কথাসাহিত্যিক অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালের ৩০ আগস্ট বাংলাদেশের সাতক্ষীরায়। খুব অল্প বয়সে পরিবারের সঙ্গে চলে যেতে হয় তাঁকে পশ্চিম বাংলায়। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত ‘মেলার দিকে ঘর’ তাঁর প্রথম সাড়াজাগানো গল্প। বলা যায় এটি দিয়েই তাঁর লেখকজীবনের শুরু। প্রথম উপন্যাস ‘নদীর মানুষ’। রচনাকাল ১৯৭৮। সেই বছরই বের হয় প্রথম গল্প সংকলন ‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’। ‘স্বদেশযাত্রা’ নামক ছোটগল্পের জন্য ১৯৯৮ সালে পেয়েছেন সর্বভারতীয় ‘কথা’ পুরস্কার। তাঁর অনেক গল্পই মঞ্চে অভিনীত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা হলো- পিঙ্কি বুলি, দামিনী হে, পাসিং শো। ১৯৯৯ সালে লেখেন ‘অশ্বচরিত’। ২০০১ সালে এই উপন্যাসটি বঙ্কিম পুরস্কার লাভ করে। ‘ধ্রুবপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ২০০৬ সালে পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। ২০১৪ সালে দেশভাগ আর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস ‘দশমী দিবসে’। লিখেছেন ছিটমহলের বেদনা নিয়ে উপন্যাস ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’। বিশিষ্ট এই লেখকের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন অঞ্জন আচার্য।
বাংলাদেশে আসার প্রসঙ্গ দিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক।
অমর মিত্র : এবার মূলত রাজশাহী এসেছিলাম। সেখানে ‘কবিকুঞ্জ’ বলে একটি সংগঠন প্রতি বছর আয়োজন করে জীবনানন্দ মেলা। অগ্রজপ্রতিম লেখক হাসান আজিজুল হকের আহ্বানে ওই আয়োজনে যোগ দিতেই বাংলাদেশ আসা। সেখান থেকে ঢাকায়। ঢাকাতে দুটো জায়গায় আমাকে ঘিরে আয়োজন করা হয় দুটো অনুষ্ঠান। এক জায়গায় সাহিত্য আড্ডা হলো। অন্যটিতে ‘দেশভাগ’ নিয়ে একক বক্তৃতা দিলাম।
আপনার জন্মগ্রাম সাতক্ষীরার ধূলিহরের কথা শুনতে চাই। কেমন ছিল আপনার সেই শৈশব জীবন, ফেলে যাওয়া গ্রাম?
অমর মিত্র : ১৯৫১ সালের ৩০ আগস্ট ধূলিহর গ্রামে আমার জন্ম। ওই গ্রামকে আমরা ডাকতাম ধুরোল বলে। দেশ তখন ভাগ হয়ে গেছে। যতটা শুনেছি বা আমার অগ্রজ মনোজ মিত্রর লেখায় পড়েছি- বাবা ছিলেন ওই গ্রামের প্রথম বিএ পাস। ডিস্টিংশন ছিল তাঁর। আমাদের সেই গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করেন বাবা। সেই স্কুলে আমি ২০০০ সালে গিয়েছি। পরিচয় পেয়ে স্কুলের হেড মাস্টার মশায় স্কুলঘরে বসিয়ে আলমারি খুলে ১৯৩৮ সালের রেজিস্টার বের করে আমার বাবার স্বাক্ষর দেখিয়েছিলেন। ১৯৪৪-এ আমার বড়দা (মনোজ) এবং মেজদা (মেজকাকুর বড় ছেলে রণজিৎ) যে ওই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল এডমিশন রেজিস্টার খুলে তা দেখিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে আমি আমার জন্মের আগের পৃথিবীতে পৌঁছে গিয়েছিলাম যেন!
আমরা ছিলাম সাধারণ রায়ত। খুব বেশি জমি ছিল না। আবার তেমন অভাবও ছিল না। জমিজমার কিছুটা গিয়েছিল আমার ঠাকুরদা অন্নদাচরণ মিত্রের চিকিৎসায়। তিনি ছিলেন অসুস্থ মানুষ। অল্প অল্প মনে আছে ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাতনেতে রাখা নির্দিষ্ট চেয়ারে এসে তিনি বসতেন। বসেই থাকতেন। মাঝে মধ্যে মাছের খারা হাতে বাজারে যেতেন। বাজারটা কাছে পিঠেই ছিল। আমার তেমন কিছু মনে নেই। মনে আছে অনেকগুলি পুকুরের কথা, বাড়ির সামনে একটা বড় পুকুর, সেই পুকুরে জল ছিল না বেশি, পুকুরের ওপারে আমার ছোট কাকিমার মামার বাড়ি, ধর বাড়ি। মনে আছে, একবার ওই বাড়ির কেউ একজন বৃদ্ধ মারা গিয়েছিলেন।
মায়ের সঙ্গে আমি দেখতে গিয়েছিলাম। বাঁশের চালিতে শোয়ান রয়েছে মৃতদেহ। আর রোখ ছেড়ে কাঁদছে নানা বয়সের নারী। সেই কান্নার কথা মনে গেঁথে আছে আমার। ওটাই বোধ হয় প্রথম মৃত্যু দর্শন। কোন সাল হবে তা? চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন বোধ হয়। আর একটি কথা মনে আছে, সেই বয়সের কথা। একটি চার পাঁচ মাসের নষ্ট হয়ে যাওয়া ভ্রূণ আমি কার কার সঙ্গে গিয়ে যেন বাড়ির পিছনের বাগানে পুতে দিয়ে এসেছিলাম। আমি সঙ্গে ছিলাম। সে ছিল মেঘময় দিন। বাগানে বা বাদাড়ে ছিল বড় বড় মানকচু গাছ। মানকচুর পাতা হয় মস্ত। বর্ষায় এই পাতা মাথায় দিয়ে গরিব চাষাকে আত্মরক্ষা করতে দেখেছি। হ্যাঁ, ওই ভ্রূণ মাতৃগর্ভের আশ্রয়ে ন’মাস কাটাতে পারলে আমার একটি ভাই হতো। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম সেই মানুষের আকৃতি পাওয়া ভ্রূণটিকে। তখন ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যাওয়া আর শিশু মৃত্যু ছিল যেন সাধারণ ঘটনা। মায়েরা ছিলেন সর্বংসহা। আমার একটি দিদি ছিল, তাকে আমি দেখিনি। তার জন্য মাকে কাঁদতে দেখেছি। নাম ছিল ডিলডিল। আমার মা, আমার মেজদা উদয়ন বলতেন সে ছিল খুব সুন্দর। এপারে কলকাতার বেলেঘাটার বাসায় সে মারা গিয়েছিল ক’দিনের জ্বরে। আমার কেন তার কথা মনে নেই, আমি জানি না। আসলে পার্টিশন হওয়ার পর আমাদের পরিবার ঠিক করতে পারছিল না কোথায় থাকবে। ধূলিহরের সাতপুরুষের ভিটে ছিল, সাতক্ষীরে পার হয়ে সীমান্তের এপারে বশিরহাট শহরের লাগোয়া দণ্ডীরহাট গ্রামে জমি কেনা হয়েছিল কবে তা আমি জানি না। ধূলিহর খুব সাধারণ গ্রাম। কপোতাক্ষ ছিল কাছেই। কিন্তু আমি দেখিনি। দেখেছি সাতক্ষীরের নদী বেতনা। খালও হতে পারে তা। কিন্তু ঠাকুমা আর তাঁর বোনের সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম কুকরুলি গ্রামে। সেখান থেকে ফিংড়ি। আমি ছোটবেলায় যে গ্রাম দেখেছি, ২০০০ সালে সেই গ্রামে এসে তা দেখিনি। সম্ভব নয়। যা কিছু বড় মনে হতো, সব আমার খুব ছোট লেগেছিল। সেই মাঠ, পুকুর। ছেলেবেলাকে দেখতে যাওয়া ঠিক না। ছেলেবেলার মানুষ, ছেলেবেলার গ্রাম। আমাদের সেই গ্রাম ছিল নানা কাহিনিতে ভরা। তার একটি হলো ভূত। কতরকম ভূতের গল্প যে শুনেছি! আমার ঠাকুমা বানিয়ে বানিয়ে বলতেন। আমার মা হুবহু বলতেন তাঁর ছেলেবেলার কথা। স্টিমারের ভোঁ আর কপোতাক্ষ নদের কথা।
আপনার একটি স্মৃতিমূলক গদ্যে আপনি বলছেন– ‘আমার ছেলেবেলার সেই শান্ত কলকাতা অশান্ত হয়ে উঠতে লাগল। খাদ্য আন্দোলন। নকশাল আন্দোলনের ভিতর আমি বড় হয়েছি ভয়ে ভয়ে। আতঙ্কের ভিতর। কলেজজীবন, লিটল ম্যাগাজিন করা, করতে করতে চাকরি নিয়ে গ্রামে চলে যাওয়া, ভারতবর্ষকে দেখতে পাওয়া, জীবনের অন্য এক সঞ্চয়। লেখার ভিতরে ডুবে থেকে কখন যে এই বয়সে পৌঁছে গেছি জানি না। কিন্তু এখনো জীবন যে আরো কিছু দেবে তা আমি জানি। চার অধ্যায়, শৈশব কৈশোর যৌবন আর প্রবীনতা– এর বাইরে কত যে অধ্যায়, তার ঠিকানা নেই।’- এই যে সময়কে জন্ম নিতে দেখেলেন, কিংবা দেখলেন আমূল বদলে যেতে, এ সম্পর্কে জানতে চাই।
