বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় আড্ডার রাজধানীর নাম কি! তখন চোখ বন্ধ করে জবাব দেবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি। ইট-সুড়কির নগরী ঢাকা। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেনো একখণ্ড সবুজ চাদরে মোড়া উপত্যকা। এরই মধ্য দিয়ে ‘টিএসসি চত্বর’ ছুটে চলা উচ্ছ্বল ঝরনা। চতুর্দিকে নদীবেষ্টিত ঢাকা আজ কংক্রিটের নগরী। নগর জীবনের সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে বা জীবনের প্রাকৃতিক স্পন্দন পেতে যখন খুঁজে ফেরে একটু সবুজ-নির্মল পরিবেশ। তখন কেউবা ফিরে যেতে চায় অতীতের তারুণ্যের সোনালী দিনগুলোয়। কেউবা প্রিয়জনকে নিয়ে কিছুক্ষণ কাটানোর জন্য চলে আসেন টিএসসিতে। ১৯৫৭তে অঙ্কুরিত হয় টিএসসি। পাথেয় হিসেবে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তবে বীজ বপন হয়েছিলো তারও আগে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়ে একটি মিলন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ১৯৬১ সালে কার্জন হলের ক্ষুদ্র পরিসরে টিএসসি’র কর্মকাণ্ড শুরু হলেও ১৯৬৫ সালে এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। গ্রিসের বিশ্বখ্যাত নকশাকারী প্রতিষ্ঠান ‘ডকসিয়াডিস অ্যাসোসিয়েটস’ কনসালট্যান্ট লিমিটেড এথেন্সের নকশা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী টিএসসি কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শুরু করে। তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯৬৬ সালে। টিএসসির মূল কার্যক্রম শুরু হয় মূূূলত ১৯৬৭-৬৮ থেকে। টিএসসি এর পূর্ণরূপ ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (Teacher-Student Center)। অর্থাৎ ছাত্র-শিক্ষকদের মিলনমেলা। এর মাধ্যমে শিক্ষক-ছাত্রের মাঝে গড়ে ওঠে হৃদ্যতা। চিন্তার ভাগ-বাটোয়ারা। ফলে ছাত্রদের মাঝে সচল থাকে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। স্বপ্ন দেখে সোনালী ভোরের। ছাত্ররা অনেক সময় ক্লাসে শিক্ষকদের লেকচার গলধঃকরণ করলেও টিএসসির সবুজ চত্বরে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাচ্ছলে তার নির্যাসটুকু নিয়ে নেয়। জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন গঠনের জন্য প্রয়োজন তার বিকাশের জায়গা। স্কুল বা কলেজ পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী স্বাভাবিকভাবে শিক্ষকদের নৈকট্য লাভ করতে পারে না, মাঝখানে থাকে অলিখিত দেয়াল। সেই দেয়ালটি ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র-শিক্ষক হয়ে ওঠেন বন্ধু। আর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে ওই ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র বা টিএসসি। এখানে শিক্ষক তার অভিজ্ঞতার আলোকে পরামর্শ, উপদেশ দেন। শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকাশে সাহায্য করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো কোথাও ইউনিভার্সিটি সেন্টার, কোথাও ইউনিভার্সিটি ইউনিয়ন বিল্ডিং নামে পরিচিত। টিএসসি’র প্রথম পরিচালক ছিলেন প্রাণ-পুরুষ জামান খান। ১৯৯০ সালে তার মৃত্যুর পর থেকে আলমগীর হোসেন পরিচালক পদে আছেন। বর্তমানে টিএসসিকে কেন্দ্র করে প্রায় শতাধিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন সক্রিয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ বা ইনস্টিটিউটের অনুষ্ঠান যেমন আয়োজন করা হয় তেমনি বিভিন্ন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সেমিনারও এখানে অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ বিশেষ দিবসগুলোতে পুুরো শহরের গন্তব্য হয়ে ওঠে টিএসসি। পহেলা বৈশাখ, ইংরেজি নববর্ষ, বসন্ত উৎসব, শীতকালীন পিঠা-পুলি উৎসব, ভ্যালেনটাইন্স ডে অথবা মিউজিক ডে’র মতো যে কোনো অনুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র এ মিলনায়তন। এছাড়াও বিশ্বকাপ ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলা বড় পর্দায় দেখানোর ব্যবস্থাও