যে যাই বলুক না কেন, বাস্তব কঠিন সত্য হল ট্রাম্প এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। দুনিয়ার সবচেয়ে পাওয়ারফুল ব্যক্তি। আণবিক যুদ্ধ শুরু করার জন্য যে বোতামটিতে চাপ দিতে হয়, সেটা এখন তার হাতে। তিনি হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ করেছেন, হিলারি আইএস দমনের নামে ৩২টি দেশে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই আইএস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও বড় এক হুমকি। আইএসের মতোই একটি গোষ্ঠী আল কায়দা ৯/১১-এ খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিতেই তিন জায়গায় হামলা করেছে। এবং এই হামলায় প্রায় ৩ হাজার নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে। এই জঙ্গি সংগঠনগুলোকে ট্রাম্প কীভাবে মোকাবেলা করবেন?
মাত্র ৩ নভেম্বর, গত বৃহস্পতিবার যুগান্তরের ১ম পৃষ্ঠায় ‘উন্মাদ ট্রাম্প মনোনয়ন পেলেন কী করে’ শিরোনামে আমার একটা খাটো লেখা ছাপা হয়। কিন্তু আজ বুধবার বেলা সাড়ে ১২টায় দেখি ‘এই উন্মাদ ট্রাম্পই’ বলতে গেলে সারা দুনিয়ার মানুষকে বেকুব বানিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী পদটিতে নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। সকালে যখন প্রথম ইঙ্গিত পেলাম, ডোনাল্ড ট্রাম্প এগিয়ে আছেন হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে, তখন থেকে দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের মতো আমিও নানা রকমের ব্যাখ্যা খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু কোনো ব্যাখ্যাই সম্পূর্ণ মনে হচ্ছে না। ঠিক এই মুহূর্তে যে কঠিন সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হল, আমেরিকান ভোটাররা তাদের দুঃখ-কষ্ট, স্বার্থকেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রাধান্য দিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। ট্রাম্প শুরু থেকেই প্রথাবিরোধী কথাবার্তা বলে আসছেন। আর তাতেই মার্কিন ভোটাররা বিশ্বাস করেছে, প্রথাগত পদ্ধতিতে ভোট দিয়ে তাদের সমস্যাগুলোর তো সমাধান হল না। সুতরাং প্রথাবিরোধী ট্রাম্পের কথাবার্তায় বিশ্বাস রেখে ভোটাধিকার প্রয়োগে কতই বা আর ক্ষতি হবে।
মার্কিন ভোটাররা দেখেছে গত কয়েক বছরে ৭০ হাজার ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে, লাখ লাখ আমেরিকান বেকার হয়ে পড়েছে। এই বেকার সমস্যার কারণ হিসেবে ট্রাম্পের মতো তারাও বিশ্বাস করেছে, চীন ও মেক্সিকোর পণ্যসামগ্রী যেভাবে আমেরিকার বাজারে ঢুকছে তাতেই তাদের নিজেদের কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং ট্রাম্পের ঘোষিত সমাধানগুলোতে- যেমন চীন ও মেক্সিকোর সস্তা পণ্যসামগ্রীর অবাধ প্রবেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ- ট্রামকেই সমর্থন করা জরুরি।
এ বিবেচনাটা যে মার্কিন ভোটারদের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে তা এখন স্পষ্ট; সামনের দিনগুলোতে স্পষ্টতর হবে। ট্রাম্প শুধু যে ইলেক্টোরাল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন তা তো নয়। দেখা যাচ্ছে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত যতগুলো রাজ্যের ভোটগণনা করা হয়েছে তাতে ট্রাম্প ৫৪ মিলিয়ন আর হিলারি পেয়েছেন ৫৩ মিলিয়ন ভোট। ভোটাভুটির এ প্যাটার্ন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেশব্যাপী যে ট্রাম্পের প্রবল জনসমর্থন আছে তাও স্পষ্ট হল।
এ সাইলেন্ট মেজরিটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে বিপ্লবটা ঘটিয়েছে বলে মনে হয়। তরুণ জনগোষ্ঠীও মনে হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন প্রার্থী, হিলারির একজন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তরুণ জনগোষ্ঠীটি বার্নি স্যান্ডার্সকে তাদের আদর্শ-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পক্ষে একজন মডেল হিসেবে দেখেছিল। সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে আমেরিকার আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে অবস্থান ছিল এ তরুণদের। কিন্তু এ তরুণরাই মনে হচ্ছে আমেরিকার দূরবর্তী এতসব দেশে যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়াতে হিলারির ভূমিকাকেও দায়ী করেছে। এ তরুণ জনগোষ্ঠীর কত অংশ ট্রাম্পের পক্ষে গিয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়; তবে হিলারি ক্লিনটন তাদের তার পক্ষে টানতে সম্পূর্ণ সফল হয়েছেন বলে মনে হয় না।
আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমে লিবিয়া এবং দক্ষিণে ইয়েমেন- এ এলাকাটিতে অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা এবং রক্তপাত ঘটছে। এ যুদ্ধগুলোর খরচ মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছে; কিন্তু এত বছর পরও সমস্যাগুলোর কোনো সমাধান দৃশ্যমান নয়। অথচ এর বিপরীতে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই লাখ লাখ লোক দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। ২০০৮ সালে যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়টা ঘটল তাতে লাখ লাখ আমেরিকান মর্টগেজে তাদের বাড়িঘর হারিয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হল।
