স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। একটি নাম, একটি ইতিহাস। একাধারে একজন পদার্থবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও পুরাতত্ত্ববিদ। বাংলা ভাষায় প্রথম কল্পবিজ্ঞানের রচয়িতাও তিনি। ১৮৫৮ সালে তৎকালীন বৃটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন জগদীশ চন্দ্র বসু। তার পৈতৃক বাসস্থান ছিল বিক্রমপুরের রাঢ়িখালে। পিতা ভগবান চন্দ্র বসু তখনকার ইংরেজ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তবে ছেলেকে তিনি বাংলা স্কুলেই ভর্তি করিয়েছিলেন। অসম্ভব মেধাবী জগদীশ চন্দ্র বসু শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। ওই সময় থেকেই শুরু তার গবেষণার। তার সেসব গবেষণা তাক লাগিয়ে দিয়েছিল বিশ্ববাসীকে। আর সে কারণেই ওই সময়ের অনেক শীর্ষ বিজ্ঞানীই বলেছেন, জগদীশ ছিলেন তার সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা একজন বিজ্ঞানী। অথচ কেবল বাঙালি হওয়ার কারণে তিনি পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ-সুবিধা পাননি। প্রেসিডেন্সি কলেজেও বাঙালি হওয়ার কারণে ইংরেজ অধ্যাপকদের তুলনায় অনেক কম বেতন পেতেন তিনি। এর প্রতিবাদে তিন বছর তিনি বেতনই গ্রহণ করেননি। তার এই প্রতিবাদের কারণেই ইংরেজরা বাঙালি অধ্যাপকদেরও ইংরেজ অধ্যাপকদের সমান বেতন দিতে বাধ্য হন। এতসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রেডিও’র অন্যতম জনক এই বাঙালি। গাছের যে প্রাণ রয়েছে, তারা যে ব্যথা- বেদনা অনুভব করে- এই বৈজ্ঞানিক সত্যও বিশ্বের কাছে হাজির করেন তিনিই। তার গবেষণা আর উদ্ভাবনের স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরস্কার তো পেয়েছেনই, চাঁদের একটি খাদের নামকরণও করা হয়েছে তার নামে। অনন্য সাধারণ এই বাঙালি বিজ্ঞানীর ১৫৮তম জন্মদিন ছিল গতকাল। তার অবদানকে স্মরণ করে তাকে সম্মাননা জানাতেই গতকাল ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সে নিজেদের লোগা পরিবর্তন করে জগদীশ চন্দ্র বসুকে নিয়ে অঙ্কিত ডুডল ব্যবহার করে গুগল। গতকাল এসব দেশ থেকে যারাই গুগলে প্রবেশ করেছেন, গুগলের নিজস্ব লোগোর পরিবর্তে জগদীশ চন্দ্র বসুকে নিয়ে অঙ্কিত ডুডলটি দেখতে পেয়েছেন। ডুডলটিতে দেখা যায়, কিংবদন্তিতুল্য এই বিজ্ঞানী কাজ করছেন নিজের উদ্ভাবিত গাছের বৃদ্ধি পরিমাপক যন্ত্র ক্রেসকোগ্রাফ নিয়ে। বাঙালির বিজ্ঞান গবেষণার অন্যতম এই পথিকৃতের জীবনের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছে বৃটিশ অনলাইন ইন্ডিপেন্ডেন্ট। অনলাইনটি বলছে, বাঙালি বিজ্ঞানীর এই পাঁচটি তথ্য সবারই জানা থাকা দরকার। এই পাঁচটি তথ্য তুলে ধরা হলো এখানে।
বাংলা শিক্ষা থেকেই প্রকৃতির প্রতি আগ্রহ জগদীশ চন্দ্র বসুর বাবা ছিলেন ইংরেজ সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তা সত্ত্বেও তিনি তার ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন বাংলা স্কুলে। তিনি মনে করতেন, ইংরেজি ভাষা শেখার আগে মাতৃভাষা বাংলা ভালোভাবে শেখা উচিত। বাবার এমন সিদ্ধান্ত জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি নিজেই ১৯১৫ সালে বিক্রমপুরের একটি সম্মেলনে বলেন, ‘আমি পশু-পাখি ও মাছদের নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি যেগুলো আমাকে সম্মোহিত করে রাখতো। হয়তো এসব মনোমুগ্ধকর গল্পই আমাকে প্রকৃতি সম্পর্কে উৎসাহিত করেছে। হয়তো এসব গল্পই আমাকে প্রকৃতি কীভাবে কাজ করে থাকে তা সম্পর্কে আগ্রহী করেছে।’ পরিবারে দারিদ্র্য আর অনটন থাকলেও জগদীশ চন্দ্র বসুর বাবা চেয়েছিলেন ছেলে বিদ্বান হোক। বাবার সেই স্বপ্নকে অপূর্ণ রাখেননি তিনি। কেবল নিজেরই নয়, বিশ্বব্যাপী বাঙালির নাম উজ্জ্বল করেছেন তিনি।
