোটি ঘনফুট বর্জ্য ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি শীতলক্ষ্যা নদীতে নিষ্কাশন করা হয়। অবশ্য পাম্প হাউজের এক কর্মকর্তা অকপটে নিষ্কাশন খাল দিয়ে বর্জ্য ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি শীতলক্ষ্যা নিষ্কাশনের কথা স্বীকার করেন। শিমরাইলস্থ পাম্প হাউজ এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পাম্প হাউজের নিষ্কাশন খালের মুখে বিপুল পরিমাণ ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমা পড়ে আছে। পাম্প হাউজের ইনটেক খালের মাধ্যমে কাঁচপুর ব্রিজ এলাকা দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে ডিএনডির পানি নিষ্কাশন করা হয়। এখানকার লোকজন বিষাক্ত পানির গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। বিষাক্ত পানির কারণে দিন দিন শীতলক্ষ্যা নদীর মৎস্য উজাড় হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, মিল কারখানার মালিকরা তাদের বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি ফেলার নিরাপদ স্থান হিসেবে শীতলক্ষ্যা নদীকেই বেছে নিয়েছে। ফলে শীতলক্ষ্যার পানি দিন দিন ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়ে শীতলক্ষ্যার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এতে স্থানীয় বাসিন্দারা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং শীতলক্ষ্যা নদীকে মারাত্মক দূষণের কবলের হাত থেকে রক্ষার করার জোর দাবি জানিয়েছেন। দখলের মহোৎসব এদিকে শীতলক্ষ্যা দখলের উৎসব চলছে। বড় বড় শিল্প গ্রুপের বাধাহীন দখল নদীর বিস্তৃতি সংকুচিত করছে। নদীখেকোরা তাদের থাবা ক্রমশ বিস্তার ঘটিয়ে চলছে। সীমানা খুঁটির কোনো ধারই তারা ধারছে না। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে দায়সারা দায়িত্ব পালন করছে। দলখদারিত্বের মাধ্যমে নদী গিলে খাওয়ার অপপ্রয়াস চলছে বহুদিন ধরে। নদীখেকোরা রাজনৈতিক পরিচয়ে ভিন্ন ভিন্ন দলের হলেও এক্ষেত্রে তারা একে অপরের সহযোগী। বালু বিক্রির গদি স্থাপন, পাথর ভাঙার মেশিন বসিয়ে নদীর তীর দখলে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। শিল্প কারখানার মালিকরাও নদী দখলে পিছিয়ে নেই। তারা ক্রমেই নদীর গভীরে পাইলিংয়ের মাধ্যমে শিল্প কারখানা গড়ে তুলছেন। কেউ কেউ নদীর তীর ভরাট করে ঘর-বাড়ি, দোকানপাট সমপ্রসারণ করে শীতলক্ষ্যা নদী প্রতিযোগিতা করে দখলে নিচ্ছেন। কাঁচপুর ব্রিজের উত্তর পাশ থেকে ঘোড়াশাল ব্রিজ পর্যন্ত শীতলক্ষ্যার দুই তীর বিশেষ করে পূর্ব তীরে দেড় শতাধিক শিল্প কারখানার অধিকাংশই নদী দখল করছে। ওই সকল স্থানে এতটাই ভরাট করা হয়েছে যে, নদী একেবারে সংকুচিত হয়ে গেছে। এছাড়া এবং কাঁচপুর ব্রিজের দক্ষিণ পাশ থেকে বন্দরের কলাগাছিয়া পর্যন্ত নদীর দুই তীরে ছোট-বড় অনেক শিল্প কারখানা, ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠান ও আবাসন ভবন নদী দখল করেছে। শীতলক্ষ্যার তীরে সামান্য জমি ক্রয় করে নানা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে নদী ভরাট করা হচ্ছে। শীতলক্ষ্যা নদীর তীর দখল করে বালু ও পাথর ব্যবসার কারণেই কাঁচপুর সেতু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কাঁচপুর সেতু এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী সবচেয়ে বেশি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সরজমিন অনুসন্ধানকালে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, স্থানীয় পর্যায়ের ভূমি অফিসের কিছু অসৎ কর্মচারীর যোগসাজশে ইদানীং প্রভাবশালীরা নদীর জায়গার ভুয়া কাগজপত্রও বানিয়ে নিচ্ছে, তৈরি করছে জাল দলিল-দস্তাবেজও। এসব ভুয়া জাল কাগজপত্রকে সম্বল করেই নানারকম মামলা ঠুকে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টিসহ স্থানীয় থানা পুলিশকে নিজেদের পক্ষে রাখার মাধ্যমে ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের দ্বারা দখল করে নিচ্ছে নদীর সীমানা। নদীর উভয়পাড়ে জায়গা জমি কেনার মাধ্যমে নদীর টুঁটি চেপে ধরার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দুই পাশ থেকেই নদীর সীমানা দখলবাজির মাধ্যমে একচিলতে খালে রূপান্তর করা হচ্ছে শীতলক্ষ্যাকে। শীতলক্ষ্যা নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট সরজমিন ঘুরে দখলবাজির নানাচিত্র দেখা গেছে। অবিলম্বে শীতলক্ষ্যা নদীর তীর দখলকারীদের উচ্ছেদের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.