কানাডার টরন্টোয় বাংলাভাষার প্রধান পাঁচজন কবির কবিতা নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে পঞ্চ কবির পঙ্ক্তিস্রোত শিরোনামে অনবদ্য এক আবৃত্তিসন্ধ্যা। এর আয়োজন করেছিল টরন্টোর আবৃত্তি সংগঠন বাচনিক। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ও শামসুর রাহমানের প্রতিনিধিত্বকারী, মেজাজ ও প্রভাব সঞ্চারী কবিতা থেকে বাছাইকৃত কবিতা দিয়ে আবৃত্তি পরিবেশন করে বাচনিক। গত ৫ নভেম্বর শনিবার এই আবৃত্তিসন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাচনিক ২০১৪ সালে যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ বিরোধী—শান্তির পক্ষে কবিতা শিরোনামে বাংলাভাষা ও বিশ্বের অন্যান্য ভাষার শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী কবিদের কবিতা নিয়ে আবৃত্তির অনুষ্ঠান করে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ২০১৫ সালে সংগঠনটি বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ কবিদের কবিতা থেকে বাছাইকৃত কবিতা নিয়ে আবৃত্তি অনুষ্ঠান করে আনন্দ ভৈরবী শিরোনামে এক অনুষ্ঠান। এই পরিবেশনা কাব্যমোদী ও সুধীজনের কাছে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়। এবার তারা উপহার দিল দেড় শ বছরের আধুনিক বাংলা কবিতা থেকে পাঁচজন প্রধান কবির কবিতা নিয়ে আবৃত্তির অনুষ্ঠান।
টরন্টো শহরের স্কারবোরো এলাকায় ৬০ রুয়েনা ড্রাইভে সিনেটর ও’কন্নর কলেজ স্কুলের অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় এই আবৃত্তিসন্ধ্যা। বিপুল কাব্যমোদী দর্শকদের সামনে মঞ্চে সাজানো পাঁচজন কবির প্রতিকৃতির সামনে সারিবদ্ধভাবে আবৃত্তিশিল্পীরা উপবেশন করেন। সুদৃশ্য রঙের শাড়ি ও পাঞ্জাবি পরিহিত আবৃত্তিশিল্পীদের পোশাক দর্শকদের সাধুবাদ অর্জন করে নেয় শুরুতেই। সন্ধ্যা ঠিক সাতটায় অনুষ্ঠান সঞ্চালক দেলওয়ার এলাহী শ্রোতা-দর্শকদের স্বাগত জানিয়ে বাচনিক সম্পর্কে দর্শকদের উদ্দেশে কিছু বক্তব্য রাখেন। এরপর অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অধ্যাপক ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে মঞ্চে আহ্বান জানানো হয়। বাচনিকের উপদেষ্টা কবি তুষার গায়েন তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করেন। দর্শকদের বিপুল করতালির মধ্যে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন বাচনিকের প্রধান সমন্বয়কারী আবৃত্তিশিল্পী মেরী রাশেদীন। এ সময় মঞ্চে আহ্বান করা হয় টরন্টোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উদারহস্ত পৃষ্ঠপোষক ও বাচনিক বন্ধু ব্যারিস্টার চয়নিকা দত্তকে। এরপর মেরী রাশেদীন, দেলওয়ার এলাহী, তুষার গায়েন ও চয়নিকা দত্তকে সঙ্গে নিয়ে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর প্রদীপ প্রজ্বলন করে পঞ্চ কবির পঙ্ক্তিস্রোত অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন শেষে তিনি বলেন, বাংলা কবিতার উচ্চারণ ও সংস্কৃতির চর্চা যত বেশি হবে, তত দূরে হটবে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা।