অমর মিত্র : কলকাতা আমার নিজের শহর। বেলগাছিয়া-পাইকপাড়া আমার নিজের পল্লী। আমরা ওপার থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষ। কলকাতা আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। এই পাইকপাড়া বেলগাছিয়া অঞ্চল হলো কলকাতার সেরা জায়গার একটি। এমন অবারিত সবুজ মাঠ, গাছগাছালি, মস্ত জলাশয়, এমন নির্জন পথ আর ভালো মানুষের বাস আর কোথায় আছে? এমন বড় বড় মানুষ কলকাতার কোথায় বাস করতেন? তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য… আমি কতজনের কথা বলব? কাজী নজরুল ইসলামের পায়ের ধূলিতে ধন্য হয়েছে এই এলাকা। আমি তাঁকে দেখিনি কিন্তু তাঁর পাশের মস্ত ফ্ল্যাট বাড়িটিতে পরম শ্রদ্ধেয় শিল্পী অন্নদা মুন্সি মশায়ের বাড়ির দরজায় এক সকালে কড়া নেড়েছি। বালকদের দেখে তিনি অবাক। হাসি মুখে ডেকে নিলেন ভিতরে। সেই প্রথম চিত্রকরের ঘরে প্রবেশ। রঙের ভিতরে প্রবেশ। তাঁর সেই ঘরখানিতে ছিল যেন রঙিন বাতাস। আমাদের বন্ধুর দাদা শ্যামল বরণ বালক লান্টু ওই ঝিলের জলে ডুবে গিয়েছিল ক’বছর আগে। তার নামে একটি পাঠাগার করব, শুধু ছোটদের বই থাকবে সেখানে, তিনি যদি একটি ছবি এঁকে দেন বা পোস্টার। তিনি তো এঁকে দিলেন, পয়লা বৈশাখের সকালে এসে উদ্বোধন করলেন সেই পাঠাগার। তিনি আমাদের সঙ্গে মিশে গেলেন বালকের মতো। সেই আমার প্রথম আড্ডা বড় মানুষের সঙ্গে। হ্যাঁ, আমি এঁদের দেখতে দেখতে বড় হয়েছি আমার ছেলেবেলার এই কলকাতায় এই বেলগাছিয়ায়।
স্কুলের বন্ধুরা গিয়েছিলাম অরবিন্দর সঙ্গে তার দাদা অনুপকুমারকে দেখতে। জানালা দিয়ে দেখছি তিনি বসে আছেন ভিতরে। এ হলো মহার্ঘ স্মৃতি। সিনেমার মানুষ পর্দা আর পোস্টার থেকে ঘরের ভিতর। বিস্ময় যে যায় না। হ্যাঁ, সুখ্যাত নট প্রেমাংশু বসুকে দেখতাম ফোলিও ব্যাগ হাতে মাঠ পার হয়ে যাচ্ছেন এক নির্দিষ্ট সময়ে। তিনি হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারে নিয়মিত অভিনয় করতেন। তাঁকেও তো সিনেমায় দেখেছি কত। আর একজনকে দেখতাম, আমাদের বাসাবাড়ি থেকে একটু ওপাশে থাকতেন। মস্ত দেহের অমর বিশ্বাস মশায়। তিনি উত্তম-সুচিত্রার সব ছবিতে থাকতেন ছোট একটি দৃশ্যে।
ইন্দ্র বিশ্বাস রোডে আমাদের বাসা বাড়ি, সেখানে মস্ত টালা পার্ক। আগে যার নাম ছিল জিমখানা গ্রাউন্ড। একটা সময়ে বেঙ্গল জিমখানা নামের একটি ক্লাব কলকাতার ক্রিকেট ও ফুটবলে যেকোনও একটি ডিভিশনে খেলত। আমি ক্লাস ওয়ান-টু পড়িনি, একেবারে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয়েছিলাম বেলগাছিয়ার মনোহর একাদেমিতে। তখন কলকাতার পাড়ার স্কুলগুলো ভালো ছিল। আমাদের স্কুলে ধনী-দরিদ্র একসঙ্গে পড়ত। আমার এক সহপাঠীর বাবা ছিলেন ছুতোর মিস্ত্রি, তাদের পদবী ছিল সূত্রধর। এক মেধাবী সহপাঠীর বাবা আইসক্রিম গাড়ি ঠেলতেন। সেই সহপাঠী পরে অনেক বড় চাকরিতে ঢোকে। ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেত সে। নকশাল বাড়ির আন্দোলনে জড়িয়ে গিয়েছিল, জেল খেটেছিল। সে খুব সম্ভবত ফিজিক্স নিয়ে পড়েছিল। সেই ১৯৮৩ সালে যখন আমি ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম গল্প লিখি, সেই গল্প পড়ে সে আমার বাড়ি এসেছিল একদিন সকালে। সে ছিল এক অমলিন শ্যামলা বালক, আমি স্কুলের কথা বলছি। আমাদের আর দুই সহপাঠীর বাবার মিষ্টির দোকান ছিল বাজারে। কিন্তু এখন বুঝি সেই দোকানটি ছিল বিষণ্ণতায় ভরা। পুঁজিপাটা ছিল না তেমন। এপাড়ার জলধর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কাছে দাঁড়াতেই পারত না। কিন্তু সেই দোকানের নিমকি আর হালুয়াতেই ছিল আমার অমোঘ আকর্ষণ। সেই মিষ্টির দোকান কবে উঠে যায় মনে নেই।
মনে পড়ে তার শো-কেসে কিছুই নেই, শুধু শূন্য গামলা আর পুরোন রসের তলানি। আমাদের সেই দুই সহপাঠীর একজন হয়েছিল ট্রাম কোম্পানির ড্রাইভার। আর একজনকে দেখতাম বাজারে সবজি নিয়ে বসত। ক্লাসের এক সহপাঠীর ছিল জাহাজ। তাদের মস্ত চারতলা বাড়ি। সেই বাড়ির গায়ে ধবধবে শাদা রঙ। সে আমার পাশে বসত। এক সহপাঠীর বাবা স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক। একজনের বাড়ি পাইকপাড়া যেতে মন্মথ দত্ত রোডে মস্ত জাহাজের মতো। বাড়িটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। এই সব বন্ধুদের কথা বলা মানে কত রকম ছেলেরা আমরা বড় হতাম একসঙ্গে তা বলা। আমি যখন বড় হচ্ছি, তখন উত্তাল কলকাতা। ১৯৬৫ থেকে ৬৮ খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন, নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহ। ঘরের ছেলেরা ঘর ছাড়ে। পুলিশি সন্ত্রাসে যে কতজন হারিয়ে যায়! কতজনকে পুলিশ নিয়ে গিয়ে মেরেই ফেলেছিল। নকশালবাড়ির আন্দোলন আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। আমি যখন লিখতে আরম্ভ করি, আমাদের সামনে ছিল রাজনৈতিক আন্দোলনে রাষ্ট্রযন্ত্র ভাঙার ডাক, শাস্ত্রবিরোধী লেখকদের গল্পের ফর্ম ভাঙার আন্দোলন, ক্ষুধার্ত পত্রিকার লেখকদের সব ঐতিহ্য অস্বীকারের অঙ্গীকার- আমাকে সব কিছুই প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু মনে হয়েছিল নিজের মতো করে নিজেকে তৈরি করতে হবে।
পড়াশুনা শেষে আপনার চাকরি জীবন নিয়ে কিছু বলুন।
অমর মিত্র : ১৯৭৪ সালে আমি গ্রামে গিয়েছি চাকরি নিয়ে। এপ্রিল মাসে আমাকে যেতে হলো মূল ভারতবর্ষে। কবছর আগে নকশাল আন্দোলনে আলোড়িত ডেবরা থানার এক গণ্ড গ্রামে। বাস থেকে নেমে কংসাবতী নদী পার হয়ে এক গ্রীষ্মের বিকেলে আমি বেডিঙ আর সুটকেস নিয়ে আমার হল্কা ক্যাম্পে পৌঁছলাম এক ঘণ্টা পনের মিনিট হেঁটে। চাকরিটা জরিপের কানুনগোর। সে ছিল প্রায় জনবিরল একটি আধপাকা বাড়ি। কাদামাটি আর ইটে গাঁথা দেওয়াল আর টালির চাল। ওইটি আসলে তহসিলদারের খাজনা আদায়ের কাছারি। দুটি ঘর আমার অফিসের জন্য। আমার সেই অফিস, সেই নির্জনতা, অধীনস্ত কর্মচারীদের সঙ্গে মেস করে থাকা, সকাল আর সন্ধ্যেয় অফুরন্ত অবসর নিয়ে আমি করব কী? গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমার বন্ধুতা হচ্ছে।
সেখানেই বসেই তো আপনার ‘মেলার দিকে ঘর’ গল্পটি লেখা, তাই না?
