কোনকিছুই হারায় না সবকিছুই ফেরার আমন্ত্রনে থাকে। জানি না কথাটা কতটুকু সত্য। সকাল থেকেই কিছু স্মৃতি মনে পড়ছিল। তাই ভেতর থেকে দুটো লাইন বেরুলো। আর লিখে ফেললাম। সত্য না মিথ্যে তা না হয় লিখার পরেই দেখা যাবে। প্রায় বছর দশেক আগের কথা। তখন আমি ছোট। বাবা তখন আমের মৌসুমে প্রায়ই ট্রেনে চেপে খুলনা যাওয়া আসা করতেন। আর ফেরার পথে আমার জন্য ঈশ্বর্দীর খাজা আর বাঘা বাজারের গরম গরম মুগলাই নিয়ে আনতেন। খাজা আমার বরাবরই প্রিয়। বাবার কাছে তখন ট্রেনের কথা শুনতাম। আর যাওয়া আসার পথে ব্রিটিশদের করে দেওয়া জাফরী করা পাকশী ব্রিজের কথাও বলতেন। বাবার মুখে শুনে শুনে সেটা দেখার আগ্রহ জমে গেল। বাবাও অতি সহজেই কেন জানি রাজি হয়ে গেলেন। তারপর আমি, আম্মু, বাবা, বড়পা আর আমার কাজিন সবাই এক সাথে রওনা হলাম। আর সেদিন আমাদের জন্য বড় সারপ্রাইজ হল আমরা ট্রেনে যাচ্ছি কথাটা শুনে। ট্রেনে আমি এর আগে কখনো উঠিনি। বাসেই যেতাম। কিন্তু বাস দেখলেই আমার গা তখন ঘিনঘিন করত। আর বাবা ট্রেনে যাবার কথা বলাতে আমি আর লোভটা সামলাতে পারলাম না। আমরা সবাই তড়িঘড়ি করে বের হলাম। উদ্দেশ্য স্টেশনে যাওয়া। আমরা প্রায় আধাঘন্টা পয়াতাল্লিশ মিনিটের মত ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করলাম। আমি একটু পর পর বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে থাকলাম ট্রেন কখন আসবে। আর বাবার উত্তরটা অনেক সহজ ” এইতো বাবা আর একটু পরেই চলে আসবে”। আমি বললাম কোনদিক থেকে আসবে। বাবা বললেন পশ্চিম দিক থেকে। এরপর আমি আর আমার কাজিন স্টেশনের ঠিক পশ্চিম কোণে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু পরে একটা হুইসেল বেজে উঠল, আর সবাই কেমন সজাগ হয়ে উঠলো। কিন্তু বিষয়টা আমার কাছে বোধগম্য হল না। আমি বইয়ে পড়েছি ট্রেন আসার আগে নাকি হুইসেল দিতে দিতে আসে। কিন্তু সেই হুইসেলটা যে এতটা তীব্র তা এই প্রথম শুনলাম। ট্রেন এসে স্টেশনে দাঁড়ালো। লোকজন ভীড় ঠেলে ট্রেনের বগির সিট দখলে নিচ্ছে। বাবাও উঠলেন। তারপর সিট ধরে আমাদেরকে উঠালেন। একটু পরে ট্রেন হুইসেল দিয়ে যেতে শুরু করলো। আমি জানালার পাশে মুখদিয়ে বসে আছি। আম্মু একটু পর পর আমাকে সতর্ক করতে লাগলো। বাবা বললেন আমি দেখছি তুমি চুপ কর। ট্রেন যখন দ্রুতগতিতে যেতে শুরু করেছে তখন জানালা দিয়ে নির্মল বাতাস ভেসে আসছিল। মুহূর্তের মধ্যে একটা মজার জিনিস আমি লক্ষ্য করলাম। ট্রেনের দুপাশে ঘেরা বৃক্ষরাজিরা যেন পেছনের দিকে ছুটতে শুরু করেছে। আমি আপু আর আমার কাজিনকে জিনিসটা দেখালাম। আপু বললেন এটা এক ধরনের জড়তা। পরে আমি যখন ক্লাস নাইনে উঠলাম তখন পদার্থ বিজ্ঞানে পড়ে বিষয়টা বুঝতে পারলাম। দেখতে দেখতে যে কখন দুটো ঘন্টা ওপার হয়ে গেছে তা আমি টেরই পাইনি। বাবা বললেন, ” আমরা এসে গেছি। নামতে হবে। তারপর আমরা নামলাম। ট্রেন থেকে নামার কিছুক্ষন পরেই ট্রেন চলে গেল। পাকশী ব্রিজ হয়ে। আমি ঐ ব্রিজটার দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছি। মুহুর্তেই যেন বিলিন হয়ে গেল বিশালাকার ট্রেনটি। ভাবুক মনে দেখলে মনে হবে এক দানবীর ভু- গর্ভে মিলিয়ে যাচ্ছে ট্রেনটি। ওখানে বেশ কিছুক্ষন থাকার পর আমরা আসলাম ফেরি ঘাটে। তখনও লালন শাহ ব্রিজের কাজ শেষ হয়নি। তাই ফেরি ঘাট অবধি আমাদের হাঁটতে হল। আর হাঁটার সময় আমি আর আমার কাজিন মিলে এক লাইনে প্রায় শুয়াশো ট্রাক গুনলাম। সেই প্রথম জানলাম আমাদের খুলনা আড়তে পাঠানো আমগুলো এখানে এসে পঁচে। বুঝলাম ব্রিজটা হওয়া কতটা জরুরী। অবশেষে আমরা ফেরি ঘাটে পৌছলাম। সেখানে দেখলাম এক বিশালাকার পিচবোর্ড। বাবা বললেন এটা ফেরি। আমি বললাম এত্ত বড়। বাবা হেসে বলল, ” বড়ই তো হবে বাবা এক ফেরিতে যে ১৫- ২০ টা ট্রাক যায়। আমার বিশ্বাস হল না। তাই ফেরি ছাড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। দেখলাম ফেরি যখন ছাড়ে সেও ট্রেনের মত একটা হুইসেল দেয়। তারপর ধীরে ধীরে এগুতে থাকে। একসময় সবার চোখকে ছাপিয়ে বিলীন হয়ে যায়। বিষয়টা আমার কাছে বেশ লাগলো। আর এটা সবার মাথাতেই নেই যে সময়টা কেমন করে কেটেছে। লক্ষ্য করালাম দিনের সর্বময় অধিপতি তার কৃত কর্ম সাড়িয়া পশ্চিম দিগন্তে হেলিয়া পড়িয়াছে। বুঝলাম আমাদেরও নীড়ে ফেরার সময় হয়েছে। ধুর ছাই লিখতে লিখতে তো অনেক কথাই লিখে ফেললাম। তবে লিখা শুরুর প্রথম লাইনে যে দুটো কথা বলেছি এখন সেইখানটাই আসি। কেন জানি আজ সকাল থেকেই অতীতের এই ফেলে আসা দিনটার কথা মনে পড়ছিল। আর ভাবছিলাম অনেকদিন পরিবারের সাথে কোথাও যাওয়া হয় না। শেষ গিয়েছি ক্লাস নাইনে রংপুর ভিন্নজগৎ আর তাজহাট রাজবাড়ি দেখতে। হয়তো চাই না বলেই যাওয়া হয় না, হয়ে উঠে না। তাই ঐ লাইন দুটো লিখলাম- ” কোনকিছুই হারায় না সবকিছুই ফেরার আমন্ত্রনে থাকে। “
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.