এ বছরের শুরুতে একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আয়োজিত শিক্ষামেলায় গিয়েছিলাম শুধুই বিনোদন পাওয়ার জন্য! এ ধরনের মেলায় বেশির ভাগ এজেন্টই খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা এবং স্কলারশিপ-সংক্রান্ত বেশ কিছু ভুল এবং অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়ে থাকে। তারা তাদের স্মার্ট বেশভূষা এবং বাকপটুতার মাধ্যমে খুব সহজেই উৎসুক শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করে নেয়। তারা শিক্ষার্থীদের সিজিপিএ এবং স্টাডি ব্যাকগ্রাউন্ড জিজ্ঞেস করে মুহূর্তের মধ্যে সেই শিক্ষার্থীর কোন বিষয়ে পড়া উচিত, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিচ্ছে। এই মেলাতেও তার ব্যতিক্রম দেখলাম না। আমার এক পরিচিত শিক্ষার্থী ফুল স্কলারশিপ নিয়ে পড়ছে এমন এক ইউনিভার্সিটির স্টল দেখে একটু পরীক্ষা করে দেখার শখ হলো। আমার পরিচিত সেই শিক্ষার্থী যে সাবজেক্টে পড়ছে সেটাতে স্কলারশিপসহ পড়তে চাই, বললাম তাদের। তখন আমাকে বলা হলো যে ওই সাবজেক্টে নাকি বাংলাদেশিদের জন্য কোনো স্কলারশিপ বরাদ্দ নেই। প্রথমে আমি সেই ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটের রেফারেন্স দিয়ে বললাম যে এমন কোনো কিছু তো উল্লেখ করা নেই এখানে। তারপর বলল এগুলো নাকি ওয়েবসাইটে লেখা থাকে না, এগুলো ভেতরের ব্যাপার এবং শুধু তারাই জানে!
আমার এক প্রাক্তন ছাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি অবস্থাতেও কয়েকটি কাউন্সেলিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এর পেছনে তার তিনটি সেমিস্টার এবং প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। কেউ কেউ আবার এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় যেতে পারলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয় না। অনেক বাবা-মা মরিয়া হয়ে ওঠেন তাঁদের সন্তানকে বিদেশে পড়ানোর জন্য। অনেকেই আবার দেশে অত্যন্ত ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা বিদেশে সন্তানকে পড়ানোকে স্ট্যাটাস বৃদ্ধি বলে মনে করেন।
যারা মেধাবলে ফুল স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যায় তাদের কথা আলাদা। কিন্তু যারা নামমাত্র স্কলারশিপ নিয়ে অথবা অড জব করে বিদেশে পড়াশোনা করে তাদের প্রচণ্ড সংগ্রাম করতে হয়। এ পর্যন্ত পড়াশোনা, গবেষণা এবং ভ্রমণের জন্য পৃথিবীর ২১টি দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। আমি প্রতিবারই চেষ্টা করেছি সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে তাদের অবস্থা জানতে। তারা অনেকেই নির্ধারিত সময়ের প্রায় দ্বিগুণ সময় নিচ্ছে পড়াশোনা শেষ করতে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে কাজ এবং পড়াশোনার চাপের মধ্যে সমন্বয় করতে না পারা। অনেেক আবার সময়মতো পড়াশোনা করতে না পেরে প্রচণ্ড হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, বিপথে গমন করে অথবা ডিগ্রি অর্জন না করেই দেশে ফিরে আসে।
আমি মনে করি, বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু ফুল স্কলারশিপ অথবা অন্য কোনো সাপোর্ট সিস্টেম ছাড়া অন্তত আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে না যাওয়াই শ্রেয়। এখন তথ্যপ্রযুক্তির উত্কর্ষের যুগ। বিদেশে উচ্চশিক্ষা এবং স্কলারশিপ-সংক্রান্ত সব তথ্য অনলাইনে পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের উচিত নিজের চেষ্টায় আবেদন করা। দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির সহায়তা ছাড়াই নির্ভুলভাবে এটি করা সম্ভব। কোনো শিক্ষার্থী যদি একান্তই সক্ষম না হয় তাহলে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। শুধু ইউনিভার্সিটি নয়, শিক্ষার্থীদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য স্কুল-কলেজেও ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং বিভাগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অনেক ইউনিভার্সিটিতে নামমাত্র ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং বিভাগ রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো সেবা পায় না। যার ফলে তারা প্রচুর টাকার বিনিময়ে হলেও বাইরের কাউন্সেলিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্য নিচ্ছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাউন্সিল বিভাগগুলোকে হতে হবে তথ্যসমৃদ্ধ, আপডেটেড এবং ছাত্রদের প্রতি সহনশীল ও বন্ধুভাবাপন্ন।