করা হয় টিএসসিতে। টিএসসি কর্তৃপক্ষের নিজস্ব আয়োজন ছাড়াও এখানে প্রায় প্রতিদিনই অনুষ্ঠিত হয় কোনো না কোনো সংগঠনের নিজস্ব অনুষ্ঠানমালা। এদেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামের সুঁতিকাগার টিএসসি। এখানে রয়েছে নাটক, আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু সংগঠন হলো- সংবৃতা, কণ্ঠশীলন, আবৃত্তিশীলন, উদ্ভাসন, মুক্তধারা, দৃষ্টি, বাংলার মুখ, স্পন্দন, নাগরিক, নান্দনিক, আরণ্যক, ঢাকা পদাতিক, আইটি সোসাইটি, চলচ্চিত্র সংসদ, থিয়েটার, সড়ক প্রভাত ফেরিসহ অনেক সংগঠন। টিএসসির মূল ভবনের নিচতলায় রয়েছে জনতা ব্যাংকের ক্যাম্পাস শাখা, স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধনের অফিস, দ্বিতীয় তলায় চলচ্চিত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, ট্যুরিস্ট সোসাইটি, ফটোগ্রাফি ক্লাব, দাবা ক্লাব, ডিবেডিং সোসাইটি, রোভার স্কাউট, জয়ধ্বনি সংগঠন। স্বল্পপরিসরে এসব সংগঠনের অফিস সংকুলান না হওয়ায় শুধু সাইনবোর্ড দিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। এছাড়া চেয়ার নিয়ে টিএসসি চত্বর ও জনতা ব্যাংকের সামনেও কিছু সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। শিক্ষার্থীদের আনাগোনা শুরু হয় সকাল থেকেই। দুপুর এবং পড়ন্ত বিকালে তাদের কোলাহলপূর্ণ পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। এখানে বসে চলে হাসি-তামাশা, আড্ডা, গান, জন্মদিন পালন, গ্রুপ স্টাডি, একাডেমিক আলোচনা আরো কত কি। আর প্রেমিক-প্রেমিকার মনের গহিন কোণের লুকানো সব কথা উজাড় করে বলতে এর জুড়ি নেই। আড্ডা দিতে দিতে ক্ষুধা লেগে গেলে আছে টিএসসি’র ক্যাফেটেরিয়া। শুক্র ও শনিবার বাদে বাকি পাঁচ দিন এ ক্যাফেটেরিয়া খোলা থাকে। প্রতি বেলা ২০ টাকার বিনিময়ে এখানে পাওয়া যায় ডাল, আলু ভর্তা, সাদা ভাত এবং পোলাও-বিরিয়ানির মতো অভিজাত খাবার। এছাড়া, সকাল- বিকাল নাশতার পাশাপাশি রয়েছে কোমল পানীয়ের ব্যবস্থা। যে কারণে সারাক্ষণই এতে ভিড় লেগে থাকে। টিএসসি মিলনায়তন বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাড়া দেয়া হয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের অনুষ্ঠানের জন্য নামমাত্র মূল্যে ভাড়া দেয়া হয়। এছাড়া বাইরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক সংগঠনকে মিলনায়তন ব্যবহারের জন্য পূর্বানুমতি এবং নির্দিষ্ট ফি দিতে হয়। টিএসসিতে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে লাল ইট-সুরকিতে মোড়া সবুজ মাঠ। যার সীমানা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি গির্জা। ধারণা করা হয়, গ্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠাতা আরগিরি ১৭৭৭ সালে ঢাকায় পরলোকগমন করেন। ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ১২টি গ্রিক পরিবার ঢাকায় বসবাস করেছিলো। এদের উপাসনার জন্য ১৮২১ সালে গির্জা স্থাপিত হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যা টিএসসিতে ‘আরগিরি’ নাম ধারণ করে গ্রিকদের বাংলাদেশে একমাত্র স্মৃতি বহন করছে। বিকাল হলেই জমে উঠে সবুজ চত্বরটি। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়; এখানে সব শ্রেণির মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ে। মানুষের কোলাহলে এর চারপাশ মুখরিত থাকে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের প্রাণের জায়গা এটি। শুধুমাত্র আনন্দই নয়; এটি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-স্বপ্ন-সম্ভাবনা আর প্রগতিরও আবাসস্থল। ছোট্ট এ জায়গাটিতে কখনো কখনো প্রকম্পিত হয় মিছিল-স্লোগানে। আবার কখনো জমে ওঠে সংগীত আর কবিতার মিলনমেলায়। টিএসসির আড্ডা, অনুষ্ঠানমালা শানিত করে আমাদের প্রগতিকে। উজ্জীবিত করে আমাদের সংস্কৃতিকে। আর স্বপ্ন দেখায় আমাদের নতুন এক সূর্যোদয়ের। টিএসসি হলো তারুণ্যের এক উঠান। যে উঠান আমাদের গল্প শোনায় সম্ভাবনা আর স্বপ্নের।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.