অমর মিত্র : হ্যাঁ। গ্রামটা ছিল খুব গরিব। আর খুব সাধারণভাবে বেঁচে থাকা সেই সব মানুষের। আমি এই জীবনের সঙ্গে পরিচিত নই। বিস্ময় আর বিস্ময়। কৌতূহলে কত কিছু জেনেছি। ধান আর মানুষ। আকাশের মেঘ আর মানুষ। ভয়ঙ্কর গ্রীষ্ম আর মানুষ। বর্গা চাষি, খেতমজুর, ভূমিহীন চাষি, খাজনা আদায়ের তহসিলদার। জমির প্রতি মায়া আর ভূমি-লিপ্সা, ভূমিক্ষুধা। আর নানা রকম বিপন্নতা। ১৯৭৪-এর সেই গ্রীষ্মে আমি একটি গল্প লিখি। নাম রাখি ‘মেলার দিকে ঘর’। তা ছিল সেই করন্ডা বা ওই রকম কোনও গ্রাম থেকে কংসাবতী নদীর দিকে গ্রীষ্মদিনে যাত্রা। বাবা ও মেয়ে চলেছে সেই যাত্রায়। বালিকা কন্যাকে মেলা দেখানোর নাম করে বেচতে নিয়ে যাচ্ছে বাবা সহদেব। সেই গল্প প্রকাশিত হলো ‘একাল’ পত্রিকায়। সেই গল্প প্রকাশের পর নানাজনের কথা শুনে মনে হয়েছিল লিখতে পারব। আত্মবিশ্বাস জন্মালো। ‘একাল’ পত্রিকা ছাপা হয়েছিল ৩০০ কপি। তা আর ক-জনের হাতে যাবে? গল্পটি পড়ে আমাকে কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় কবিপত্রে লিখতে বলেন। মূলত কবিতার পত্র, কবিপত্রে তখন গল্প লেখকদের একটা জায়গা ছিল। আমি কবিপত্রে পুজোয় লিখি ‘পার্বতীর বোশেখ মাস’। সেই সময়ে পরিচয় পত্রকায় একটি গল্প লিখি ‘শকুন্তলার জন্ম’ নামে। ১৯৭৫-এ কবিপত্র একটি গল্প সংখ্যা করে, সেখানে ‘মেলার দিকে ঘর’ আবার ছাপা হয়। এই গল্পেই প্রকৃত অর্থে ভারতবর্ষের দিকে আমার হাঁটা শুরু হলো। হাঁটছি এখনও।
আপনার ‘দশমী দিবসে’ উপন্যাসের শুরুর দিকের সেই কথাগুলি- “ঘুম থেকে উঠে দেখবে সব বদলে গেছে। খারাপ মানুষগুলোও ভালো হয়ে গেছে। মন থেকে উবে গেছে সমস্ত অন্ধকার। হ্যাঁ, ঘুম থেকে উঠে দ্যাখো মানুষ ভুলে গেছে ধর্মাধর্ম। সমস্ত সীমান্তের রেখা গেছে মুছে। ব্যাধ ভুলে গেছে নিপুন লক্ষ্য। মানুষ পেয়েছে পাখির স্বাধীনতা। ঘুম থেকে উঠে একদিন দেখো এমন হয়ে গেছে।”– এখানে আপনার লেখক মনের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বা বলতে পারি হয়ত এখানেই আপনি আপনার জীবনদর্শনকে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন। এ সম্পর্কে একটু বিস্তারিত শুনতে চাই।
অমর মিত্র : ‘দশমী দিবস’-এর ওই অংশটিতে আবেগ কাজ করেছে। আর আবেগ না থাকলে কি লেখা হয়? তবে তা যেন আবেগ সর্বস্ব না হয়। দেশভাগ এক বেদনাদায়ক সত্য। এর পিছনে অনেক কারণ আছে। সবচেয়ে বড় বেদনা– আমি বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, হাতিয়া দেখতে পারব না ইচ্ছা মতো। আমি যদি পেশোয়ার, করাচি, খাইবার গিরিপথ দেখতে পেতাম আমার উপন্যাস ধ্রুবপুত্র হয়তো আরও অন্যরকম হতো। দেশে দেশে সীমান্ত মানুষকে বন্দী করেছে এক অদ্ভুত ন্যাশানালিজমে। জাতীয়তা আমাদের পৃথিবীকে নষ্ট করেছে। বাংলাদেশ অন্যদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান অন্যদেশ। আমি স্বপ্ন দেখি বাহ্লিক দেশের। কোথায় আকশু নদী, আমুদরিয়া সিরদরিয়া, আমি তা এ জীবনে দেখব না। সে তো আফগানিস্তান পেরিয়ে। প্রাচীন পৃথিবীতে সীমান্ত ছিল না। পাসপোর্ট ভিসা ছিল না। তা থাকলে, ভাস্কো-দা-গামা, মারকো পোলোর পৃথিবীর কথা আমরা জানতে পারতাম না।
ইতালো কালভিনোর ‘ইনভিজিবল সিটিজ’ আমার প্রিয় উপন্যাস। কত নগর পরিভ্রমণ করেছেন মারকো, তা বিবৃত করছেন কুবলাই খানের কাছে। মহৎ লেখা। আর সেই উপন্যাসের নগরও কাল্পনিক সত্য। অন্তর্গত সত্য। আমার মনে হয় দেশ আলাদা না হলে, আমাদের অখণ্ডতা অনেক আশ্চর্য শিল্পের জন্ম দিতে পারত হয়ত। তবে এই বিষয়ে নিশ্চয়তা কিছু নেই। আমি যেখানে যেতে পারি না, তা আমার কল্পনায় আছে। দশমী দিবসে, ধনপতির চর, ধ্রুবপুত্র সেইভাবেই লেখা হয়েছে। আমার যে বেদনা দেশভাগে, তা আমার নয়। আমার মায়ের, বাবার, ঠাকুমা, ঠাকুরদার। তাঁদের বেদনাকে ধারণ করেছি আমি। আমি দেশভাগের পরে, ১৯৫১-য় জন্মেছি। আমার মা আমাকে তাঁর বাপের বাড়ি আর কপোতাক্ষ নদের কথা বলতেন। আমি তিন-চার বছর বয়সে কবে কপোতাক্ষ দেখেছি মনে নেই। তবে গ্রাম ধূলিহরের বাড়ি, উঠোন, পুকুর, সাতক্ষীরে শহরে বাবার মেজমামার বাড়ি- সব আবছা মনে করতে পারি। মনে হয় দেশটা একসঙ্গে থাকলে বেশ হতো। প্রকৃত ভূমি সংস্কারে ভূমধ্যাকারী হিন্দুর ক্ষমতা কমে আসত। ভূমিহীনে ভূমি পেত। যাই হোক, যা হয়েছে তা সত্য। সত্যকে অস্বীকার করা যায় না। তবে হিন্দুরা চলে আসায় কি গরিবে জমি পেয়েছে? মূল কারণ তো সিংহভাগ জমি হিন্দু জমিদারের আধীনে থাকা। ভূমি সংস্কারই ছিল এই অসমতা দূর করার উপায়। আমার মনে হয় সীমান্ত মানুষের পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে।
আপনার স্মৃতি থেকে দেশভাগের কথা, বেদনার কথা শুনতে চাই। ‘দশমী দিবসে’ উপন্যাসের প্রস্তাবনায় আপনি যেমন বলেছেন- ‘দেশভাগে সমস্ত দেশই হয়ে ওঠে বিদায়ঘাট’।