সাধারণ মানুষজনের এ আক্রোশ-ক্ষোভ প্রকাশ পেল ‘অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট’ আন্দোলনে। আন্দোলনে তারা সাফল্য পেল না ঠিকই; কিন্তু তাদের ক্ষোভটা তো প্রশমিত হল না।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে দাবি করে আসছেন। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, তিনি তার ব্যবসাকে যেমন লাভজনক করে তুলেছেন এবং সাফল্য দেখিয়েছেন, তিনি তেমনিভাবে যুক্তরাষ্ট্রকেও একটি সফল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবেন। তার স্লোগান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’। কিন্তু তার ব্যবসায়িক জীবনে তিনি যে কয়েকবার দেউলিয়াও হয়েছিলেন, তিনি তা উল্লেখ করেন না। তার চেয়েও বড় ভয়ানক তার এই দাবি; কারণ একটি রাষ্ট্র, তাও যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতাশালী দেশটিকে তিনি তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বড় লক্ষ্য থাকে লাভ বাড়ানো। কিন্তু একটি রাষ্ট্রকে কখনও কখনও ক্ষতি স্বীকার করেও সেবা দিয়ে যেতে হয়। উদাহরণ হিসেবে রাষ্ট্রের এক নম্বর দায়িত্ব হিসেবে নাগরিকদের জানমাল রক্ষা করাটা উল্লেখ করা যেতে পারে। সে জন্য সশস্ত্র বাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীকে এর সেবার বিনিময়ে বিশেষ কোনো দাম দিতে হয় না।
ট্রাম্প একজন ক্যাপিটালিস্টের মতোই কথাবার্তা বলে এসেছেন। উচ্চ বেতন এবং সুযোগ-সুবিধাধারীদের তিনি ট্যাক্স কমিয়ে নতুন নতুন ফ্যাক্টরি স্থাপনে উৎসাহী ও আগ্রহী করে তুলবেন, তার এই যুক্তিটি কখনও কখনও সঠিক হতে পারে, তবে সব সময় সঠিক নয়। মেক্সিকোর সীমান্তে মেক্সিকানদের আমেরিকায় প্রবেশ ঠেকাতে তিনি দেয়াল তুলবেন এবং এই দেয়াল তোলার খরচ মেক্সিকোকেই দিতে হবে, এমন উদ্ভট কথা যিনি বলতে পারেন তিনি আমেরিকার এখন সদ্যবিজয়ী প্রেসিডেন্ট। দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি চীনকে তিনি কীভাবে মোকাবেলা করবেন, চীন কি তখন শুধু তাকিয়েই থাকবে? তিনি কমিউনিজমের বিরুদ্ধে ইউরোপে সামরিক সংগঠন ন্যাটো থেকেও হয়তো বেরিয়ে আসবেন, এসব বড় প্রশ্নের সম্মুখীন এখন সারা দুনিয়া।
লক্ষ্য করার বিষয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প জীবনে কোনোদিন একটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বা কমিশনারও নির্বাচিত হননি। নিুতম কোনো নির্বাচনী পদে তিনি কোনোদিন প্রার্থীও হননি। কিন্তু তিনি যখন প্রার্থী হলেন, সেটি দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং এখানে তিনি বিজয়ীও হলেন। তার এই এন্ট্রি পোস্টে তিনি সাফল্য দেখিয়ে দুনিয়াটাকে একটি চমকও দিলেন। দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী ইংরেজি সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্ট থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলীয় পত্রিকাগুলো ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন রিপাবলিকান জীবিত দুই সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়র এবং জর্জ বুশ জুনিয়র এবং আরও কত কত সাবেক ও বর্তমান গভর্নর, সিনেটর এবং কংগ্রেসম্যান। হিলারি ক্লিনটন বারবার বলে এসেছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভাদিমির পুতিন একমাত্র রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান যিনি ট্রাম্পকে বিজয়ী দেখতে চেয়েছেন। পুতিন যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বল রাখার জন্যই এমন চেয়েছিলেন বলে অনেকেই বিশ্বাস করে।
যে যাই বলুক না কেন, বাস্তব কঠিন সত্য হল ট্রাম্প এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। দুনিয়ার সবচেয়ে পাওয়ারফুল ব্যক্তি। আণবিক যুদ্ধ শুরু করার জন্য যে বোতামটিতে চাপ দিতে হয়, সেটা এখন তার হাতে। তিনি হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ করেছেন, হিলারি আইএস দমনের নামে ৩২টি দেশে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই আইএস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও বড় এক হুমকি। আইএসের মতোই একটি গোষ্ঠী আল কায়দা ৯/১১-এ খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিতেই তিন জায়গায় হামলা করেছে। এবং এই হামলায় প্রায় ৩ হাজার নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে। এই জঙ্গি সংগঠনগুলোকে ট্রাম্প কীভাবে মোকাবেলা করবেন? মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে তিনি সারা বিশ্বে নিন্দিত। আমেরিকান ব্ল্যাক ও হিস্পানিকদের বিরুদ্ধেও তার অবস্থান স্পষ্ট। মহিলাদের বিরুদ্ধে তার একের পর এক নোংরা-অশ্লীল কথাবার্তা এবং যৌন হয়রানি ট্রাম্পকে সারা দুনিয়ায় উপহাসের বস্তু হিসেবে পরিণত করেছিল; কিন্তু তারপরও তো তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। এবং সেটাকে মেনেই দুনিয়াকে চলতে হবে। এখন ট্রাম্প দুনিয়াকে মেনে কতটুকু চলতে পারেন তা-ই দেখার বিষয়। ট্রাম্পকে মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র এতসব সম্পদ-শক্তি দিয়েও দুনিয়ার অনেক জায়গায় সফল হয়নি। এই সিরিজে সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণগুলোর কয়েকটি দেখা যায় আফগানিস্তান থেকে ত্রিপোলি পর্যন্ত দেশগুলোতে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.