নিউ হ্যাম্পশায়ারে গত রোববার নির্বাচনী সমাবেশে বক্তব্য দেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন l
রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প রোববার গভীর রাতে ভার্জিনিয়ায় এক সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় ঘড়ি দেখিয়ে কিছু একটা বলছেন
প্রবলভাবে বিভক্ত নির্বাচন, শেষ মুহূর্তের জরিপে হিলারি ও ট্রাম্প সমানে সমান, হারলে ফল না-ও মানতে পারেন ট্রাম্প
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী, ব্যয়বহুল ও তিক্ত নির্বাচনী প্রচার শেষে আজ মঙ্গলবার ভোট গ্রহণ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা তাঁদের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি একটি নতুন কংগ্রেস ও সিনেটের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য নির্বাচন করবেন তাঁরা। প্রায় ১৫ মাস স্থায়ী নির্বাচনী প্রচার শেষে যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রবলভাবে বিভক্ত এক দেশ। একদিকে শ্বেত আধিপত্যের অবসানে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ রক্ষণশীল রিপাবলিকান সমর্থকেরা; অন্যদিকে জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের বাস্তবতা স্বীকার করে ডেমোক্র্যাটদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এক বহুজাতিক জোট। নতুন প্রেসিডেন্ট যিনিই হোন, এই বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রকে ফের জোড়া লাগানো হবে তাঁর প্রধান চ্যালেঞ্জ। প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হিসেবে রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট হিলারি ক্লিনটন উভয়েই অসম্ভব অ-জনপ্রিয়। দেশের ৬৪ শতাংশ মানুষ তাঁদের বিশ্বাস করেন না এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে অনাগ্রহী। নিজের প্রার্থিতার সপক্ষে হিলারি তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। ট্রাম্প বলেছেন ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের সাফল্য ও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কথা। ভাবা হয়েছিল যে হিলারি অনায়াসেই আনাড়ি ট্রাম্পকে ধরাশায়ী করবেন। কিন্তু সে কথা সত্য প্রমাণিত হয়নি। প্রথম দিকে পিছিয়ে থাকলেও নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে ট্রাম্প তাঁকে কার্যত ছুঁয়ে ফেলেছেন। কীভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হলো? ট্রাম্প ও হিলারি দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন যুক্তরাষ্ট্রের চিত্র তুলে ধরেছিলেন। দেশের সমস্যার সমাধানে তাঁদের প্রস্তাবও শুধু দলীয় সমর্থকদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। ট্রাম্প দাবি করেছেন, আজকের যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত, হতোদ্যম ও আশাহীন এক দেশ। মেক্সিকো থেকে চীন, পৃথিবীর ছোট-বড় সব দেশের ব্যবসায়িক ও সামরিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যর্থ। যুক্তরাষ্ট্র একসময় মহান ছিল, এখন আর নয়। অব্যাহত অভিবাসন, অসম বাণিজ্য চুক্তি ও দুর্বল সামরিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে নতজানু এক রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
ট্রাম্পের কথায় সায় দিয়েছেন এ দেশের শ্বেতকায়দের মধ্যে স্বল্পশিক্ষিত, কর্মজীবী ও শহরতলির মানুষ। গত চার দশকে অব্যাহত অভিবাসনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগত মানচিত্র ক্রমেই বদলে যাচ্ছে। অভিবাসনের চলতি ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪২ সালের মধ্যে এ দেশ একটি অ-শ্বেতকায় দেশে পরিণত হবে। এ দেশের সাদা মানুষেরা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই ধারা তিনি বদলে দেবেন, ট্রাম্পের এই প্রতিশ্রুতি তাঁদের উৎসাহিত করেছে।