অমর মিত্র : সাগরদাঁড়িতে কবি মধুসূদনের বাড়ির সামনে কপোতাক্ষ। সেই কপোতাক্ষতীরে একটি জায়গা বিদায়ঘাট নামে চিহ্নিত। গ্রামবাসীরাই হয়তো ওই নাম দিয়েছেন। মধু হিন্দু বংশদ্ভূত, নিয়েছিলেন খ্রিস্টধর্ম। তাঁকে নিয়ে গর্বিত মুসলমান, হিন্দু, দুই ধর্মের মানুষই। তাঁরা বললেন, বিলেত যাওয়ার আগে খ্রিস্টান মধু এসেছিলেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সে-ই শেষ আসা। শেষ দেখা। যে ঘাট থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি, সেই ঘাটকে ওঁরা বিদায় ঘাট বলেন। কিন্তু এই কাহিনী সত্য নয় হয়তো। বিলেত যাওয়ার সময় মা জাহ্নবী বেঁচে নেই। তবে এই ঘটনা মাদ্রাজ যাওয়ার আগে হতে পারে। সেও তো কালাপানি পার। তখন জাহ্নবী মা জীবিত। মধুসূদন ফরাসি দেশে বসে কপোতাক্ষকে স্মরণ করেছেন। সেই অসামান্য কবিতা পড়তে গিয়ে আমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। মা-ও তো কলকাতার বাসাবাড়িতে বসে কপোতাক্ষকে স্মরণ করতেন। অনেক রাতে বুকের ভিতরে নিয়ে আমাকে চিনিয়েছিলেন বাপের বাড়ির সেই নদীকে। সব মিলিয়ে ‘দশমী দিবসে’। ওই দিনই তো মাতৃ বিসর্জন। দেশমাতৃকা বিসর্জন দেশভাগে। তবে এই উপন্যাসে মা তেমন নেই। আছেন যিনি তিনি মধুসূদনের নাতনি। কপোতাক্ষর প্রতি আমার ভালোবাসা আসলে আমার মায়ের, বাবার। আমার হারানো নদীর স্রোত গল্পে তা আছে।
উপন্যাসের বীরাঙ্গনা দাসীকে কোথায় পেয়েছিলেন? নাকি আপনার কল্পনার সৃষ্টি?
অমর মিত্র : বীরাঙ্গনা আমাদের আত্মীয়া। তিনি মধুসূদনের দূরের কোনও সম্পর্কের নাতনি ছিলেন। মানকুমারী বসু তাঁর পিসিমা। ওপারে সব ফেলে রেখে এপারে মধুর কথা নিয়ে এসেছিলেন। তিনিই আমাকে মধুর কথা বলতেন আমার যখন সাত-আট বছর। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য থেকে আবৃত্তি করতেন। অনেক সর্গ তাঁর স্মরণে ছিল। তাঁকে নিয়েই এই উপন্যাস। লিখতে হলে কল্পনা করতেই হয়। বীরাঙ্গনাকে আমি অনেকটা নির্মাণও করেছি।
উপন্যাসটিতে বারবার আপনি নদীর কথা বলছেন! আপনার নিজের কোনও নদী আছে চোখ বন্ধ করলেই যার জলতরঙ্গ শুনতে পান?
অমর মিত্র : নদীর প্রসঙ্গে নতুন কথা আর কী-ই বা আছে? নদীর কূলেই তো সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। কথিত আছে- সরস্বতী নদীর তীরে বৈদিক সভ্যতা। ছোট বড় কত নদী। নদী শুকোলে সভ্যতার পতন হয়। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ (অদ্বৈত মল্লবর্মণ) আছে তা, কাঁদো নদী কাঁদো (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্) উপন্যাসে আছে তা। নদী নিয়ে কত মহৎ উপন্যাস লেখা হয়েছে। ধীরে বহে দন, পদ্মা নদীর মাঝি, তিস্তা পারের বৃত্তান্ত, তিস্তা পুরাণ, গঙ্গা (সমরেশ বসু)- এমনি অনেক। আমার নদী বলতে প্রায় না দেখা কপোতাক্ষ, তাকে আমি ফেলে এসেছি, কিন্তু আন্দাজ করতে পারি। ‘দশমী দিবসে’ উপন্যাসের বীজ সাগরদাঁড়িতে কপোতাক্ষ তীরে বসেই পেয়েছিলাম। আমার মা আমাকে কলকাতায় বসে চিনিয়েছিলেন এই নদী।
আপনি সাধারণত কোথায় লিখেন বেশি? বাণিজ্যিক পত্রিকায় নাকি লিটল ম্যাগাজিনে? এখনকার লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের কী অবস্থা?
অমর মিত্র : আমি লিটল ম্যাগাজিন থেকে বিগ ম্যাগাজিন সব জায়গায় লিখেছি। এবং তাই-ই লিখি। এখনও বারোমাস, অনুষ্টুপ, পরিচয় পত্রিকার আমি লেখক। নিজের ভালো লাগা লেখাটিই সেখানে লিখি। এইসব পত্রিকায় আমার ভালো গল্পগুলিই ছাপা হয়েছে। কিন্তু বড় পত্রিকা যে বলেছেন, আমি লিখেছি। আমি আমার লেখাটি লিখতে চাই, সুতরাং লিখেছি।
লিটল ম্যাগাজিনের আন্দোলন তেমন কই? ভালো ম্যাগাজিন আছে অনেক। লিখে সম্মানিত বোধ করি, এইটুকুই। আর শুধু লিটল ম্যাগাজিনে লিখবই বা কেন, বড় পত্রিকায় লিখে অনেক দূর পৌঁছনো যায় তো। অনেকেই বলেন এইসব (শুধু ব্যতিক্রম সুবিমল মিশ্র), কিন্তু লিখতে বললেই লেখেন। কমলকুমার মজুমদারও ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখেছেন, দেবেশ রায়, শ্যামল- সবাই। আমিও। লিখতে বললে লিখেছি। তবে আমাদের লেখালেখির যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা তার সবই লিটল ম্যাগাজিনে। আর ‘প্রতিক্ষণ’ নামের যে পত্রিকাটি গত শতকের আশির দশকে প্রকাশিত হতো, সেই পত্রিকার আনুকূল্যই বেশি পেয়েছি আমি। উপন্যাস এবং গল্প লিখেছি। তা ছাড়া প্রতিক্ষণ-এ দীর্ঘদিন আড্ডা মেরেছি দেবেশ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, কখনও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সবই কাজে লেগেছে।
লিখতে গিয়ে কি সাধারণত পাঠকের কথা ভাবেন?
অমর মিত্র : আমি নিজের কথা ভেবে লিখি। নিজের ভালো লাগার উপরে অনেক কিছুই নির্ভরশীল। পাঠকের কথা ভেবে লেখা হয় না। কিন্তু নিজের তৃপ্তি হলে, পাঠকের কাছে পৌঁছনো যায়, তা আমি দেখেছি।
এই যে দেশভাগ, এই দেশত্যাগ এ সম্পর্কে আপনার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানতে চাই
অমর মিত্র : দেশভাগ, দেশত্যাগ নিয়ে আমি তো বলেছি। আমি তো চাই সীমান্তরেখা উঠে যাক। এই কথা দশমী দিবসে উপন্যাসে আর অনেক গল্পে আছে। নতুন করে কী বলব!
ছোটোগল্পের জন্য আপনি ১৯৯৮ সালে পেয়েছেন সর্বভারতীয় কথা পুরস্কার। এটাই কি আপনার লেখক জীবনের প্রথম পুরষ্কার?
