নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এফবিআই সূত্রকে উদ্ধৃত করে ওয়ার্ল্ড পলিটিকাস.কম দাবি করেছে, ই-মেইল স্ক্যান্ডাল সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে আগামী বছর অভিযুক্ত হবেন হিলারি ক্লিনটন। শিরোনামটি ছিল এমন: ‘তোমাদের প্রার্থনার ফল মিলেছে’। ট্রাম্প সমর্থকদের জন্য বিষয়টা আসলেই এমন। আর এ কারণেই ভিত্তিহীন ‘রিপোর্ট’টি ফেসবুকে শেয়ার, রিঅ্যাকশন আর মন্তব্য পেয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি। এই যখন পরিস্থিতি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৬ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত মেসিডোনিয়ার ছোট্ট একটি শহরে এক তরুণ ঘরে বসে গুনছে তার গুগল অ্যাডসেন্স অ্যাকাউন্টে কত ডলার জমা হলো! মেসিডোনিয়ার ভেলেস শহরের জনসংখ্যা মাত্র ৪৫ হাজার। আর এ শহরের কিছু বাসিন্দা প্রায় ১৪০টি মার্কিন রাজনীতিকেন্দ্রিক ওয়েবসাইট খুলেছে। ওয়েবসাইটগুলোর নাম রাখা হয়েছে আমেরিকার সঙ্গে যুৎসই করে। যেমন, ওয়ার্ল্ডপলিটিকাস.কম, ট্রাম্পভিশন ৩৬৫.কম, ইউএসকনজারভেটিভটুডে.কম, ডোনাল্ড ট্রাম্পনিউজ.সিও, ইউএসএডেইলিপলিটিকস.কম, ইত্যাদি। এগুলোর প্রত্যেকটিই ট্রাম্পের পক্ষে আক্রমণাত্মক প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের টার্গেট হলো যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল ভোটার ও ট্রাম্প সমর্থকরা। এ খবর দিয়েছে বাজফিড। এসব ওয়েবসাইট যেসব তরুণ চালাচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভালোমন্দ নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা স্রেফ আর্থিক দিকটাই দেখছে। ফেসবুক নিয়মিতই তাদের আয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, একজন মার্কিন ফেসবুক ব্যবহারকারী আমেরিকার বাইরের কোনো ব্যবহারকারীর চেয়ে ৪ গুণ বেশি মূল্যবান। প্রতি ক্লিকে অর্থ আসবে এমন বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটা অংশ এখন মেসিডোনিয়ার ওই ভেলেস শহরেও যায়। এসব সাইট পরিচালনা করে এমন কিছু তরুণ ও কিশোর জানায়, তারা শিখেছে ওয়েবসাইটের ট্রাফিক বাড়ানোর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় হলো ফেসবুকে রাজনীতিভিত্তিক প্রতিবেদনগুলো ছড়িয়ে দেয়া। আর ফেসবুকে শেয়ার বাড়ানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সেনসেশন সৃষ্টিকারী লেখা প্রকাশ করা। আর এসব লেখায় বেশির ভাগ সময়ই ভুয়া তথ্য থাকে। আর এসব ভুয়া তথ্য গিলতে ট্রাম্প সমর্থকরা তো আছেনই। এরই ফলস্বরূপ দূরের দেশ মেসিডোনিয়ার ভেলেস শহরকে এখন ট্রাম্পপন্থি সাইটগুলোর আখড়া বলা চলে! এমনকি মার্কিন নির্বাচনকেন্দ্রিক ভুয়া ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ব্যাপকহারে ছড়াতে এ ধরনের ওয়েবসাইটগুলো একটা ভূমিকাও পালন করছে। ভেলেসের এক ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেও এমন একটি ওয়েবসাইট খুলেছে। তার ভাষ্য, ‘হ্যাঁ, এ ধরনের ব্লগে যেসব তথ্য দেয়া হয় তা খারাপ, মিথ্যা আর বিভ্রান্তিকর। কিন্তু এখানে যুক্তিটা হচ্ছে, যদি এসব মানুষকে ক্লিক করতে আর পড়তে আগ্রহী করে তোলে, তাহলে এসব ঠিক আছে।’ ডোমেইন নাম নিবন্ধন রেকর্ড ও অনলাইন সার্চের মাধ্যমে বাজফিড নিউজ ভেলেস শহরে সক্রিয় এ ধরনের শতাধিক ওয়েবসাইট খুঁজে পায়। এ ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির ফেসবুক পেইজ লাইক দিয়ে রেখেছে হাজার হাজার মানুষ। বর্তমানে সক্রিয় নয় এমন আরো ৪০টি মার্কিন রাজনীতিকেন্দ্রিক ওয়েবসাইট পাওয়া গেছে, যা খুলেছিলেন এ শহরেরই বাসিন্দারা। গার্ডিয়ানের একটি রিপোর্টে এ ধরনের ১৫০টি ওয়েবসাইটের কথা বলা হয়েছিল। এ ওয়েবসাইটের মালিকরা বলছেন সম্পূর্ণ আর্থিক কারণেই তারা এসব ওয়েবসাইট খুলেছেন। ডেইলিনিউজপলিটিক নামে একটি ওয়েবসাইটের মালিক ১৭ বছর বয়সী এক ছেলে। আরো চার জন মিলে এ ওয়েবসাইট চালায় ছেলেটি। তার ভাষ্য, ‘আমি ওয়েবসাইটটি খুলেছি অর্থ আয়ের সহজ উপায়ের জন্য। মেসিডোনিয়ার অর্থনীতি খুবই দুর্বল। কিশোরদের কাজ করতে দেয়া হয় না। এ জন্য সৃজনশীল উপায় খাটিয়ে কিছু টাকা আয় করতে হয় আমাদের। যেমন, আমি একজন গায়ক। কিন্তু সংগীতের যন্ত্রপাতি কেনার অর্থ আমাদের নেই। আর এখানে ছোট একটি ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়েই অনেক কিছু করা যায়।’ এ বছরের শুরুর দিকে এ শহরেরই কিছু লোক বামপন্থি বা বার্নি স্যান্ডার্সকেন্দ্রিক ভুয়া খবর ছড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ফেসবুকে ট্রাম্পকেন্দ্রিক ভুয়া নিউজেই তারা সফল হয়েছে বেশি। এখান থেকে আয় হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফলে তারা ট্রাম্পের দিকেই মনোযোগী হয়েছে। বিভিএনিউজ.কম নামে একটি ওয়েবসাইট চালায় ১৬ বছর বয়সী এক ছেলে। তার ভাষ্য, ‘আমেরিকার লোকজন ট্রাম্প সংক্রান্ত নিউজ পড়তে পছন্দ করে বেশি।’ বাজফিডের গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ওয়েবসাইটের সবচেয়ে বহুল পঠিত প্রতিবেদনগুলো পুরোপুরি মিথ্যা কিংবা বিভ্রান্তিকর। যেমন, কনজারভেটিভস্টেট.কম নামে ওয়েবসাইটটির সবচেয়ে পঠিত প্রতিবেদনটির শিরোনাম হলো: ‘হিলারি ক্লিনটন ২০১৩ সালে: ‘আমি ডনাল্ড ট্রাম্পের মতো লোককে নির্বাচনে লড়তে দেখতে চাই; তারা সৎ আর তাদের কেনা যায় না।’’ এক সপ্তাহ পুরনো এ প্রতিবেদনটি ফেসবুকে ৪ লাখ ৮০ হাজার শেয়ার, মন্তব্য ও রিঅ্যাকশন পেয়েছে! মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে এর তুলনা করা যাক। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সবচেয়ে আলোচিত প্রতিবেদনটির একটি হলো ডনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে আয়কর ফাঁকি দিয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে, এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ। ওই প্রতিবেদন ফেসবুকে শেয়ার, মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার! অর্থাৎ, নিউ ইয়র্ক টাইমসের চেয়েও ৪ গুণ ট্রাফিক পেয়েছে কনজারভেটিভস্টেট.কম নামের ওই ওয়েবসাইটটি! অথচ, তাদের খবরটি ছিল ভুয়া। এ প্রতিবেদনের উৎস হলো দ্যরাইটিস্ট.কম। এ সাইটটি স্বীকার করে যে তারা সত্য ও মিথ্যা উভয় ধরনের গল্পই ছাপে। মূল খবরে উইকিলিকসের ফাঁস করা ই-মেইলকে সূত্র হিসেবে বলা হয়েছে। হিলারি এক ব্যক্তিগত বক্তৃতায় বলেছিলেন, তিনি চান আরো বেশি সফল ব্যবসায়ী রাজনীতিতে আসুক। তিনি ডনাল্ড ট্রাম্পের কথা উল্লেখ করেননি। কিন্তু ওই প্রতিবেদনে বিকৃত করে ডনাল্ড ট্রাম্পের অংশ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। মেসিডোনিয়ান এ ওয়েবসাইটগুলোর সবচেয়ে পঠিত ৫টি ‘খবরে’র ৪টিই মিথ্যা। এ কথিত খবরে দাবি করা হয়, পোপ ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন। মাইক পেন্স বলেছেন মিশেল ওবামা আমাদের পাওয়া সবচেয়ে অশ্লীল ফার্স্টলেডি। এ চারটি খবর ফেসবুকে শেয়ার, প্রতিক্রিয়া বা মন্তব্য পেয়েছে মোট ১০ লাখেরও বেশি! এর মানে, লাখো, কোটি মানুষ এসব লেখা পড়তে ক্লিক করেছেন। আর এর ফলে সাইটের মালিক বিপুল পরিমাণ ডলার কামিয়েছেন। পাশাপাশি অনেক মানুষ ভুল তথ্য পেলেন। তবে এখন মেসিডোনিয়ায় অনেকেই এ কারবারের সঙ্গে জড়িত হওয়ায়, অর্থ আয় কমেছে কিছুটা। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে যারা ওয়েবসাইট চালু করেছিল তারা অর্থ কামাচ্ছে বেশি। যেমন, ওই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেটি জানায়, তার ছেলে মাসে ৫ হাজার ডলার আয় করে! আবার কোনোদিন হিট হয়ে গেলে, দিনে ৩ হাজার ডলার পর্যন্ত আয় করে সে! বিএভএনিউজ.কম চালায় যে কিশোর, সে জানিয়েছে তার আরেকটি স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ওয়েবসাইট আছে। এ দু’টো সাইটে মাসে ১০ লাখ পেইজ ভিউ আসে! আরেক তরুণ জানায়, সেও একটি ওয়েবসাইট খুলেছিল মার্কিন রাজনীতি নিয়ে। কিন্তু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আরেকটি ওয়েবসাইটের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে ওই ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে সে। কারণ, স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ওয়েবসাইটটিতে আয় হয় বেশি। তার ধারণা, ভেলেস শহর থেকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ওয়েবসাইট চালানো হয় হাজার হাজার! অর্থাৎ, ট্রাম্প আর ফেসবুকের আয়ের সুবিধার জন্য এ বছর মার্কিন রাজনীতি বিশেষ আশীর্বাদ হয়ে এসেছে তাদের জন্য। অন্য মৌসুমে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ওয়েবসাইটই তাদের মূল আয়ের ক্ষেত্র।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.