স্বল্পবিত্ত শ্বেতকায়দের উদ্বিগ্ন হওয়ার অন্য কারণ ইরাক যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার শিকার। দেশের উৎপাদন শিল্প বেকায়দায়। লোহা ও কয়লার মতো খনিজ শিল্প প্রবল লোকসানের মুখে পড়ে প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এসব শিল্পে কর্মরত শ্বেতকায় শ্রমিকেরা একসময় ভালো বেতনে কাজ করতেন, নিজেদের মধ্যবিত্ত হিসেবে বিবেচনা করতেন। পেনসিলভানিয়া থেকে ওহাইও পর্যন্ত এক বিশাল এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই এখন কর্মহীন। ট্রাম্প এ জন্য দায়ী করেছেন ওবামা প্রশাসনের ব্যর্থ নীতি ও অসম বাণিজ্য চুক্তিকে। সেই কথায়ও তাঁরা বিশ্বাস করেছেন।
অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা কাটাতে ট্রাম্প দেশের সবচেয়ে ধনীদের জন্য বিশাল কর রেয়াতের প্রস্তাব করেছেন। পাশাপাশি দেশের অবকাঠামো উন্নতির জন্য বিশাল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একদিকে আয় কমবে, অন্যদিকে ব্যয় বাড়বে, এটা অবাস্তব জানা সত্ত্বেও ট্রাম্প-সমর্থকদের কাছে তিনিই সেরা প্রার্থী। ২০০১ সালের ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার পর মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষের জন্ম হয়েছিল, ট্রাম্প তাকেও উসকে দিয়েছেন। ইসলামি সন্ত্রাসবাদকে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রক্ষণশীল, বিশেষত ইভানজেলিক্যাল ভোটারদের কাছে টানতে ট্রাম্প নারীর গর্ভপাতের বিরোধিতা করেছেন এবং সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল বিচারপতি মনোনয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ট্রাম্প যেকোনো মূল্যে আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অধিকার রক্ষায়ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এই ট্রাম্পকেই নিজেদের ত্রাতা হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতকায়দের একটি অংশ। সংখ্যার হিসাবে এরা যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি নয়। এদের অধিকাংশ যুক্তরাষ্ট্রের সরকারব্যবস্থায় আস্থা হারিয়েছে। যে রিপাবলিকান পার্টিকে বিশ্বাস করে তারা কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণভার তাদের হাতে তুলে দিয়েছে, তারাও কথা রাখেনি। এখন ট্রাম্প নিজেকে একজন ‘বহিরাগত’ ও ‘অরাজনীতিক’ হিসেবে দেশের দায়িত্বভার নিতে চাইছেন। তিনি অগভীর, রাষ্ট্র শাসনে অনভিজ্ঞ, কর ফাঁকি দেওয়া ও যৌন আগ্রাসনের অভিযোগে অভিযুক্ত। তা সত্ত্বেও ট্রাম্পই তাদের কাছে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী।
অন্যদিকে হিলারি ক্লিনটন নিজেকে মধ্যপন্থী বারাক ওবামার উত্তরসূরি হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি আশাবাদী, নিজ শক্তিতে আস্থাবান ও ঐক্যবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বভার নিজে হাতে তুলে নিতে এগিয়ে এসেছেন। দেশের ক্রমবর্ধমান হিস্পানিক ভোটারদের কথা মাথায় রেখে অভিবাসন প্রশ্নে তিনি পাল্টা প্রস্তাব রেখেছেন, সীমান্ত এলাকায় কঠোর প্রহরার পাশাপাশি যে সোয়া কোটি অবৈধ লোক এ দেশে রয়েছে, তাদের পর্যায়ক্রমে নাগরিকত্বের সুযোগ করে দেওয়া হোক। বাণিজ্যের প্রশ্নে তিনি ট্রাম্পের মতো কিছু কিছু নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। যেমন ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ নামে পরিচিত বহুজাতিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের বিপক্ষে। তবে অর্থনীতির সব সুবিধা ধনীরা পাবেন—এই নীতির বিপক্ষে। নিজ দলের উদার ও বামপন্থী অংশের চাপে সবচেয়ে ধনীদের ওপর অতিরিক্ত করারোপ এবং মধ্যবিত্তদের জন্য বড় ধরনের কর রেয়াতের প্রস্তাব করেছেন তিনি। আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অধিকার সমর্থন করলেও তিনি বন্দুক থেকে অহেতুক মৃত্যু কমানোর লক্ষ্যে চলতি আগ্নেয়াস্ত্রনীতি সংস্কারের পক্ষে। গর্ভপাতের অধিকারসহ নারীর সমান শ্রমের জন্য পুরুষদের সমান বেতনের পক্ষে তিনি। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে ট্রাম্প অন্তর্মুখী, সে তুলনায় হিলারির বৈদেশিক নীতি অনেকে বেশি আগ্রাসী। যেমন মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসী গ্রুপ আইসিসকে দমন করতে হিলারি ‘নো ফ্লাই জোন’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছেন, যার ফলে সিরিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বাধার আশঙ্কা রয়েছে।
বিভিন্ন নীতিগত প্রশ্নে কিছু মতভেদ থাকলেও বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একমাত্র যোগ্য ও সবচেয়ে অভিজ্ঞ প্রার্থী হিসেবে হিলারিকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জুলাই মাসে ডেমোক্রেটিক পার্টির কনভেনশনে ওবামা বলেছিলেন, দেশকে বিভক্ত করার বদলে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম এমন একমাত্র প্রার্থী হলেন হিলারি। হিলারি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে যোগ্য, ওবামার এই যুক্তির সঙ্গে একমত দেশের অধিকাংশ পত্রপত্রিকা। নিউইয়র্ক টাইমস তাঁর প্রার্থিতা অনুমোদন করে লিখেছে, ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে হিলারি জনসেবার সঙ্গে জড়িত। নাগরিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যা গভীরভাবে অধ্যয়নের সুযোগ তাঁর হয়েছে, সেসবের সমাধানের পক্ষে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নিজ দলেই একা হয়ে পড়েছেন। তিন সপ্তাহ আগে ফাঁস হওয়া এক ভিডিও টেপে ট্রাম্প নিজে স্বীকার করেন, বিখ্যাত তারকা হওয়ায় যেকোনো নারীর সঙ্গে যৌন আগ্রাসনমূলক ব্যবহার করেও তিনি পার পেয়ে যান। এই টেপ ফাঁস হওয়ার পর থেকে রিপাবলিকান দলের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রী তাঁর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। দেশের অধিকাংশ পত্রপত্রিকাও তাঁর প্রার্থিতার তীব্র বিরোধিতা করে। নিউইয়র্কের ডেইলি নিউজ তাঁর প্রথম পাতায় এক দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে ট্রাম্পের বিরোধিতা করে লেখে, এই লোকটি ‘একজন মিথ্যাবাদী, চোর, মস্তান, প্রতারক, যৌন নিপীড়নকারী, বিকৃত মস্তিষ্ক ও বাগাড়ম্বরে পূর্ণ একজন মানুষ।’
হিলারি ও ট্রাম্পের মধ্যে এমন স্পষ্ট প্রভেদ সত্যেও আজকের ভোটের দিন তাঁরা কার্যত সমান সমান জনসমর্থন ভোগ করছেন। গত রোববার প্রকাশিত এনবিসি এবংওয়ালস্ট্রিট জার্নাল-এর সর্বশেষ জাতীয় জনমত জরিপ অনুসারে ট্রাম্পের তুলনায় হিলারি মাত্র ৪ পয়েন্টে এগিয়ে। ভুলের সম্ভাবনা বা মার্জিন অব এরর বাদ দিলে পরিসংখ্যানের হিসাবে তাঁদের জনসমর্থন কার্যত সমান সমান।
আজকের নির্বাচনে যিনিই বিজয়ী হোন, তাঁর সামনে থাকবে প্রবলভাবে বিভক্ত এক দেশ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, হারলে ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকেরা সেই ফল না-ও মানতে পারেন। ট্রাম্পের কোনো কোনো সমর্থক ‘বিপ্লবের’ হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন। রিপাবলিকান দল, যাদের হাতে এই মুহূর্তে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তারাও আগাম ঘোষণা দিয়েছে হিলারির পুরো শাসনামল তারা একের পর এক তদন্ত ও শুনানিতে কাটাবে।
এই গভীর আঁধারেও আলোর দ্যুতি রয়েছে। হিলারি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বিজয়ী হলে তিনি দেশের সব মানুষের, এমনকি যাঁরা তাঁর বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন, তাঁদেরও প্রেসিডেন্ট হবেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.