অমর মিত্র : এর আগে সমরেশ বসু পুরষ্কার ও সমতট পুরষ্কার পেয়েছিলাম।
আপনি সাহিত্য আকাদেমি পেয়েছেন, বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন। আপনার কাছে জিজ্ঞাসা, প্রকৃতপক্ষে একজন লেখকের জীবনে পুরস্কারের কী ভূমিকা থাকে? পুরস্কার আসলে লেখককে কী দেয়?
অমর মিত্র : কিছুই না, আবার অনেক কিছু দেয়। আত্মবিশ্বাস দেয়। সমস্ত অপমান ধুয়ে দেয়।
সেই চিরায়ত প্রশ্ন, ‘কেন লেখেন’?
অমর মিত্র : কেন লিখি জানি না। এইটা পারি বলে লিখি। না পারলে লিখতাম না। আবার এও মনে হয় না লিখতে পারি না তাই লিখি। প্রতিদিন একই সময়ে লিখতে বসা আমার অভ্যাসের অন্তর্গত হয়ে গেছে এতটাই যে, না লিখে ওই সময়ে আমি করবই বা কী? আমার ঘুম ভাঙে অতি প্রত্যুষে। এই অভ্যাস আমার বহুদিনের। তখন থাকে অন্ধকার। একটা বুড়ো কাক জাগে, তার সঙ্গে জাগি আমি। বহুদিন আগে তখনই মুখ হাত ধুয়ে স্টোভে চা করে লিখতে বসা হতো। শীতের সময় আলো ফুটত না। গরমে ফর্সা হয়ে যায়। এখনো সেই সময়ে উঠি, গান শুনি একা বসে। ভৈরবী কিংবা টোড়ী, উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বড়ে গুলাম আলি থেকে কিশোরী আমনকর, রসিদ খান, যাঁর হোক। বিলায়েত খাঁ সায়েব বা আমজাদ আলি খাঁ সায়েবের সেতার কিংবা সরোদ, বা চৌরাশিয়ার বাঁশি, যাই হোক। তারপর একটু প্রাতঃভ্রমণ। ফিরে এসে লিখতে বসা। সকালের এই যে শিডিউল, এর অন্যথা হবার উপায় নেই। এর ভিতরে এক অদ্ভুত সুখ আছে। সেই সুখ আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সকালের গান শোনা, চৌরাশিয়ার বাঁশিতে নদীর ছলচ্ছল শোনা (সং অফ দ্য রিভার), তারপর উষাকালে পৃথিবীর ফুটে ওঠা প্রত্যক্ষ করে বাড়ি ফিরে আমার লেখার টেবিলে, এখন কম্পিউটারের সামনে এসে বসা, লিখতে আরম্ভ করা, এর কোনো বিকল্প আমার সামনে তৈরি হয়নি। তাই লিখি।
আমার সকাল, আমার দিনারম্ভ আরো আরো মধুর করে তোলার জন্য আমার লেখা। সেই লেখাটা সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে বারো-একটা অবধি চলে। মাঝে ঘণ্টা দেড় বাদ যায় নানা কাজে। তার ভিতরে বাজারও আছে প্রত্যহ। না লিখলে আমি করতাম কী? ভাবতেও পারি না। না লিখলে হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার ভূপালী কি আমার শোনা হতো? লেখার টানেই তো ভোরবেলা কিংবা শেষরাতে ওঠা। লেখাই আমার ঘুম ভাঙায়। যে উপন্যাস লিখছি বা যে গল্পের কথা ভাবছি, কিছুটা লিখেছি, তা আমাকে টানতে থাকে ঘুমের ভিতরে। সুতরাং না লিখে উপায় নেই। আমার আর কিছু করার নেই।
থাকি পুরনো ফ্ল্যাট বাড়িতে, আমার নিজস্ব কোনো বাগান নেই যে সকালে উঠে বাগান পরিচর্যা করব। দেখব কোন গাছে ফুল ফুটল কোন গাছে ফুটল না, আম গাছটিতে বোল এল কিনা। আমার কোনো পোষ্য নেই যে তার পরিচর্যা করব। লেখা ব্যতীত আমার আর কিছু নেই, তাই লিখি। বাড়ি নেই গাড়ি নেই অপরিমেয় অর্থ নেই, আছে শুধু লেখার অপরিসর টেবিলখানি আর বই। তাই লিখতেই হয় আমাকে। না লিখলে আমার আর কিছু করার নেই। লিখতে বসে আমি নিজের কথা বলতে পারি, তা অন্য সময় বলা যায় না। লিখতে বসেই লেখক অনন্ত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন। কোনো সমঝোতা নয়। যতদিন তেমন, ততদিন লেখা। লিখে আনন্দ।
সেই আরম্ভের দিনেও হয়তো এইটি একটি কারণ ছিল। একা থেকেছি অন্তঃগ্রামে, বন্ধু স্বজন বর্জিত সেই জীবন ছিল খুব মন খারাপের। আর বিস্ময়েরও। নিঃসঙ্গতা কাটাতে লেখা ছাড়া অন্য কোনো অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। অতি প্রত্যুষে ওঠার অভ্যাস সে গ্রামে বাস থেকে। কত সময় ছিল হাতে। সময় ব্যয় করতে কাগজ কলম নিয়ে বসা। সেই অভ্যাস চলছে। বিস্মিত হওয়ার নানা অনুষঙ্গ এখনো আছে। তাই লেখা থামেনি। জীবনের নানা বিস্ময় আমাকে লিখিয়ে নেয়। তাই লিখি। লিখতে ভাল লাগে তাই লিখি। লিখলে জীবনকে সতেজ মনে হয়, তাই লিখি। লিখতে বসে ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা রকম ভাবতে পারি, তাই লিখি। আবার লিখতে বসলে বয়স কমে যায় তাই লিখি। লিখতে বসলে শৈশব ফিরে আসে, মা বাবা ভাই বোন, ঠাকুমা ঠাকুদ্দা নিয়ে গোটা একটা সংসার, তাই লিখি। ফিরে আসে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার (তখন শুধুই মেদিনীপুর) ডেবরা থানার লোয়াদা বলে একটি জনপদ। সেখানে কংসাবতী নদী পার হয়ে ঘণ্টা দেড় হেঁটে করন্ডা নামের এক গ্রামে পৌঁছনো। চাষাদের গ্রাম। খুব গরিব মানুষজন। আমি ভালোবাসা পেয়েছি তাদের অনেকের। ভালোবাসতে চেয়েছিও গাঁয়ের মানুষকে। আবার এই কারণে অপছন্দের মানুষও হয়েছিলাম চাষাভুসোর সঙ্গে বেশি মেলামেশার জন্য। সেই ভালোবাসা থেকে তাদের কথা লিখতে চাওয়া। ১৯৭৪ সাল। এক মাসে, এপ্রিলে দুটি গল্প লিখেছিলাম, ‘মেলার দিকে ঘর’ ও ‘পার্বতীর বোশেখ মাস’। মনে হয়েছিল লিখতে পেরে যে আনন্দ তা আর কিছুতে নেই। তাই লেখা। এখন সব মনে পড়ে। জানি না কেন প্রথম দিন লিখতে শুরু করেছিলাম। না লিখে কেন তাসুড়েদের তাসের আড্ডায় গিয়ে বসিনি। সন্ধে থেকে জোর তাস খেলা সেই করন্ডা গ্রামে। আমি কেরোসিন ল্যাম্প নিয়ে ঘরের ভিতর। কাগজ কলম নিয়ে বসেছি। কেন তা জানি না, জানি না।
আপনার ‘জননীসমুদ্র’ উপন্যাস সম্পর্কে জানতে চাই। জননী এখানে সমুদ্র হলেন কেন? মাতৃগর্ভই কি তাহলে সমুদ্র কিংবা জীবন?
