চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় মূল সড়কের পাশের ছবিঘর নামের সিনেমা হলটি ভেঙে মাদ্রাসা করা হয়েছে। এ উপজেলার বাকি তিনটি সিনেমা হলও বন্ধ হয়ে গেছে। আলমডাঙ্গা উপজেলার চারটি সিনেমা হলের তিনটি বন্ধ। একটিতে ছবি প্রদর্শন হয়, তবে অনিয়মিতভাবে। জীবননগর উপজেলার দুটি হলের একটিও সচল নেই। জেলা শহরে সিনেমা হল ছিল তিনটি। এখন দুটি অনিয়মিতভাবে চালু আছে। এ চিত্র বলছে, জেলায় সাধারণের বিনোদনের দরজা মোটামুটি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে নাগরিক সংস্কৃতির নিবুনিবু বাতিটি প্রাণের টানে জ্বালিয়ে রেখেছে কিছু সংগঠন। বিনোদন-সংস্কৃতির জন্য জেলাবাসীর যে হাপিত্যেশ, তা কিছুটা হলেও পূরণ করে চলছে অরিন্দম সাংস্কৃতিক সংগঠন। শিল্পকলা একাডেমির মুক্তমঞ্চে তারা নাটক করে। বেশ সক্রিয় দর্শনার অনির্বাণ থিয়েটারও। সংস্কৃতির বাকি শাখাগুলোর চর্চা অবশ্য বিভিন্ন দিবসনির্ভর। এই মন খারাপ করা আলোচনার মধ্যে স্বস্তি হয়ে এল ‘কবরী রোড’-এর গল্প। জেলায় হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সংস্কৃতি ক্ষয়ে গেলেও অভিনেত্রী সারাহ্ বেগম কবরীর নামে করা চুয়াডাঙ্গা শহরের এ রাস্তাটি স্বনামে টিকে আছে। এ সড়কেরই একটি বাড়িতে ১৯৬৯ সালে শুটিং হয়েছিল কখগঘঙ চলচ্চিত্রের। সেই বাড়ি আর এই রাস্তা এখন এ শহরের গর্বের স্মৃতি। কৌতূহল মেটাতে চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি শাহ আলমকে নিয়ে গেলাম সেখানে। শহরের অন্য সড়কগুলোর মতোই কবরী রোডও ভাঙাচোরা। স্থানীয় এক যুবককে জিজ্ঞাসা করতেই দেখিয়ে দিলেন সেই বাড়ি। পুরোনো নিঝুম এক বাড়ি। নাম সেতাব মঞ্জিল। বাইরে থেকে লোকজনের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। একতলা ভবনটির বাইরের বারান্দা ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকলে তিনটি কক্ষের সামনে জুতার স্তূপ নজর কাড়ে। চোখ তুলে ওপরে তাকালে একটি নোটিশ বোর্ড। তার ওপর লেখা ‘কবরী মেস’। এক তরুণ বসে টিভি দেখছেন। কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য গ্রাম থেকে এসে এ মেসের বড় ভাইদের কাছে উঠেছেন। এ বাড়িতে যে একটি সিনেমার শুটিং হয়েছে, সে তথ্য তিনি এখানে এসেই জেনেছেন। হাতের স্মার্ট ফোনটি দেখিয়ে বলেন, ‘সিনেমার নাম শুনে ইউটিউবে খুঁজেছি। ভালো পাইনি।’ তিন বছর ধরে এই কবরী মেসেই থাকেন রুবেল হোসেন। পড়েন স্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি যখন এসেছিলেন, তখন জানতেন না যে এখানে সিনেমার শুটিং হয়েছে। পরে বড় ভাইদের কাছে জেনেছেন। সেই সূত্রে শহরের কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে কখগঘঙ সিনেমাটিও পেনড্রাইভে করে এনে ল্যাপটপে দেখেছেন। তিনিসহ তিনজন থাকেন বাড়ির ভেতরের দিকের কক্ষটিতে। রুবেল শুনেছেন তাঁদের এ কক্ষটিতেই শুটিংয়ের সময় কবরী থাকতেন। তবে তার চেয়ে বড় কথা, ‘শহরে ঠিকানা বললেই সবাই চেনে। চেনাতে হয় না। এটাই আমাদের ভালো লাগে।’ বলেন রুবেল। বাড়ির মালিক মোরশেদ আহমেদ থাকেন ঢাকায়। এলাকায় তোকা মিয়া নামে পরিচিত। ফোনে কথা হলো তাঁর সঙ্গে। তিনি ওই সিনেমার সহকারী চিত্রগ্রাহকও ছিলেন। চিত্রগ্রাহক ছিলেন প্রয়াত বেবী ইসলাম। দুজনে মামাতো-ফুফাতো ভাই। বেবী ইসলামের স্ত্রী তন্দ্রা ইসলামও অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, কবরী, আনোয়ার হোসেন, রহিমা খালার সঙ্গে। পর্দায় ছিলেন সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদও। মোরশেদ আহমেদের স্মৃতি এখন ঝাপসা। তবে অতীত তো তাঁর উজ্জ্বল। বলেন, ‘খান আতার প্রায় সব সিনেমায় কাজ করেছি। কাজ করেছি সৈয়দ শামসুল হক, আমজাদ হোসেনের ছবিতেও। ছিলাম ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমায়। তবে এখন আর এ জগতের কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই।’ কখগঘঙ সিনেমার স্মৃতিচারণা করতে বললে তিনি বলেন, ‘তন্দ্রা ভাবি ভালো বলতে পারবেন।’ তন্দ্রা ইসলাম বললেন, ‘একটা বাণিজ্যিক ছবি করার জন্য আলোচনা হলো। বাজেট কমাতে বেবী ইসলাম প্রস্তাব করলেন, সেটের পয়সা লাগবে না। চুয়াডাঙ্গায় শুটিং হবে। সেভাবেই হলো। সেখানেই বেবী ইসলাম আমাদের বলেন, “আমি তো ক্ল্যাসিক ছবি করি, বাজার পায় না। এটা আমার নামে না চালিয়ে নারায়ণ ঘোষ মিতার নামে চালাও।” নারায়ণ ঘোষ তখন বাণিজ্যিক সিনেমা পরিচালনায় বেশ নাম কামিয়েছিলেন।’ তন্দ্রা ইসলাম বলেন, ‘তখন কবরী খুব জনপ্রিয়। সবাই দেখতে আসত। বলত, কবরী কোথায় থাকে? লোকজন দেখিয়ে দিত, ওই যে ওই বাড়িতে। রিকশাওয়ালারা উৎসুক লোকজনকে নিয়ে আসত। শুটিংয়ের এক মাসে এভাবেই মুখে মুখে বোধ হয় রাস্তাটার নাম কবরী রোড হয়ে গেল।’ এই কবরী রোডের কথা এখনকার রাজনীতিক সারাহ্ বেগম কবরী কি জানেন? মুঠোফোনে ধরতেই খলবলিয়ে উঠলেন স্বভাবগত স্বতঃস্ফূর্ততায়; বললেন, ‘জানি, জানি, চুয়াডাঙ্গায়।’ ১৯৬৯ সালের স্মৃতি এখনো কি জ্যান্ত! হড়বড় করে বলে চললেন, ‘মণিপুরি পাড়ায় আমরা মিটিং করলাম। আমি, রাজ্জাক, আনোয়ার হোসেন, নারায়ণ ঘোষ, বেবী ইসলাম। সিদ্ধান্ত হলো, আমরা অভিনয়ের জন্য কোনো সম্মানী নেব না। সবাই প্রডিউসার (প্রযোজক) হব। কিন্তু শেষে এসে রাজ্জাক সাহেব রাজি হলেন না। পরে হাসমতকে (হাবা হাসমত) নেওয়া হলো প্রডিউসার হিসেবে। ছবিটা অনেক ব্যবসা সফল হয়েছিল।’ শুটিংয়ের সময়ের স্মৃতি জানতে চাইব? কী দরকার! কবরীর স্মৃতির অর্গল তো খুলে গেছে। ‘যে বাড়িতে শুটিং হয়েছিল, সেটি ছিল বেবী ইসলামের মামার বাড়ি। এক মাস ধরে চলল শুটিং। আমি তখন ছোট; বয়স কম। শহরটিও ছোট্ট। তবু মানুষজনের যেন কমতি ছিল না। একদিন তো শুটিংয়ের সময় আর লোকজনকে সরানো যাচ্ছিল না। কাজই করা যাচ্ছিল না। শেষে আনোয়ার হোসেন সাহেব খেপে গেলেন। সামনে গিয়ে বললেন, “তোমরা যদি এখনই সরে না যাও, তাহলে আমি কিন্তু কাপড় ফেলে দৌড় দেব।” ভয়ংকর কথা! কিন্তু কোথায় কী! লোকজন যেন আরও মজা পেল। আসলে আমরা তো খুব সাধারণভাবে সেখানে ছিলাম। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছি। মাটিতে বসে গল্প করেছি। শুটিংয়ে সবার সঙ্গে টিনের থালায় খেয়েছি। তারাও আমাকে সাধারণভাবেই নিয়েছে। এক মাস পর শুটিং শেষে ফিরে আসার সময় তো আমার মন খুবই খারাপ হয়ে গেল। লোকজনকে বলেছি, আমি আবার আসব। কিন্তু ৪৭ বছর হয়ে গেল। আর তো যেতে পারিনি…’ কবরী নিঃশ্বাস ফেললেন। স্বাধীনতার পর এলাকার লোকজন একটা চিঠি পাঠালেন কবরীকে। চিঠির ভেতরে আরেকটি খাম। ‘কবরী রোড’-এর ঠিকানায় তাঁদের চিঠি এসেছে। কবরীর খুব ইচ্ছা তিনি চুয়াডাঙ্গায় যাবেন। অকপটেই বললেন, ‘আমাকে বললে আমি যাব। নিজ খরচেই যাব। বেঁচে থাকতে রাস্তাটি দেখে যেতে চাই।