এ দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে রয়েছে প্রচুর শিক্ষার্থী, যারা মানসম্মত শিক্ষালাভের সুযোগ পায় না। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে অসম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করায় পরবর্তীকালে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না এই শিক্ষার্থীরা। কেউ–বা মাঝপথে পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। ফলে যুবসমাজে বাড়ছে বেকারত্ব, বাড়ছে হতাশা। অবস্থা কতটা সংকটাপন্ন তা সবচেয়ে ভালো করে বুঝতে পারি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলায় অবস্থিত এইচএ ডিজিটাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে। অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণি নিয়ে যারা এসেছিল, তারাও খুব সাধারণ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। যেই বিষয়ে তারা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছে, সেই বিষয়ের ওপরও তাদের কোনো মৌলিক জ্ঞান নেই। কয়েক শ প্রার্থীর ইন্টারভিউ নিলাম, সবার অবস্থা প্রায় একই। আশপাশের গ্রামের কিছু অভিজ্ঞ শিক্ষকও এলেন ইন্টারভিউ দিতে, তাঁরাও তেমন ভালো করতে পারলেন না। উপরন্তু এখানে পড়াতে হলে ছাত্রদের প্রতিষ্ঠানেই যত্নসহকারে পড়াতে হবে, প্রাইভেট কোচিং করানো যাবে না শুনে তাঁরা পিছিয়ে গেলেন।
এ পর্যায়ে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়লাম এই শঙ্কায় যে, আদৌ প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারব কি না। কিন্তু আমি হার মানলাম না। বিজ্ঞাপন, মাইকে প্রচারণার মাধ্যমে বেশ কয়েক দফা ইন্টারভিউ নেওয়ার পর শেখার আগ্রহ আছে এবং প্রশিক্ষণ দিলে ভালো করতে পারবে এমন কিছু প্রার্থীকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হলো। দীর্ঘ ছয় মাস তাদের বিনা মূল্যে ভাষা, তথ্য ও যোগাযোগ–প্রযুক্তি এবং সুনির্দিষ্টবিষেয়প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। প্রশিক্ষণ শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হলো শিক্ষকদের। এখনো নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। এর ফলে শিক্ষকদের মাঝে তৈরি হয়েছে তীব্র জানার আগ্রহ এবং প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস।
আমি মনে করি শুধু শিক্ষা নয়, মানসম্মত শিক্ষা হচ্ছে টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। আর এই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন দক্ষ শিক্ষক। সাহস, অনুপ্রেরণা এবং কার্যকর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষক তৈরি করা অবশ্যই সম্ভব। এর পাশাপাশি প্রয়োজন গ্রামের ছাত্র এবং অভিভাবকদের মাঝে আত্মবিশ্বাস ও স্বপ্ন জাগ্রত করা। প্রতিষ্ঠানটি শুরুর আগে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি তাঁরা মনে করেন, মানসম্মত শিক্ষা কেবল শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পাওয়া সম্ভব। তাঁদের আর্থিক সংগতি নেই শহরে পাঠিয়ে বা কোচিংয়ে পড়িয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ানো। তাই গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিম্নমানের শিক্ষা লাভ করে ভবিষ্যতে তাঁদের সন্তানেরা ভালো কিছু করতে পারবে না। এসব নানা ধরনের হীনম্মন্যতায় তাঁরা ভোগেন। তাই তাঁরা শিক্ষার পেছনে সময় ব্যয় করার চেয়ে জীবিকা উপার্জনে সন্তানদের নিয়োজিত করার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।