অমর মিত্র : উপন্যাস নিয়ে কী বলব? তবে এর ভিতরে সমকালীন বাংলাদেশ আছে। নদী আছে। সমুদ্র আছে। নাইওর আছে। মাতৃগর্ভই সমুদ্র।
অনেকদিন আগে ফেইসবুকে আপনি লিখেছিলেন– “ছিটমহল হলো রাষ্ট্রের ভিতরে রাষ্ট্রহীনতা। দেশহীন রাষ্ট্রহীন মানুষ ছিটমহলের বাসিন্দা। ভারতের ভিতরে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ভিতরে ভারত। প্রায় আত্মপরিচয়হীন হয়ে বেঁচে থাকা মানুষের কথাই ছিটমহলের কথা। আমি তা বুঝতে চাইছি। দেশহীন দেশের মানুষের কথা।’ এ সম্পর্কে আরও কিছু আপনার কাছে জানতে চাই।
অমর মিত্র : আমি কলকাতায় মানুষ। তাই ছিটমহলের বিষয়টা জানতামই না। ২০১৪ সালে দিনহাটায় একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে ছিটমহলের ব্যাপারটা জানতে পারি আর সেখানে প্রথম যাই। এতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার– এত বছর ধরে এত মানুষ যে নিরালম্বন হয়ে ঝুলে থাকতে পারেন, রাষ্ট্রবিহীন হয়ে, নাগরিকত্ব বিহীন হয়ে; না গেলে জানতামই না। তারপরেই ছিটমহল নিয়ে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করি। নাম ‘কুমারী মেঘের দেশ চাই’। উপন্যাসেই বিশদ বলেছি। আর কী বলবো?
‘জাহ্নবী দেখছিল পদ্মপুকুর চলে গেল। দেখছিল তার বকুলফুল সই ভদ্রা মিলিয়ে গেল। সব মিলিয়ে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। ঠাকুরতলা, বটতলা, অশথতলা, হলদিডাঙা, মধুগুলগুলি আম গাছটি– সব। বাবার মুখও আবছা হয়ে গেল। জাহ্নবী যেন নদীর মতো বয়ে যেতে লাগল। বুঝতে পারছিল যা ফেলে যাচ্ছে তা চিরকালের মতোই ফেলে যাচ্ছে। যা চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে, তা চিরকালের মতো চলে যাচ্ছে। যেমন যায় নদী। নদী কি পিছনে ফিরতে পারে ? বিকেল বিকেল সে পৌঁছল মহাজনের বাড়ি।’ আপনার ‘কন্যাডিহি’ কথা। কে এই জাহ্নবী? এই উপন্যাস সম্পর্কে আপনার পাঠকদের বলুন।
অমর মিত্র : উপন্যাস নিয়ে কি বিশদে বলা যায়? ‘কন্যাডিহি’ ইতিহাস, কল্পনা আর এই সময়ের এক নারীকে জুড়ে দিয়েছে এক সঙ্গে। পুত্রার্থে পাঁচ কন্যাকে ত্যাগ করে গুরুসেবায় পাঠিয়ে দিয়েছিল এক মহাজন। জাহ্নবী সেই মেয়েদের একজন। পরে সে গৌড়ের রানি হয় (ইতিহাস নয়, কল্পনা)। কিন্তু তার কাছেও পুত্রের দাবি আসে রাজার কাছ থেকে। সমকালে পৌঁছয় জাহ্নবী।
আপনার একটা লেখায় বলেছেন- “আমার যাত্রা শেষ হয়নি। কাঁসাই নদীর কূল থেকে আমি হেঁটে চলেছি। পথে নিউজার্সি, বরিশাল, সিলেট, সাও-পাওলো, টরন্টো… আর টরন্টো ক্যানবেরা থেকে ছিটমহল, ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত…”–এই যে যাত্রার কথা বললেন, আসলে লেখকের যাত্রা কোথায় গিয়ে শেষ হয় বলে আপনি মনে করেন?
অমর মিত্র : লেখকের যাত্রা শেষ হয় না। তিনি চলিষ্ণু।
আপনার ‘ধ্রুবপুত্র’ উপন্যাসের পটভূমি দুই হাজার বছর আগের ভারতবর্ষ। মানে, বহু পুরোনো আখ্যান। মাটির নিচে চাপা পড়া অবন্তী নগরীর কিংবা উজ্জয়িনীর। এখানে এই ধ্রুবপুত্রটি কে? কালিদাসের মেঘদূত কাব্যে তো বর্ষা আছে। ধ্রুবপুত্র তার উলটো। খরার কথা আছে। লোকজন অপেক্ষা করছে বৃষ্টির জন্য। কবি কালিদাস বৃষ্টি আনতে গেছেন। যেন সবাই বৃষ্টির প্রার্থনা করছেন। আসলে এখানে এই উপন্যাস লেখবার ভাবনাটি জানতে চাইছি।
অমর মিত্র : এই উপন্যাসের কাহিনী আমার কল্পনা। মনে হয়েছিল বাস্তবের উজ্জয়িনী আর কালিদাসের মেঘদূতমের উজ্জয়িনী আলাদা। ওই অঞ্চল খরা প্রবণ। বছরে ১৪ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। আমি আত্মীয়তার সূত্রে বেশ কয়েকবার গিয়েছি ওখানে। আর তা বিভিন্ন ঋতুতে। আচমকাই মনে হয়েছিল ‘ধ্রুবপুত্র’ লেখার কথা। অনেক বড় হয়ে এসেছিল বিষয়টি আমার কাছে। কেউ ধারাবাহিক ছাপেনি। সরাসরি বই হয়েছিল বলা যায়। প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠক এবং বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে ভালো মন্তব্য পাই। আলোচিত হয়েছিল খুব। এখানে ধ্রুবপুত্র চরিত্রে কালিদাস কল্পনায় আছে। আর আছে আমার সমকাল। অ্যালিগরি হয়েই সেই সময় এসেছিল এই উপন্যাসে। একটি শূদ্রকে জীয়ন্ত পুড়িয়ে মারা আছে এখানে। আমার দেশে তখন এই ঘটনা ঘটেছিল। সাম্প্রদায়িকতাই অন্যভাবে এসেছে। শূদ্রের জাগরণে এই উপন্যাসে মেঘ আসে বৃষ্টি নিয়ে।
কমলকুমার মজুমদার বলেছেন গল্পে একটি কাহিনী থাকে, ঘটনা থাকে, কিন্তু সেটাই গল্প নয়। আপনার কাছে এই কথাটি ব্যাখ্যা কী?
অমর মিত্র : কাহিনী তো আধার মাত্র। গল্প তো কাহিনী কথন নয়। গল্প আলাদা।
তাহলে দাঁড়াচ্ছে যে গল্পের আধার হলো কাহিনী। শুধু একটি কাহিনীর কথনকেই সাহিত্যে গল্প হিসেবে মানা হচ্ছে না। তাহলে এখন জানতে হবে, গল্প কী? আর ঠিক কীভাবেই বা কাহিনী থেকে গল্প আলাদা করা যায়?
অমর মিত্র : কাহিনীর আয়ু সাময়িক। কাহিনী এমন কোনও মাত্রায় নিয়ে যায় না, যা আপনাকে স্তব্ধ করবে। বিষাদে নিমজ্জিত করবে। বহুদিন পরেও তার মূল্য ফুরোবে না সমাজ ও জীবনের প্রতি তার বিশ্বস্ততার জন্য। মনে করো গোগোলের ‘ওভারকোট’, চেখভের ‘কেরানির মৃত্যু’ বা রবীন্দ্রনাথের ‘গুপ্তধন’। গল্প নিটোল কাহিনী ব্যতীত হয়, কিন্তু কাহিনীর ভেতরে তাই থাকে, আর কিছু না। তা গল্প হয়ে ওঠে যখন তার ভেতরে একটি দর্শন প্রতিভাত হয়।
‘অশ্বচরিত’ প্রসঙ্গে আসা যাক। এখানে সময়কে তার কালানুক্রম থেকে এগিয়ে পিছিয়ে ফ্রেম ভেঙে দিয়ে উপন্যাসের আখ্যান নির্মাণ করলেন- ব্যাপারটি কীভাবে পেলেন? মিথ এবং ইতিহাসকে আশ্রয় করে সময়কে নির্মাণ করবার এই কৌশলটিইবা গ্রহণ করলেন কেন?
অমর মিত্র : লিখতে লিখতে হয়ে হয়ে গিয়েছিল। এই উপন্যাসের একটি খসড়া করি ১৯৮১-৮২-তে, তখন আমি আমার সমুদ্রতীরের এক বছরের বসবাস ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এসেছি। একটি ঘোড়া, তার পলায়ন এবং বিভ্রম ছিল সেই লেখার বিষয়। ১৯৯৮-এ সেই লেখা পুনর্লিখিত হয় রাজস্থানের মরুভূমিতে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের পর। এতদিন পড়ে ছিল লেখাটি। হ্যাঁ, ১৯৮৮ সাল নাগাদ নতুন করে লিখে একটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে এক প্রকাশককে দিয়েছিলাম ছাপতে। তিনি ভাগ্যিস হারিয়ে ফেলেছিলেন। মিথ, ইতিহাস ইত্যাদি স্নাত হয়ে উঠেছিলাম তখন (১৯৯৮-এ) আমি, ধ্রুবপুত্র লিখছি সেই সময়। সেই লেখা থামিয়ে এই লেখা (অশ্বচরিত) লিখেছিলাম। আমি এইরকম লিখতে অভ্যস্ত। সময় থেকে সময়ান্তর যাত্রা আমার গল্পেও আছে।
গল্প থেকে উপন্যাসে গেলেন কীভাবে? গল্পের ক্যানভাস আর উপন্যাসের বিপুলতা, এতো বিস্তৃত পরিসরে একজন গদ্যলেখককে উপন্যাস লিখতে কাজ করতে হয়। প্রস্তুতিটা কেমন ছিল?
