ঘাঁটি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ
শতাধিক ডলার প্রতারক দাবড়ে বেড়াচ্ছে সারা দেশ। বিশাল এ প্রতারকচক্রটি ঘাঁটি গেঁড়েছে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায়। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে চক্রের সদস্যদের গলায় গলায় ভাব। এ কারণে প্রতারকরা নানা কৌশলে প্রথমে নিরীহ মানুষকে ওই উপজেলায় নিজেদের আস্তানায় নিয়ে আটক করে। এরপর সাধারণ মানুষের টাকাপয়সা রেখে দিয়ে সর্বস্বান্ত করছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। এছাড়া পুলিশ সাজিয়ে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে নগদে, বিকাশ বা চেকের মাধ্যমে বড় অঙ্কের টাকা দিতে বাধ্য করছে। দেশের শীর্ষ এক গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে লোমহর্ষক তথ্য পেয়েছে। বিশেষ প্রতিবেদনে তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, ডলার প্রতারক চক্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরোক্ষ সহযোগিতা পাচ্ছে। এ কারণে তারা দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে দিনাজপুরের বীরগঞ্জের ওসি আবু আক্কাশ আহমদ মানবজমিনকে বলেন, আমি তিন মাস আগে এ থানায় যোগদান করেছি। যোগদানের পর গত সেপ্টেম্বরের শেষে ডলার প্রতারণার শিকার এক ব্যক্তির মামলা নিয়েছি। প্রতারকচক্র সম্পর্কে আমি শুনেছি। তবে আমার থানার আওতাধীন পুলিশের ধাওয়া খেয়ে তারা পার্শ্ববর্তী দেবীগঞ্জে আশ্রয় নিয়েছে বলে জেনেছি। আপাতত প্রতারকচক্রের প্রতারণা ৮০% কন্ট্রোল হয়েছে। আমাদের অভিযান চলছে। কোনো অপরাধীকে প্রশ্রয় দেব না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) ডলার প্রতারকচক্র সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে বীরগঞ্জের ১নং শিবরামপুর ইউপি, ২নং পলাশবাড়ি ইউপি, ৩নং শতগ্রাম ইউপি, ৫নং সুজালপুর ও ১১নং মরিচা ইউনিয়নে প্রায় আটটি ডলার প্রতারকচক্র (আটটি গ্রুপ) নানা ধরনের অপরাধ ঘটিয়েছে এবং সক্রিয় রয়েছে। এসব ইউনিয়নে ডলার পার্টি নামে পরিচিত ডলার প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বীরগঞ্জে এসে লোকজন অনেক টাকাপয়সা খোয়াচ্ছেন। অনেক সময় শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হয় নিরীহ মানুষেরা। প্রতারকচক্রের কৌশলের মুখে প্রতারণার শিকার ব্যক্তি মামলা করতেও ভয় পায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এসব ডলার প্রতারক চক্রের নেতা মো. রশিদুল ওরফে গিট্টু রশিদ (৩৮)। সে দিনাজপুরের বীরগঞ্জের চাপাপাড়া গ্রামের মৃত আমিনুল শুকরুর ছেলে। প্রতারণার ভাগ নিয়ে বচসার কারণে গত ৬ই মার্চ তার বাড়িতে পুলিশ তল্লাশি চালায়। একটি খেলনা পিস্তল উদ্ধার করে। পরে ডলার প্রতারকচক্রের নেতা রশিদুল থানায় এসে বিষয়টি মীমাংসা করে। এরপর পুলিশের হয়রানি থেকে মুক্তি পায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডলার প্রতারক চক্রটি প্রায়ই একটি গল্প দাঁড় করায়। এরপর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষকে ডলার ব্যবসা, সবজি ব্যবসা, লিচু ব্যবসার নানা অজুহাতে লোভে ফেলে বীরগঞ্জে এনে টাকাপয়সা কেড়ে নেয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, ডলার প্রতারণার ঘটনাগুলো বিভিন্ন সময় ঘটলেও ঘটনাগুলোতে প্রায় একই রকম গল্প থাকে। ডলার প্রতারকদের অনেকগুলো দল রয়েছে। প্রতারকদের টার্গেট এলাকার মধ্যে রয়েছে- ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ। এসব এলাকায় তারা গিয়ে সাধারণত রিকশা চালায় বা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে। রিকশা চালাতে গিয়ে বা দিনমজুর হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বা কোনো ভদ্র লোক