কথা বলার সময় কায় হ্লা অং-এর গলা কাঁপছিল। ‘এখানকার অবস্থা খুবই খারাপ,’ সিতওয়ের শহরতলীর একটি শিবিরের ভেতর বসে বলছিলেন তিনি। ৭৭ বছর বয়সী হ্লা অং রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা। সাবেক আইনজীবী। মিয়ানমারের সাবেক সামরিক জান্তা সরকারের আমলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বহুবার জেল খেটেছেন। নজরদারির সঙ্গে তিনি অভ্যস্ত। কিন্তু হøা অং বলছেন, এবার সব কিছু আলাদা। তার ভাষ্য, ‘সামরিক বাহিনী এসেছিল। তারা সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলছে অপরিচিত কাউকে যাতে এখানে না রাখা হয়।’ সন্দেহ এড়াতে বিভিন্ন শিবিরের রোহিঙ্গারা জড়ো হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে এসব শিবিরে আটক রাখা হয়েছে। অন্তত একটি গ্রামে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের নির্দেশ দিয়েছে বাড়ির চারপাশের বেড়া সরিয়ে ফেলতে। ভয় পাওয়ার অনেক কারণ আছে এখানে। কয়েক মাইল উত্তরে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলীয় মংডু শহরে সামরিক বাহিনী ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাত বাড়ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর প্রাণঘাতী কয়েকটি হামলার ফলে নতুন এই বিদ্রোহের সৃষ্টি। ধারণা করা হচ্ছে, এসব হামলার পেছনে রয়েছে প্রবাসী রোহিঙ্গারা। হামলার পরপর মারাত্মক দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে। দ্য গার্ডিয়ানের এক রিপোর্টে এমনটাই বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, সেনাবাহিনী ৯ই অক্টোবরের ওই লড়াইকে ‘বহিরাক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনটি সীমান্ত পোস্টে হামলায় ৯ পুলিশ ও ৫ সেনা সদস্য নিহত হয়েছে। সেনাবাহিনী ঘোষণা দিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বেসামরিক নাগরিকদের প্রশিক্ষণ ও সশস্ত্র করা হবে। এখন পর্যন্ত নিরাপত্তা অভিযানে কয়েক ডজন কথিত আক্রমণকারী নিহত হয়েছে। গত সপ্তাহান্তে, হেলিকপ্টার থেকে একদল মানুষের ওপর সেনাবাহিনী গুলি চালানোর পর ৩০ জনেরও বেশি মারা গেছেন। সেনাবাহিনী বলছে এ মানুষজন ছিল সশস্ত্র। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থা গোষ্ঠীগুলো বলছে, বেসামরিক রোহিঙ্গারাই বরং হতাহতের শিকার হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে নারী-পুরুষ ও শিশুরা বন্দুকের গুলিতে আহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কিছু স্যাটেলাইট থেকে ধারণকৃত ছবি প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, অনেক বাড়িঘর মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেক এলাকায় রোহিঙ্গা নারীরা সৈন্যদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছে। সেনারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী বলে বিবেচনা করে। তবে অনেকেই মনে করেন, মিয়ানমারে তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করছেন। রাষ্ট্রীয় মিডিয়াগুলোতে বলা হচ্ছে, ধর্ষণের অভিযোগ ভুয়া। এমনকি নিজেদের ঘরবাড়ি রোহিঙ্গারা নিজেরা পুড়িয়েছে বলে মিডিয়াতে দাবি করা হচ্ছে। বিদেশি সাংবাদিকদের এসব এলাকায় যেতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে দু’পক্ষের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য যাচাই করা খুবই কঠিন। সিতওয়ের রোহিঙ্গারা বলছেন, কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পর্কে তাদের কিছু জানা নেই। অনেকে মনে করেন, এটি সেনাবাহিনীর সৃষ্টি। এ বছরের শুরুতে অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সত্ত্বেও সেনাবাহিনী এখনো বিপুল ক্ষমতা উপভোগ করে। কিন্তু অনেকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, সংখ্যালঘুদের এ নির্যাতন সহ্যসীমা অতিক্রম করার দিকে যাচ্ছে। ফিজিশিয়ান্স ফর হিউম্যান রাইটসের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে অনেক কিছু নথিবদ্ধ করা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে ২০১২ সালের পর থেকে রাখাইন অঙ্গরাজ্যে যে চলাচল, ভূমি দখল, নজরদারি, চাঁদাবাজি হচ্ছে তাতে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। কায় হ্লা অং বলেন, ‘এখন এমন অবস্থা ও দুর্দশার মধ্যে ৪ বছর পার করেছে মানুষ। অনেক তরুণ তাদের কৈশোর ও যৌবন পার করছে কিছু না করেই।’ একে বিদ্রোহ মনে করেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, না। কিন্তু তারা কেবল যন্ত্রণাই ভোগ করছে আর করে যাচ্ছে। তাই তারা আর বইতে পারছে না। এক পর্যায়ে এ ক্ষোভ বিস্ফোরিত হবে।’ অক্টোবর হামলার কয়েকদিন পর এক বিবৃতিতে সরকার ‘চরমপন্থিদের’ একটি গ্রুপকে দায়ী করেছে, যার নাম আগে কখনও শোনা যায়নি। আকা-মুল-মুজাহিদীন নামে গ্রুপটির নেতা হাভিজ তোহার, যিনি পাকিস্তানি তালেবানের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন বলে দাবি করেছে সরকার। তবে অং সান সুচি এসব দাবিগুলো থেকে কিছুটা পিছু হটেছেন। তিনি বলেছেন, এসব তথ্যের ভিত্তিতে যা বলা হচ্ছে তা বিশ্বাসযোগ্য না-ও হতে পারে। এদিকে অনলাইনে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে অনেক তরুণ, বালকের হাতে অস্ত্র আর কিছু বন্দুক। ফেইথ মুভমেন্ট নামে একটি গ্রুপের পোস্ট করা ওই ভিডিওতে এদেরকে রোহিঙ্গা মুক্তিযোদ্ধা বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। টেরোরিজম রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস কনসোর্টিয়াম (ট্রাক)-এর বিশ্লেষকরা বলছেন, ১০ থেকে ২৭শে অক্টোবরের মধ্যে অন্তত ৭টি ভিডিও পোস্ট করা হয়েছে। কিন্তু কোনোটিতে আকা-মুল-মুজাহিদীন বা হাবিজ তোহারের নাম কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। তবে কিছু ভিডিওতে প্রধান হিসেবে উঠে এসেছে আবু আমার জুনোনি নামে এক ব্যক্তির নাম। ট্রাক-এর সম্পাদকীয় পরিচালক ভের্যান খান বলেন, ‘প্রত্যেক ভিডিওতে সশস্ত্র লড়াইয়ের আহ্বান জানানো হচ্ছে। অন্তত তিনটিতে জিহাদের আহ্বান জানানো হয়েছে।’ কিছু ভিডিওতে দাবির তালিকাও দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা জাতিগত অধিকার পুনর্বহালের দাবি রয়েছে। ইংরেজি ভাষার একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, তাদের গ্রুপ কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত নয়। কিন্তু আরাকানিজদের মৌলিক অধিকারের দাবিতে তারা লড়াই করছে। রাখাইন অঙ্গরাজ্যের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা টিন মং শিওয়ে বলেন, দেশজুড়ে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটি খুনের মামলা। যারা এসব করেছে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। যদি তারা মিয়ানমারে বসবাস করে, তাদেরকে অবশ্যই মিয়ানমারের সংবিধান অনুসরণ করতে হবে। তাদের জাতি যা-ই হোক না কেন।’ তবে রাখাইন স্টেটে বিচ্ছিন্নতাবাদ নতুন সমস্যা নয়। বিংশ শতাব্দির শেষদিকে উত্তর রাখাইনে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে অনেক মুসলিম আন্দোলন ছিল। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনও (আরএসও) রয়েছে। যদিও ২০০০ সালের পর থেকে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রবাসী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন একটি সোর্স একটি অডিও রেকর্ডিং-এর ট্রানস্ক্রিপ্ট পেয়েছে। গার্ডিয়ানের কাছে সরবরাহ করা ওই ট্রানস্ক্রিপ্টে একজন লোক বলেন, জড়িত লোকেরা শুধু ‘আরএসও’ নয়। এই লোকটি বিদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গা বলে ধারণা করা হচ্ছে। ৯ই অক্টোবরের হামলাকে বিশাল সফলতা বলেও ওই লোক উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এরা আমাদের লোক। আমাদের সিস্টেম ভালোই কাজ করছে।’ তিনি জোরারোপ করে বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ‘সাহায্য’ পাঠানো যাবে। তিনি বলেন, ‘তারা (সামরিক বাহিনী) আমাদের খুঁজেছে, অগ্রাহ্য করেছে, আমাদের মুসলিমদের কিছু নেই বলে আমাদের নীরব রেখেছে। ইনশাআল্লাহ, আমরা সফল হয়েছি।’ এদিকে ৯ই অক্টোবরের হামলার পর সরকারের বিবৃতি প্রকাশের কয়েকদিন পর মিয়ানমারে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বলেন, পাকিস্তানি যোগসূত্রের ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো ‘পদক্ষেপ নেয়ার মতো তথ্য’ নেই। সরকার কালিস নামে এক কথিত পাকিস্তানির কথাও উল্লেখ করেছে। রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারে বলেন, ‘পাকিস্তানি এ ধরনের নাম আমি পাই না।’ ইয়াঙ্গুনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক রিচার্ড হোর্সে বলেন, ‘আমি মনে করি এটার ওপর জোর দেয়া জরুরি যে, হামলাকারীদের উদ্দেশ্য পুরনো আরএসও বা অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মতো, সন্ত্রাসবাদীদের মতো নয়। হামলাকারীরা নিরাপত্তা বাহিনীকে টার্গেট করেছে, সাধারণ বেসামরিক মানুষ বা ধর্মীয় স্থাপনাকে নয়।’ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফোর্টিফাই রাইটসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ স্মিথও একমত। তিনি বলেন, ‘হামলাকারীরা সুসংগঠিত বা ভালো অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বলে মনে হয় না। এ দেশে কয়েক ডজন সশস্ত্র সংগঠন বা মিলিশিয়া রয়েছে। এদের তুলনায় এ নতুন গ্রুপটিকে ক্ষুদ্র মনে হয়।’ তিনি বলেন, ‘যদি সেনাবাহিনীর সঙ্গে দর কষাকষি করার এটি কোনো কৌশল হয় ও অন্যান্য জাতিভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর মতো সরকারের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়ার টেবিলে বসার কৌশল হয়, তাহলে এটি ভালো কৌশল নয়।’ তার ভাষ্য, ‘আমাদের আশঙ্কা সামরিক বাহিনী এখন উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশে নজিরবিহীন আক্রোশ ঝাড়বে। এটি রোহিঙ্গা অধিকারের পক্ষেও যাবে না।’ সিতওয়ে শিবিরে আটকে থাকা কায় হ্লা অং বলেন, সামরিক বাহিনীর সঙ্গে এক বৈঠকে রোহিঙ্গা নেতাদের সম্প্রতি ডাকা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের বলেছিলাম যে, সিতওয়েতে আমাদের মানুষজন এসবের সঙ্গে নেই।’ সেনাঘাঁটি ও তারকাঁটার বেড়ার পরই রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আবাস। কিন্তু এ পাশে সিতওয়ের শহরতলীর মুসলমানরা ভীষণ শঙ্কিত। এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘আমরা নিজেদের নিরাপত্তার দিকটি নিজেরাই করে থাকি।’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা রাতে ঘুমাচ্ছি না। আমরা সকালে ঘুমাই, সন্ধ্যায় উঠি। মংডু হামলার পর আমরা আশঙ্কায় আছি, কেউ হয়তো প্রতিশোধ নেবে আমাদের ওপর।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.