অমর মিত্র : পড়তে পড়তে লিখতে লিখতে শেখা হয়। উপন্যাস লিখতে ধৈর্যশীল হতে হয়। উপন্যাসের আঙ্গিক ধরা যায় উপন্যাস পড়লে। এই কালের দেবেশ রায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পড়েছি, পড়েছি আরও কত বাংলা ও বিদেশি নভেল, বিশেষত রুশ উপন্যাস। রুশ উপন্যাসের ব্যাপ্তি আমাকে টানে। তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, শলোখভ ইত্যাদি। বলা যায় রুশ উপন্যাস আমাকে উপন্যাস চিনিয়েছে, গল্পও চিনেছি রুশীদের কাছে। আর উপন্যাস রচনায় আমাদের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পড়তে পড়তে শেখা।
একটি গল্প কি একবারেই লেখেন? নাকি লিখতে থাকার একটা প্রক্রিয়া চলতে থাকে কিন্তু হয়ত অপেক্ষা করছেন গল্পটি মাথায় পুরাপুরি চলে আসার?
অমর মিত্র : গল্প মাথায় কখনও পুরোটা আসে না। একটি বিন্দুই সিন্ধু হয়। আমি আন্দাজ করে করে লিখে যাই। আমি প্রায় শূন্য থেকে শুরু করি গল্প লিখতে বসে।
লিখিত হয়ে যাবার পর, যখন ফিরে দেখতে যান পুরো গল্পটিকে, তখন কীভাবে আপনার মনে হয় যে যা বলতে চেয়েছিলেন, তা বলতে পেরেছেন? সংশোধন বা কাটাকাটি কখন করেন? মানে সম্পাদনার কাজটি…
অমর মিত্র : গল্প লিখতে লিখতেই টের পাই হবে কি হবে না। সংশোধন সঙ্গে সঙ্গেই চলে। আগে কত পাতা ফেলেছি যে! পুরো পাতাই ফেলে দিয়েছি কত, নতুন করে লিখেছি। এখন কম্পিউটারে সংশোধন, কাটাকুটি অনেক সহজ।
গল্পকে আপনি বলছেন জীবনের এক ক্ষুদ্র মুহূর্ত, উপন্যাস সেখানে সমুদ্র। গল্প হলো জীবনের অনুভূতিগুলোর কোলাজ। এখানে কীভাবে গল্প আর উপন্যাসের পার্থক্যটুকু করলেন?
অমর মিত্র : যে-কথাটা বলছো, হয়তো তার সমস্তটা অমন নয়। আসলে শিল্পকে কোনও বিশেষ সূত্রে বাঁধা কঠিন। আসলে কী থেকে কী হয় ধরা যায় না। একটি গল্পই হয়ে উঠেছে উপন্যাস। অশ্বচরিত’র ঘোড়াটিকে নিয়ে ১৯৮০ সালে আমি একটি গল্পও লিখেছিলাম। তাই হয়ে যায় মহাব্যপ্ত, হ্যাঁ, অনেক পরে।
একজন বিজ্ঞানীর কাছেও এই জীবন রহস্যময়, লেখকের কাছেও সমান রহস্যময়। সেই রহস্যময়তা ঠিক কীভাবে সাহিত্য হয়ে উঠবে?
অমর মিত্র : জীবন তো রহস্যময় নিশ্চয়। না হলে কে জানত আমি লিখব? লেখক যা লেখেন, তা কি বাস্তবতায় ঘটে থাকে? সাহিত্যের বাস্তবতা লেখকের নির্মাণ। সেই বাস্তবতা, যা কি না লেখক নিজে কল্পনা করেছেন, তা বহু মানুষের জীবনের উপলব্ধির সঙ্গে মিলে যায়। কী করে হয় কে জানে? জীবন আমাদের কোথায় নিয়ে যায় জানি না। কিন্তু সেই অনিশ্চয়তাকে যদি স্পর্শ করতে পারি, হয়ে যায়। অনিশ্চয়তা রহস্যময় নিশ্চয়।
একটি গল্প লেখার পর সেটা ফিরে পড়তে গিয়ে ভালো না লাগলে কিংবা অসম্পূর্ণ মনে হলে, তখন কী করেন?
অমর মিত্র : রেখে দিই। ছ’মাস বাদেও অসম্পূর্ণ গল্প সম্পূর্ণ হয়েছে। এইভাবে ‘হারানো নদীর স্রোত’ গল্পটি লিখেছিলাম। এখনও এক-দু’মাস ফেলে রেখে হয়।
আপনার গল্প লেখার ধরন কি অর্থাৎ গল্প কি আগে থেকে ভেবে নিয়ে লেখেন, নাকি লিখতে শুরু করে শেষের দিকে এগিয়ে যান?
অমর মিত্র : না, আমি একটি বিন্দু থেকে শুরু করি। সম্পূর্ণ অজানা পথেই শুরু হয় এই যাত্রা।
এই বিন্দু কী? এটা কি কোনো শব্দ বা বাক্য? নাকি অন্য কিছু? এই বিন্দুকে আশ্রয় করে যে গল্প বা উপন্যাসটি লেখেন– তা লিখতে লিখতে কিভাবে চরিত্রগুলো আসে, উপাখ্যানগুলো আসে? লিখতে লিখতে কিভাবে এই নানাবিধ চরিত্রকে, উপাখ্যানগুলিকে, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, পরিণতি এবং দার্শনিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করেন? এবং ভাষাভঙ্গিকে নির্বাচন করেন?
অমর মিত্র : উপন্যাসে অনেকটা মাথায় থাকে। কিন্তু লিখতে বসলে তা বদলে যায় ক্রমাগত। আর গল্পে সামান্য কিছু থাকে চেনা জানা। তা থেকে অনেকটা গড়ে ওঠে। এর ভাষা, কথন-ভঙ্গি, পরিণতি- সবই লিখতে লিখতে হয়। ভাবনা আর লেখা এক সঙ্গে চলতে থাকে।
আপনার ধনপতির চর এবং ধ্রুবপুত্রকে যদি ধরি তাহলে দুটো দুধরনের আখ্যান নিয়ে লেখা। ধনপতির চরের কাহিনী ভূমি দখলের কাহিনী। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আখ্যান। নানা মানুষ এসেছে। নানা সময় এসেছে। ইতিহাস, কিংবদন্তি এসেছে। আবার সমকাল এসেছে। কিন্তু ধ্রুবপুত্র পুরোটাই পুরাণভিত্তিক আখ্যান। তার চরিত্র, স্থান-কাল, সেটিং সবই কালিদাসের কালে পাঠককে নিয়ে যায়। ফলে দুটোর ভাষাভঙ্গীও আলাদা। ধ্রুবপুত্রের ভাষাভঙ্গী মহাকাব্যিক, সৌকর্যময়। এই যে ভাষাভঙ্গি আপনি নির্মাণ করলেন, সেটা কেন ও কিভাবে করলেন?
