মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বোদ্ধারা ডনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে বলছেন, আমরা এখন পর্যন্ত যা জানি তা ‘ভীতিকর’; আর এখনো যা জানি না হতে পারে তা আরো ভয়ঙ্কর। তারা বলছেন, ডনাল্ড ট্রাম্প এমন একজন প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট যার পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করার মতো প্রয়োজনীয় উপাদান এখনো আমাদের হাতে নেই। এ ছাড়া তার নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে প্রদত্ত বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে যে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে- সে উপায়ও নেই। কেননা, তিনি নির্বাচনের এক সপ্তাহ না যেতেই কমপক্ষে একডজন প্রধান প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছেন। ওবামাকেয়ার বাতিল, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ, মুসলিম অভিবাসন বন্ধ, সমকামী বিয়ে বাতিল কিংবা ন্যাটোর মতো নিরাপত্তা মিত্রদের নিকট থেকে ফি আদায়- এই সব প্রধান প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে ডনাল্ড ট্রাম্প পিছু হটেছেন। ডনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে এই প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে উইলসন সেন্টারের সিনিয়র ফেলো উইলিয়াম বি মাইলাম গতকাল উপরোক্ত মন্তব্য করেন। কেমন হতে পারে ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি? এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বি মাইলাম বলেন, ইটস টু আর্লি টু কমেন্ট। কেননা, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। তবে ট্রাম্প জমানার পররাষ্ট্র বিভাগে কারা কাজ করছেন সেটা জানা গেলে অন্তত আমরা ডনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কিছুটা আঁচ করতে পারবো। ‘ডনাল্ড ট্রাম্পের বাংলাদেশ নীতি কেমন হতে পারে, কোনো পরিবর্তন আসবে কি?’ এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম মাইলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মূলত স্টেট ডিপার্টমেন্টের এসিস্টেন্ট সেক্রেটারি লেভেলে তদারকি হয়। তাই প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি খুব দ্রুত পরিবর্তন হবে না। তিনি বলেন, তবে ডনাল্ড ট্রাম্প সেক্রেটারি অব স্টেট পদে মনোনয়ন নিশ্চিত করার পর এ বিষয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। রাষ্ট্রদূত মাইলাম আরো বলেন, নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেয়ার পর নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার পছন্দ ও সুবিধামতো নতুন এসিস্টেন্ট সেক্রেটারি নিয়োগ দেবেন। আর তখনই নতুন প্রশাসনের বাংলাদেশ বিষয়ক নীতি স্পষ্ট হবে।’ এদিকে প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্র বিভাগের দায়িত্ব কে পাচ্ছেন তা নিয়ে তুমুল জল্পনা-কল্পনা চলছে বিশ্ব মিডিয়ায়। এ বিষয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় যে নামগুলো ঘুরে ফিরে আসছে তাদের মতাদর্শ ও আনুগত্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে সেক্রেটারি অব স্টেট হওয়ার দৌড়ে এখন পর্যন্ত এগিয়ে রয়েছেন বুশ জুনিয়র আমলে জাতিসংঘে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি জন বোল্টন। এছাড়াও সম্ভাব্য তালিকায় রয়েছেন সিনেট কমিটি অন ফরেন রিলেশন্সের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং টেনেসি থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর বব কোর্কার এবং হাউসের রাজনীতিতে ২০ বছরের অভিজ্ঞ, প্রাক্তন রিপাবলিকান স্পিকার নিউট গিংরিচ। এর বাইরেও কেউ কেউ জুনিয়র বুশ আমলে আফগানিস্তান, ইরাক এবং পরবর্তীতে জাতিসংঘে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মুসলিম রাষ্ট্রদূত জালমেই খলিলজাদ, এবং পররাষ্ট্রনীতি গবেষণায় প্রথম সারির মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স’-এর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড হ্যাসের নাম সম্ভাব্য তালিকায় রাখছেন। আবার, এবিসি নিউজের সর্বশেষ তালিকায় সেক্রেটারি অব স্টেট্ হিসেবে জন বোল্টনের নামের সঙ্গে সঙ্গে নিউ ইয়র্কের প্রাক্তন মেয়র রুডি জ্যুলিয়ানির নামও রয়েছে। তবে সব বিবেচনায় এখন পর্যন্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে ডানপন্থি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট’-এর সিনিয়র ফেলো জন বোল্টনের আগামী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে হচ্ছে। ডনাল্ড ট্রাম্পের পরীক্ষিত আপনজন নিউ ইয়র্কের প্রাক্তন মেয়র ও ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের অন্যতম উপদেষ্টা রুডি জুলিয়ানি মিডিয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি মার্কিন বিচার বিভাগকে যতটা ভালো জানেন তিনি মনে করেন না আর কেউ তার মতো আছেন। তার এই মন্তব্য বিচারে তিনি মূলত অ্যাটর্নি জেনারেল পদের জন্য বেশি আগ্রহী বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় তাই অ্যাটর্নি জেনারেল পদে জুলিয়ানির সম্ভাবনাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এছাড়া পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড হ্যাসের মতামত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তিনি মূলত মাল্টিলেটারেল ডিপ্লোমেসি বা বহুপাক্ষিক কূটনীতির অধিকতর সমর্থক। শেষ পর্যন্ত ডনাল্ড ট্রাম্পের একলা চলো কেবিনেটে এসে তিনি কতটুকু সফল হতে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। এমনকি প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জালমাই খলিলজাদের বেলায়ও এমনটি মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। শ্বেতাঙ্গ ভোটবিপ্লবে নির্বাচিত ট্রাম্প সরকারের ইমেজ খলিলজাদের মুসলিম আইডেন্টিটি কতটুকু হজম করতে পারবে তা বিবেচনায় নিলে সেক্রেটারি অব স্টেট পদে খলিলজাদের সম্ভাবনাও কম বলতে হবে। অপরদিকে সেক্রেটারি অব স্টেট পদে উল্লিখিত নামগুলোর মধ্যে মধ্য-ডানপন্থি এবং অধিকতর প্রাগম্যাটিক হলেন প্রাক্তন রিপাবলিকান স্পিকার নিউট গিংরিচ। তবে তিনি নন-ক্যাবিনেট পোস্টে আগ্রহী বেশি। ডনাল্ড ট্রাম্পের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবেই নিউট গিংরিচ থাকার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার শর্তে তিনি সরে দাঁড়ান। কিন্তু নির্বাচনের পর গিংরিচ নিজেই ফক্স নিউজকে বলেছেন, ‘ফেডারেল সরকারের সংস্কারে তার কিছু নিজস্ব পরিকল্পনা রয়েছে, যা বাস্তবায়নে তিনি প্ল্যানার বা স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে কাজ করতে চান। ওই সাক্ষাৎকারে গিংরিচ বলেন, একসঙ্গে দুটি কাজ করতে গেলে মূল কাজ সংস্কারের বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’ তার এই মন্তব্যে ধরে নেয়া যায়, তিনি মূলত কোনো কেবিনেট পোস্টে থাকতে চান না। এদিকে রিপাবলিকান পার্টির একজন প্রভাবশালী কনসালটেন্ট এড রোলিন্স যিনি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন এবং ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনে ‘গ্রেট আমেরিকা’ সুপার প্যাকের কো-হোস্ট ছিলেন, তিনি সেক্রেটারি অব স্টেট পদে নিউট গিংরিচের মনোনয়নের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন, নিউয় গিংরিচ ভালো মানুষ সন্দেহ নেই, কিন্তু তিনি ওল্ড স্কুলের মানুষ যার একটি নিজস্ব ভিশন রয়েছে। নির্বাচিত হলে তিনি তার নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি ট্রাম্পের নামে চালিয়ে দেবেন। সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে ট্রাম্পের এমন একজনকে দরকার যিনি ট্রাম্পের নিজের নীতিকে এগিয়ে