এইচএ ডিজিটাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে তাঁরা যখন দেখলেন তাঁদের সন্তানেরা ল্যাপটপ, পিসি ট্যাবলেট, ডিজিটাল বই ব্যবহার করে পড়াশোনা করছে তখন তাঁদের ধারণা পরিবর্তন হতে শুরু করল। শিক্ষকেরা পাওয়ার পয়েন্ট, স্মার্ট বোর্ড, অডিও, ভিডিও ব্যবহার করে পড়ার বিষয়গুলোকে ছাত্রদের কাছে বৈচিত্র্যময় করে তোলেন। এর ফলে ছাত্ররা সহজেই পড়া আয়ত্ত করতে পারছে এবং প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত এবং পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে। সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও সঠিক শিক্ষা প্রদান মনিটরিংয়ের জন্য প্রতিটি ক্লাসে এবং করিডরে বসানো হয়েছে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৫০টি গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে। প্রযুক্তিনির্ভর পড়াশোনা তাদের আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছে, বদলে দিয়েছে তাদের জীবন। সুতরাং প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য খুবই কার্যকরী উপায়। প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার এই মডেলটি সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করা যেতে পারে। গ্রামের এই বিপুল জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য মানসম্মত শিক্ষাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
কয়েক মাস আগে এইচএ ডিজিটাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে আমরা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে উপস্থিতি নিবন্ধন চালু করি। অভিভাবকদের মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রতিষ্ঠানে তাঁদের সন্তান আসলেই উপস্থিত হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে সঠিক তথ্যটি জানিয়ে দেওয়া হয়। এতে যেমন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের উপস্থিতির হার এক শ ভাগের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তেমনি গ্রামের অভিভাবকেরা আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছেন। আমরা চেষ্টা করি নিয়মিত অভিভাবকদের একত্র করে কথা বলতে। তাঁদের আমরা মার্জিত ভাষায় কথা বলতে অনুপ্রাণিত করি। তাঁদের সন্তানদের প্রতি সহনশীল হওয়ার পাশাপাশি বন্ধুসুলভ আচরণ করতে বলি। ছেলেমেয়েদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা এবং তাদের মানসিক বিকাশের জন্য এই বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ক সচেতনতা শহরের অনেক পরিবারে থাকলেও গ্রাম অঞ্চলে নেই বললেই চলে। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষক এবং অভিভাবকদের বেশির ভাগই মনে করেন শুধু কড়া শাসনের মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের সঠিক পথে পরিচালিত করা সম্ভব। গ্রাম এবং মফস্বলের অনেক স্কুলেই শারীরিক শাস্তির প্রচলন রয়েছে। যাঁরা প্রবীণ তাঁরা অনেকেই হয়তো বলবেন যে তাঁরা এভাবেই মানুষ হয়েছেন এবং এতে কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এখন আধুনিক প্রযুক্তির এবং যোগাযোগমাধ্যমের উত্কর্ষের কারণে পরিবার এবং বিদ্যাপীঠ থেকে সহযোগিতা না পেলে ছেলেমেয়েরা খুব সহজেই বিকল্প রাস্তা খুঁজে নিতে পারে।
অতিরিক্ত শাসনের পরিবর্তে শিক্ষক এবং অভিভাবকেরা যদি ছেলেমেয়েদের বিশ্বাস অর্জন করে তাদের সঙ্গে দূরত্ব মোচন করতে পারেন, তাহলে অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশেই কমে আসবে। সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনায় অনেক পরিবারই এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে যত্নশীল হয়েছেন বলে আমি মনে করি। কিন্তু গ্রামের অভিভাবকদের মধ্যে এই বিষয়ক সচেতনতা এখনো তৈরি হয়নি। প্রযুক্তির প্রসার যে শুধু শহরাঞ্চলেই ঘটেছে তা কিন্তু নয়, গ্রামে এখন অনেক সচ্ছল পরিবার আছে যারা নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এই পরিবারগুলোতে সচ্ছলতা থাকলেও রয়েছে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। তাই টাকা হলেই কম বয়সী ছেলেমেয়েদের আবদার মেটানোর জন্য কিংবা শখ করে অভিভাবক নিজেই তুলে দিচ্ছেন মোবাইল, ট্যাবলেট ইত্যাদি। তাঁরা খোঁজ নিয়েও দেখছেন না যে তাঁদের সন্তানেরা এই ডিভাইসগুলোর সদ্ব্যবহার করছে কি না। ফলে তাদের গ্রামের ছেলেমেয়েরা বিপথগামী হচ্ছে অল্প বয়সেই। এইচএ ডিজিটাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে আমরা শিক্ষক এবং অভিভাবকদের সঙ্গে এ রকম অনেক সমস্যা নিয়ে খোলামেলাভাবে আলোচনা করি। অভিভাবকদের এই ব্যাপারগুলো বোঝানো কষ্টসাধ্য হলেও নিয়মিত তাদের উপযোগী কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এটা করা সম্ভব।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.