অমর মিত্র : ধ্রুবপুত্র কোনো ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক বিষয় নয়। এর সমস্তটাই আমার নির্মাণ। এর বীজ কোথাও নেই, ছিল না। আমি উজ্জয়িনীতে বেশ কয়েকবার গিয়ে দেখেছিলাম, খরাপ্রবণ এলাকা। বৃষ্টিপাত খুব কম। আমি মেঘদূত কাব্যে যে উজ্জয়িনীর ছবি দেখেছি, সেই বর্ষার অপরূপ বর্ণনা, তার সঙ্গে এখনকার বাস্তবের মিল নেই। সেই দেখা থেকেই মেঘদূত কাব্যের বিপরীত এক আখ্যান রচনার কথা ভাবি। আমার মনে হয়েছে, বৃষ্টিহীন উজ্জয়িনীর কথা না লিখে বর্ষার যে কথা লিখেছিলেন সেই প্রাচীন কবি, সমস্তটাই ছিল তাঁর ইচ্ছা পূরণ। মনে হয়েছিল মেঘদূত কাব্য লিখে বর্ষার মেঘকে ডেকে এনেছেন কবি। ওই কাব্যই যেন বৃষ্টির মন্ত্র। আমি কল্পনা করতে ভালোবাসি। এই কাহিনি, খরা পীড়িত উজ্জয়িনীর কাহিনি আমি ভেবেছি। সমস্ত চরিত্রই আমার। ইতিহাস বা পুরাণে নেই। লিখতে গিয়ে আমি সংস্কৃত সাহিত্য পড়েছি, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পড়েছি, বিক্রমাদিত্যের ওপর বই পড়েছি, বাৎস্যায়ন পড়েছি, পুরাণও। প্রাচীন ভারতের নারীদের কথা সুকুমারী ভট্টাচাযের বইয়ে পড়েছি- এই সব পাঠ শুধু সময় আর সমাজকে জানতে। বাকিটা আমার মতো করে লিখে গিয়েছি। কে ছাপবে জানতাম না। কোনো পত্রিকা বলেনি লিখতে। কেউ ধারাবাহিক করেনি। রমাপদ চৌধুরী এই উপন্যাসের কথা শুনে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কে ছাপবে, কোন পত্রিকা? আমি বলেছিলাম, কেউ না। কেউ বলেনি। রমাপদবাবু তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাহলে যে লিখছেন? বলেছিলাম, ভিতরের তাড়না থেকে। উনি বলেছিলেন, লিখুন, উপন্যাসটি হবে। সরাসরি বই হয়েছিল বলা যায় এই উপন্যাস। আমার আত্মবিশ্বাস আমাকে দিয়ে লিখিয়েছে। বই হওয়ার পর উদ্বেগে ছিলাম, তা অচিরেই দূর হয়েছিল। এই উপন্যাসে প্রাচীন কাল, উজ্জয়িনী নগর, কবির নিরুদ্দেশ যাত্রা এবং অশেষ বৃষ্টিহীন দিনের আরম্ভ, কবির সঙ্গে জ্ঞানের নিবার্সন, জ্ঞানই হলো মেঘ এবং মেঘের নিবার্সন, মানুষের জন্মকাল বিলম্বিত হয়ে ওঠা রূপকে আমার দেশকে নির্মাণই যেন করেছে। ক্ষমতার অন্ধকারকে দেখিয়েছে। উপন্যাস যখন লেখা শেষ হয়, ২০০২-সালে, আমার ভারতবর্ষ তখন ক্ষমতার দম্ভ দেখেছিল, হননকাল দেখেছিল, তার ছায়া কি পড়েনি? পরে আমি শুনেছি, সেই ছায়া আছে, কিন্তু আমি সজ্ঞানে তো করিনি। সময় ছায়া ফেলেই যদি আপনি সময় সচেতন হন। প্রাচীনেও বর্তমান মিলে মিশে যায়।
আপনি আপনার গল্প দিয়ে কি কোনও বিশেষ বার্তা দিতে চান পাঠককে?
অমর মিত্র : আমি আমার কথাই বলতে চাই। নিজে এই পৃথিবী, এই সমাজকে কেমনভাবে অনুভব করছি, তা। এইটাই আমার কথা।
বাংলাভাষার পাঠক কি কমছে? বাংলা সাহিত্যের পাঠক? আপনার কী মত?
অমর মিত্র : সিরিয়াস লেখা চিরকালই কম পাঠক পড়েন। তাঁরা আছেন। আর অন্য বাণিজ্য সফল লেখক কি নেই? আছেন। পাঠক কমছে না বাড়ছে জানা নেই। ভাবি না। আমাকে কেউ, কোনও বড় প্রতিষ্ঠান ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে পাঠক উপহার দেননি, যা এপারে হয়ে থাকে। তাঁদের কথাই আপনারা জানেন। আমার অর্জন নিজের অর্জন। আমি তা হারাব না। আমার নিজস্ব পাঠক বাড়ছে বলে আমার মনে হয়।
মানুষ তো কত কিছু হয়। এই যে এত কিছুর বদলে লেখক হলেন, ব্যাপারটা আপনার কাছে কেমন লাগে?
অমর মিত্র : ভিতরের টান থেকে আমি লেখক হয়েছি। একটা গল্প লেখা, উপন্যাস লিখে উঠতে পারার আনন্দ কি আমি অন্য কাজে পেতাম? এখানে পেয়েছি। নিজের কথা বলছি নিজের মতো করে। আমি স্রোতের বিপরীতে যেতে পেরেছিলাম বলেই জীবনটাকে এমন আনন্দময় দেখতে পেলাম।
লিখে কি সমাজ পরিবর্তন করা যায়? আসলে, আমার প্রশ্ন হলো লেখালেখির কী উদ্দেশ্য থাকে?
অমর মিত্র : লেখা মানুষকে সুন্দরের কাছে নিয়ে যায়। অসুন্দরকে চিহ্নিত করে দেয়। সমাজ পরিবর্তন অন্যভাবে হয়।
আপনার গল্পকে আপনার নিজের জীবন থেকে বলা কোনো ঘটনা মনে হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের কাছে তা তখন সত্যি গল্প হয়ে যায়। পাঠক ‘গল্প’ শুনতে চান কিন্তু গল্পটাকে নিছক ‘গল্প’ ভাবতে চান না; মনের অজান্তেই সত্যি ভেবে নিতে চান। আপনার মতে, এই গুণাবলীগুলোর ঠিক কোনটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, গল্পটি পাঠকের মনে গেঁথে যেতে?
অমর মিত্র : গল্প যদি কাহিনি থেকে বেরিয়ে এমন কোনো স্পর্শ দেয় তোমাকে, তুমি যদি মনে করো যা পড়লে তা তোমার জীবনেও হতে পারত। ঘটেনি কিন্তু ঘটতে পারত, তবে তা পাঠক নিজের কাছে রেখে দেন।
আপনার প্রিয় কোন লেখক বা প্রিয় কোন মানুষের আইডোলজি কি আপনার লেখায় কোথাও না কোথাও ছায়া ফেলে?
অমর মিত্র : মাকে খুব পাই। বাবাকেও। তাঁরা সরল ও ভাল মানুষ ছিলেন। উদার হৃদয় ছিল তাঁদের।
নতুন গল্পকারকে ভাল গল্প লিখতে বা উৎসাহ দিতে, কোন কথা কি বলতে চান?
অমর মিত্র : লেখা সাধনার মতো। একে সেই ভাবে নিতে হবে।
গল্পের সমাপ্তি কি আগে থেকেই ভেবে রাখেন?
অমর মিত্র : সমাপ্তি ভাবলে লেখাই হয় না। অনিশ্চয়তাই শিল্পের মূল চাবিকাঠি।
লিখতে বসেই লেখক অনন্ত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন– এমন কথা আপনি বলেছেন। কী সেই অনন্ত স্বাধীনতা?
অমর মিত্র : নিজের মতো করে নির্মাণ। সেখানে তো সীমান্ত, ধর্ম, সংবিধান কিছুই নেই। আমি আমার মতো করে সাতক্ষীরাকে বর্ণনা করব। না মিললে বলব আমি তো ভূগোল বই লিখিনি। আমার সাতক্ষীরা এমনই।
আপনার গল্পের একটি বিশাল অংশ জুড়ে থাকে মানুষ কীভাবে সমস্ত কিছু হারাতে থাকে- এই ব্যাপারটি। কোন সেই বিশেষ ভাবনা আপনাকে আপনার পাঠকের ভিতর মানুষের নিঃস্ব হয়ে পড়ার বোধটি সঞ্চারিত করে দেয়?
অমর মিত্র : মানুষের জীবন তো নিঃস্ব হওয়ারই জীবন। যা আমরা প্রকৃতি থেকে পাই, স্বাস্থ্য, সৌন্দয, যৌবন, সবই তো হারাই। আমি নিঃস্ব মানুষের সঙ্গ করেছি অনেক। সে ভূমিহীন চাষা থেকে কাজ হারানো শ্রমিক। এ থেকে এক বোধ, এক দর্শন আমার ভিতরে কাজ করে। আমি জানি না পাঠক কী পড়তে চায়। আমি যা লিখতে চাই, তাই লিখি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.