নেবেন এবং বাস্তবায়ন করবেন। সেক্রেটারি অব স্টেট পদের আরেক শক্তিশালী দাবিদার সিনেট কমিটি অন ফরেন রিলেশন্সের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং টেনেসি থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর বব কোর্কার। সিনেটর কোর্কার হলেন রিপাবলিকান পার্টির অভ্যন্তর থেকে প্রথম দিকে ডনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থনকারী প্রথমসারির নেতা। তিনি সমর্থন দেয়ার সময় থেকেই ট্রাম্প প্রশাসনে কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটিতে কাজ করার দরুন তিনি সেক্রেটারি অব স্টেট পদের দারুণ যোগ্যতম ব্যক্তি। কিন্তু বব কোর্কার সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায়ই প্রেসিডেন্ট ওবামা ইরানের সঙ্গে রিপাবলিকানদের মতে ‘বিতর্কিত’ নিউক্লিয়ার চুক্তি সম্পাদন করেছে, যা বব কোর্কার থামাতে পারেননি। রিপাবলিকানদের অনেকেই এ জন্য বব কোর্কার কে ‘লুজার’ বলে মনে করেন। আর কোনো লুজারকে যেন ট্রাম্প প্রশাসনে কেবিনেট দায়িত্ব দেয়া না হয় এ জন্য রিপাবলিকানদের একটি অলিখিত সমঝোতা রয়েছে, যদিও শেষ পর্যন্ত সবকিছু ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করবে। তবে সব বিবেচনায় এখন পর্যন্ত প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে ডানপন্থি থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট’-এর সিনিয়র ফেলো জন বোল্টনের আগামী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে হচ্ছে। ডনাল্ড ট্রাম্প নিজেই এই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বিগত আগস্ট মাসেই বলেছেন, জন বোল্টন আমার পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক মন্তব্যগুলো অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে ডিফেন্ড করেছে এবং তার যুক্তি ও আমার প্রতি সমর্থন ছিল অনেক অনেক শক্তিশালী।’ ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন ইতিমধ্যেই তাদের এক মন্তব্য কলামে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জন বোল্টনকে দেখার প্রস্তুতি নিতে বলছে বিশ্বকে। ন্যাশনাল রিভিউ ম্যাগাজিন নয়া মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জন বোল্টনকে ‘আইডিয়াল পিক’ বলে মন্তব্য করেছে। জন বোল্টন জাতিসংঘে ২০০৫-২০০৬ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিট রমণির পরররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টাও ছিলেন জন বোল্টন। জাতিসংঘে দায়িত্ব পালনকালে ‘জাতিসংঘ সদর দপ্তরের টপ টেন ফ্লোর না থাকলেও এর কাজ ভালোভাবেই চলবে’ বলে মন্তব্য করে তিনি বিশজুড়ে সমালোচনার ঝড় তোলেন। এ পর্যন্ত প্রকাশিত তার লেখা দুটি বই ‘সারেন্ডার ইজ নট এন অপশন : ডিফেন্ডিং এমেরিকা এট দ্যা ইউনাইটেড ন্যাশন্স’ (২০০৭) এবং ‘হাউ বারাক ওবামা ইজ এনডেঞ্জারিং আওয়ার ন্যাশনাল স্যুভরিনিটি (২০১০)-এর শিরোনাম পাঠেই জন বোল্টনের এগ্রেসিভ এবং এক্সেপশোনাল আমেরিকার পরিচয় মিলে। অবশ্য নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলাকালেই জন বোল্টন ডনাল্ড ট্রাম্পের ন্যাটো বিষয়ক মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন। সর্বশেষ দ্য উইকলি স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত প্রবন্ধে জন বোল্টন বলছেন, ইরান চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তো খারাপ হয়েছে বটেই, এমনকি তার মিত্রদের জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর হয়েছে। বৃটিশ দৈনিক ইনডিপেন্ডেন্টে গত পরশু প্রকাশিত কলামে জন বোল্টন বলছেন, প্রেসিডেন্ট রিগ্যান আমলের ডেমোক্রেটরা এবারের নির্বাচনে রিপাবলিকানদের ভোট দিয়েছে বলেই ডনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান প্রার্থী এবার ক্ষমতায় এসেছে।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.