দিনে হকার। সবজি, ফল ফেরি করে বিক্রি করে তারা। রাতে বদলে যায় চেহারা। ধারণ করে ভয়ঙ্কর রূপ। দিনের হকার রাতে হয়ে যায় ডাকাত। ডাকাতির টাকার একাংশ চলে যায় জঙ্গি কোষাগারে। এরকম পাঁচটি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছেন কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা। দীর্ঘ চেষ্টা চালিয়ে এসব গ্রুপের নয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা। তাদের মধ্যে আটজনই আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। সূত্রমতে, এ পর্যন্ত ডাকাতির মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা সংগ্রহ করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)’র জঙ্গি কার্যক্রমে প্রদান করেছে এই চক্র। তিন মাস্টার মাইন্ডসহ আটজনের স্বীকারোক্তিতে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। স্বীকারোক্তিতে তারা জানিয়েছে কীভাবে ডাকাতিতে জড়িয়ে যায়। এই টাকা কীভাবে ভাগবাটোয়ারা হয়। মূল হোতা হিসেবে জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আব্দুর রহমানের এক ঘনিষ্ঠজনের নাম এসেছে তাদের স্বীকারোক্তিতে। জেএমবি’র ওই সূরা সদস্যসহ জড়িত আরও ১০ জঙ্গি সম্পর্কে তথ্য পেয়েছেন কাউন্টার টেরোরিজমের কর্মকর্তারা। শিগগিরই অন্তত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন তারা। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছে তিন মাস্টার মাইন্ড আলমগীর ওরফে দরবেশ, কাওসার ওরফে কাশেম ও নাজমুল হাসান। কুমিল্লার দেবিদ্বার থানার ধামতি এলাকার মৃত কবির আহমেদের পুত্র জেমএমবির মাস্টার মাইন্ড নাজমুল হাসান তার জবানবন্দিতে রাজধানীর মহাখালী এলাকার একটি বাসায় ডাকাতির বর্ণনা দিয়েছে। জবানবন্দিতে জানিয়েছে, ডাকাতি শেষে বস্তাভর্তি টাকা, স্বর্ণালংকার সহযোগী কাউসার ওরফে কাশেমের বাসায় রেখে চলে যায় মাস্টার মাইন্ড আলমগীর ওরফে দরবেশ। ডাকাতির শেষ পর্যায়ের বর্ণনায় জবানবিন্দতে উল্লেখ করেছে, ‘আলমগীর ওরফে দরবেশ ও অপু আমাকে বলে চল এখন যাই। ঐ মহিলার হাত মুখ বান্ধা অবস্থায় রাইখা আমরা সবাই বাইর হইয়া যাই। পরে আমরা সবাই পায়ে হাইটা মহাখালীর সাততালা বাউন্ডারি বস্তিতে কাউসার ওরফে কাশেমের বাসায় যাই। তখন অপু ও আলমগীর দরবেশ ডাকাতি করা টাকা স্বর্ণালঙ্কারসহ চাইরটা বস্তা, চাইরটা অস্ত্র, রামদা, চাপাতি এইগুলো কাউসার ওরফে কাশেমের বাসায় রাইখা চইলা যায়। যাওয়ার সময় বইলা যায় যে জিয়া ভাইয়ের সঙ্গে কথা বইলা জানাইবো।’ এ বিষয়ে নাজমুল হাসান জবানবন্দিতে আরও বলেছে, ‘তখন জানতে পারলাম যে আমাদের ডাকাতির টাকা, স্বর্ণালঙ্কার এবং মূল্যবান মালামাল বিক্রি কইরা পাওয়া বেশির ভাগ টাকা জিয়া এবং হায়দার ভাইকে দিয়া দেয়। যে টাকাগুলো পুরাতন জেএমবি’র জঙ্গিবাদী কাজে খরচ করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের অনেকেই শুরুতে বিভিন্ন কারণে কারাগারে ছিল। সেখানেই পরিচয় হয় জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে। ওই সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে জেল থেকে বের হয়ে সম্পৃক্ত হয়ে যায় জঙ্গি তৎপরতায়। দুই পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে জঙ্গি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ার বর্ণনা দিয়েছে নাজমুল। জবানবন্দিতে বলেছে, ‘২০১৩ সালের জুন মাসে তেজগাঁও থানার একটি ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলখানায় গেছি। আড়াই বছর জেলে ছিলাম। জেলখানাতে আলমগীর দরবেশের সঙ্গে পরিচয় হয়। জেলখানা থেকে জামিনে বাইর হওয়ার সময় আলমগীর দরবেশ আমার মোবাইল নম্বরটা রাইখা দেয়। আলমগীর দরবেশ জেলখানা থেকে বাইর হওয়ার পর আমার সঙ্গে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করে। একদিন আলমগীর আমাকে ফোন দিয়া বলে হাতিরঝিলে দেখা করতে।’ নাজমুলের বর্ণানা অনুসারে আলমগীর ও তুষার নামে পলাতক জঙ্গির সহযোগিতায় তার থাকার জায়গা হয় মহাখালীতে। পরবর্তীতে বেশি টাকা আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে ডাকাতিতে জড়িত করে আলমগীর দরবেশ। থানা সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক নাশকতার একটি মামলায় ২০১৩ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিল নাজমুল। যদিও কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা পাননি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সিরাজগঞ্জের চৌহালী থানার বিনানই গ্রামের আবুল কালামের ছেলে কাউসার ওরফে কাশেম। ২০১৪ সালে রাজধানীর মহখালীর কলেরা হাসপাতালে ক্লিনার পদে চাকরি নিয়েছিল ভুয়া সনদে। বিষয়টি জানার পর কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করে তাকে। তারপর বিভিন্ন পণ্য ফেরি করে বিক্রি করতো। ওই সময়ে রুমমেটের মাধ্যমে আলমগীর দরবেশের সঙ্গে পরিচয় বলে জানায় কাউসার। এ বিষয়ে আদালতে তার জবানবন্দিতে কাউসার বলেছে, ‘আলমগীর আমার পরিবার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়। বলে, চলো কিছু কাজ করি। তুমি ভালো টাকা পাবে। গত কুরবানির ঈদের আগে বিকাল বেলা আলমগীর দরবেশ আমাকে ফোন দিয়ে মহখালী বাসস্ট্যান্ডে যেতে বলে।’ সেখানে আলমগীর দরবেশসহ সাত জন উপস্থিত ছিল জানিয়ে কাউসার বলেছে, ‘কীভাবে আমরা ডাকাতি করবো তা আলমগীর ও অপু সবাইকে বুঝিয়ে দেয়। সেন্টু, আবু বক্কর, বাছেদ ও রাশেদ বাসার নিচে থাকে। আমি অপু, আলমগীর ও নয়ন দ্বিতীয় তলায় যাই। অপু কলিং বেল চাপ দেয়। ভেতর থেকে একজন মহিলা দরজা খুললে আমরা সবাই ভেতরে ঢুকি। ভয় দেখিয়ে মহিলা ও তার মেয়ের হাত ও মুখ বেঁধে ফেলি। আমি জানালার সব পর্দা টানিয়ে দেই। একটি চাপাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। অপু ও আলমগীরের নিকট পিস্তল ছিল। আমরা ওই বাসা থেকে টাকা পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার নিই।’ ওই ডাকাতির ঘটনায় আলমগীর দরবেশ নিজেও স্বীকারোক্তি দিয়েছে। সে নিজে মালামাল লুট করেছে স্বীকার করলেও জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি এড়িয়ে গেছে। তেজগাঁও এলাকার একটি বাসায় ডাকাতির বর্ণনা দিতে গিয়ে গত ২৩শে অক্টোবর আবু বকর সিদ্দিক তার জবানবন্দিতে বলেছে, ‘ঘটনাস্থলে আমরা আটজন যাই। নয়ন, কাউসার, অপু, আলমগীর এই চরজন বাসার উপরে যায়। আমি রাশেদ, বাছেদ নিচে দাঁড়িয়ে থাকি। যারা বাসার ভিতরে ঢুকে ডাকাতি শেষে তারা নিচে নেমে যায়। আমাদের বলে চলে যাও।’ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার বিন্নাকুড়ির রাসতুল্লাহর পুত্র আব্দুল বাছেদ। বাছেদ দিনমজুরের কাজ করতো। হিমেল নামের পরিচিত জনের মাধ্যমেই সে ডাকাতিতে লিপ্ত হয় বলে জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে। সূত্রে জানা গেছে, বাছেদ ও রাশেদ দুই ভাই। তারা দুজনে একই সঙ্গে ডাকাতি কার্যক্রমে লিপ্ত ছিলো। গত ২রা জুন বনানী থানায় দায়েরকৃত ডাকাতি মামলায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে আলমগীর দরবেশ, কাওসার ওরফে কাশেম, নাজমুল হাসান নয়ন, রণি অনিক ওরফে ফজলুল হক। ২০শে অক্টোবর বনানী থানার অস্ত্র আইনে দায়ের করা মামলায় জবানবন্দি দিয়েছে কওাসার ওরফে কাশেম ও নাজমুল হাসান নয়ন। ১০ই অক্টোবর তেজগাঁও থানার একটি ডাকাতি মামলায় জবানবন্দি দিয়েছে আব্দুল বাছেদ, আবু বকর সিদ্দিকী, সেন্টু হাওলাদার, রাশেদ, নাজমুল হাসান নয়ন, কাশেম ওরফে কাউসার। সূত্র জানা গেছে, এরকম পাঁচটি গ্রুপের প্রতিটিতে পাঁচ-সাতজন সদস্য রয়েছে। আরও অন্তত ১০ জনকে সনাক্ত করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। গত ছয় মাসে ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে অন্তত ২০টি ডাকাতিতে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সিনিয়র সহকারী কমিশনার যায়েদ শাহরিয়ার বলেন, গত অক্টোবরে ডাকাতি ও জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত এই নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন এই জঙ্গি সদস্যরা। তারা স্মার্টফোনে বিশেষ একটি অ্যাপ ব্যবহার করে কথা বলতো ও চ্যাট করতো। নানা তৎপরতা চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা চালানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.