শুভ উদ্বোধনের পর পঞ্চ কবির পঙ্ক্তিস্রোতের অনুষ্ঠানের ভাবনা, নির্বাচিত কবিদের কাব্যদর্শন ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে সংক্ষিপ্ত অথচ আকর্ষণীয় বক্তব্য প্রদান করেন তুষার গায়েন। তাঁর বক্তব্যের পর পরই হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন সমবেত উচ্চারণের মাধ্যমে মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে আবৃত্তি শুরু করেন আবৃত্তিশিল্পীরা। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ও শামসুর রাহমানের রচনা থেকে বৃন্দ, একক ও দ্বৈতকণ্ঠের পরিবেশনায় একের এক পর এক কবিতা আবৃত্তি করে যান আবৃত্তিশিল্পীরা। কয়েকটি কবিতার আবৃত্তির সঙ্গে নৃত্য-পরিবেশনা কবিতাগুলোকে আরও আকর্ষণীয় ও মহিমান্বিত করে তোলে দর্শক শ্রোতার কাছে। মেরী রাশেদীন ও মেহরাব রহমানের দ্বৈতকণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনন্ত প্রেম কবিতাটি আবৃত্তির সঙ্গে নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন অরুণা হায়দার ও তাপস দেব। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা প্রবর্তকের ঘুর চাকায় বৃন্দ আবৃত্তির সঙ্গে নৃত্যে অংশগ্রহণ করে তাসনিম আহমেদ অর্ণি, শ্রেয়া সাহা ও নাজিয়া হক। জীবনানন্দ দাশের আবার আসিব ফিরে কবিতাটির বৃন্দ আবৃত্তির সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন অরুণা হায়দার। বাচনিকে অংশগ্রহণকারী আবৃত্তিশিল্পীরা হলেন; আসমা হক, আশরাফুন নাহার জলি, এলিনা মিতা, কাজী হেলাল, জাহানারা বুলা, জাহানারা চিনু, ফারহানা আহমদ, মেরী রাশেদীন, মেহরাব রহমান, রেজা অনিরুদ্ধ, রাশেদা মুনীর, সুমি রহমান ও হোসনে আরা জেমী। আবৃত্তির ধারাবর্ণনা পাঠ করেন মেরী রাশেদীন ও মেহরাব রহমান। অনুষ্ঠানের বিষয় ভাবনা ও গ্রন্থনা করেন তুষার গায়েন।
পঞ্চ কবির পঙ্ক্তিস্রোতের প্রতিটি কবিতার মেজাজ ও দৃশ্যকল্প অনুযায়ী আবৃত্তির সঙ্গে যন্ত্রসংগীতের ব্যবহার ছিল অসাধারণ। যন্ত্রসংগীত শিল্পীরা ছিলেন; বাঁশি ও তবলায় মামুনুর রশীদ, কিবোর্ডে মামুন কায়সার ও ভায়োলিনে এডওয়ার্ড মানিমারান ফিলিপ। শব্দ ব্যবস্থাপনায় ছিল গ্র্যান্ড প্যালেস। অনুষ্ঠানের আলোকচিত্র ধারণ করেন নাদিম ইকবাল ও মির্জা রহমান। স্থিরচিত্রের পাশাপাশি দৃশ্যধারণ (ভিডিও) করেন নাদিম ইকবাল। আলোক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন মোস্তফা হক। অর্থ ব্যবস্থাপনায় ছিলেন কাজী হেলাল এবং বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করেন আসমা হক, এলিনা মিতা, রেজা অনিরুদ্ধ, হোসনে আরা জেমী, মেরী রাশেদীন ও কাজী হেলাল। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সাহায্য করেন দুলাল হাবিব, প্রতিমা সরকার, মুক্তি প্রসাদ, রেখা হাবিব, মোস্তফা হক, ইত্তেজা আহমেদ টিপু, আনিনা তাহিন নেভিলা, রাকিব রাশেদীন, হাসমত চৌধুরী জুঁই, দেওয়ান মোতাহার, রিনি শাখাওয়াত ও সুস্মিতা সিনহা রায়। অনুষ্ঠানের আয়োজন, সমন্বয়, বৃন্দ পরিচালনা ও সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন মেরী রাশেদীন। এ অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটি সুদৃশ্য স্মরণিকা প্রকাশিত হয় যার সম্পাদনা করেন দেলওয়ার এলাহী। স্মরণিকার প্রচ্ছদ, অনুষ্ঠানের জন্য পোস্টার ডিজাইন এবং পঞ্চ কবির মেজাজ ও কাব্যভাবনা অনুযায়ী মঞ্চে কবিদের প্রতিকৃতির ডিজাইন করেন তুষার গায়েন। মঞ্চসজ্জা ও ব্যবস্থাপনায় ছিলেন দুলাল হাবিব ও মোস্তফা হক। অনুষ্ঠান শেষে বিজ্ঞাপনদাতা, শুভানুধ্যায়ী, স্বেচ্ছাসেবক ও দর্শকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন মেরী রাশেদীন। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন সঞ্চালক দেলওয়ার এলাহী। খবর বিজ্ঞপ্তির।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.