সেজে মেসে উঠে মনমতো লোক (প্রতারণার শিকার ব্যক্তি) পেয়ে গেলে তার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। এরপর কৌশলে ডলার দেখিয়ে তাকে লোভে ফেলে এবং বলে তার কাছে অনেক ডলার আছে। এসব ব্যক্তি সরল বিশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে এক সময় বীরগঞ্জ চলে যায়। প্রতারক একটি পূর্বনির্ধারিত ঘরে (আস্তানায়) নিয়ে ব্রিফকেস ভর্তি ডলার দেখায়। এরপর সরল বিশ্বাসে আসক্ত ব্যক্তিকে নানা কৌশলে আশ্বস্ত করে বলে, এ ডলারগুলো সে কুড়িয়ে পেয়েছে বা কোনো কৌশলে সংগ্রহ করেছে। এরপর প্রতারণায় আসক্ত ব্যক্তি পরে নগদে বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে হাজির হলে ভুয়া ডিবি পুলিশ সাজিয়ে গ্রেপ্তারের ভয় দেখানো হয় এবং তার কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেয় চক্রটি। এরপর একই চক্র নিজেদের গাড়িতে পার্শ্ববর্তী ঠাকুরগাঁও বা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে পার করে দেয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে বন্ধু সেজে সবজি ব্যবসা বা লিচু ব্যবসা বা অন্য কোনো ইস্যু দাঁড় করিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে এনে বীরগঞ্জে একটি ঘরে (আস্তানায়) ওঠায়। এরপর রাতের অন্ধকারে বন্ধুর ঘরে মেয়ে ঢুকিয়ে দেয়। এরপর মধ্যরাতে হ্যান্ডকাফসহ ডিবি পুলিশ (ভুয়া) হাজির হয়। তারা গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা বা চেকে লিখে বা বিকাশে বড় অঙ্কের টাকা আদায় করে। বীরগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডলার প্রতারকচক্রটি বেশ সংঘবদ্ধ। কারণ কাউকে চেয়ারম্যান হিসেবে সাজিয়ে বা কাউকে হ্যান্ডকাফসহ ডিবি পুলিশ সাজিয়ে প্রতারণা করে চলেছে তারা। প্রতারকচক্রটি প্রথমে ডিবি পুলিশের হাত থেকে রক্ষার জন্য চেয়ারম্যানের (সাজানো) দ্বারস্থ হতে বাধ্য করা হয়। এরপর টাকা দিয়ে নিজের জীবন নিয়ে নীরবে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। মানসম্মানের ভয়ে প্রতারিত ব্যক্তি মামলা করে না। ডলার প্রতারকচক্রের প্রতারণার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, থানা পুলিশের সঙ্গে প্রতিটি প্রতারণার ভাগ বিনিময় হয়। থানার শীর্ষ কর্মকর্তা প্রতিটি ছিনতাইকৃত টাকার ২০% ভাগ নিয়ে থাকে। কোনো মামলায় ভাগ না দিলে পরদিনই প্রতারকচক্র নেতাকে বা সদস্যকে পেন্ডিং মামলায় আটক করে। ফলে প্রতারকচক্রের খবরাখবর ঠিক সময়ে থানায় দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বীরগঞ্জ উপজেলার প্রভাবশালীদের ডলার প্রতারকচক্রের বিষয়টি জানা রয়েছে। কিন্তু পাছে কোনো বিপদে পড়ে যান এজন্য ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করে না। কোনো প্রতারিত ব্যক্তি থানায় অভিযোগ করতে গেলে তার অভিযোগ, জিডি বা মামলা নেয়া হয় না। বরং নিয়ে লোভে পড়ে এত দূরে যাওয়ার জন্য প্রতারণার শিকার ব্যক্তিকে তিরস্কার করা হয়। এদিকে বিশেষ প্রতিবেদনে ডলার প্রতারণার সঙ্গে জড়িত সদস্যদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রতারক চক্রের সদস্যদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া যায়। এছাড়া প্রতারণা চক্রের সদস্যদের সহায়তাকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া যায়। একই সঙ্গে থানা পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় এমপি, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নিয়ে কমিটি গঠনের মাধ্যমে ডলার প্রতারকদের এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে নির্দেশনা দেয়া যায়। পাশাপাশি অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা যায়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.