বর্ণবৈষম্যের কারণে গবেষণাগার ব্যবহারের সুযোগ পাননি তখন রাজত্ব ছিল বৃটিশদের। কিন্তু জগদীশ ছিলেন বাঙালি। তিনি যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন, তা অনেক ইংরেজই ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। সে কারণে অনেক সময়েই তাকে ওই কলেজের মূল গবেষণাগার ব্যবহার করতে দেয়া হতো না তাকে। ফলে স্বাধীনভাবে গবেষণাও পরিচালনা করতে পারতেন না জগদীশ। পরে তিনি নিজের থাকার ঘরের পাশে মাত্র ২৪ বর্গফুট আকারের একটি ঘরে নিজের মতো করে গবেষণাগার স্থাপন করেন। সেখানেই চালিয়ে যেতে থাকেন গবেষণা। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও তাকে নিজের খরচেই তৈরি করিয়ে নিতে হতো। এতসব প্রতিকূলতার কারণে নিজের গবেষণাতেই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারতেন না তিনি। সেটা পারলে হয়তো আরো অনেক অবিস্মরণীয় অবদান বিজ্ঞান পেতো তার কাছ থেকে।
রেডিও বিজ্ঞানের অন্যতম জনক আধুনিক রেডিও বা বেতার তরঙ্গের গবেষণা ও শব্দ বিজ্ঞানে একটি উল্লেখযোগ্য নাম জগদীশ চন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তাই উদ্ভিদবিজ্ঞানের মতো পদার্থবিজ্ঞানেও তার অবদান কম নয়। নিজের গবেষণায় তিনি দূরবর্তী কোনো বেতার তরঙ্গকে গ্রহণ করায় অসামান্য অগ্রগতি লাভ করেন তিনি। প্রাথমিক পর্যায়ের বেতার যোগাযোগের মাধ্যমও তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন। জগদীশ চন্দ্র বসু চাইলে বেতার তরঙ্গ নিয়ে তার গবেষণা ও উদ্ভাবনকে ব্যবহার করে আর্থিক ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক সুবিধা আদায় করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞানের উদ্ভাবন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত। তিনি প্যাটেন্ট নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। আর সে কারণেই তিনি সম্পদকে তুচ্ছ করে তার সব উদ্ভাবনকে প্রকাশ করে দেন। এর পেছনে তার আরেকটি লক্ষ্য ছিল যে, এসব উদ্ভাবনকে ব্যবহার করে যেন অন্যরা এসব উদ্ভাবনকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। পরে ১৯৯৭ সালে ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার্স (আইট্রিপলই) জগদীশ চন্দ্র বসুকে ‘রেডিও বিজ্ঞানের জনক’ উপাধি প্রদান করে।
উদ্ভিদের অনুভূতি বুঝতে পেরেছিলেন জগদীশ রেডিও বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় জগদীশ চন্দ্র বসুর অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তার গবেষণা ও উদ্ভাবনের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ক্রেসকোগ্রাফ। উদ্ভিদেরও যে জীবন আছে, উদ্ভিদও যে বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি অনুভব করে- তা প্রথম জগদীশ চন্দ্র বসুই উদ্ভাবন করেন। আর তার ক্রেসকোগ্রাফ দিয়ে পরিমাপ করা যায় গাছের বৃদ্ধি এবং ঋতু ও বাইরের বিভিন্ন প্রভাবকের প্রভাব উদ্ভিদের ওপর কতটা। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, তাপমাত্রা ও আলো কীভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে তা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করেছেন জগদীশ চন্দ্র বসু। কীভাবে উদ্ভিদের যত্ন আরো ভালোভাবে নেয়া যায়, সেই পরামর্শও দিয়ে গেছেন তিনি। এতে করে আরো কার্যকর উপায়ে কৃষিকাজ করার গবেষণা জোরদার হয়েছে এবং গাছপালার যত্ন নিতেও তা উৎসাহিত করেছে মানুষকে। এক নিবন্ধে জগদীশ চন্দ্র বসু লিখেছিলেন, ঠিক মানুষের মতোই উদ্ভিদও ‘বেদনা অনুভব করে এবং বাৎসল্য বুঝতে পারে’।
চাঁদের একটি খাদের নাম রয়েছে জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের একটি খাদের নামকরণ করা হয়েছে জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে। চাঁদের যে পৃষ্ঠটি পৃথিবীর দিকে রয়েছে তার বিপরীত দিকে অবস্থিত ওই খাদ। ভাভা ও অ্যাডলার নামের আরো দুইটি খাদের কাছাকাছি এর অবস্থান। খাদটির ব্যাস প্রায় ৯১ কিলোমিটার। বিজ্ঞানে, বিশেষত বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রে জগদীশ চন্দ্র বসুর বিশেষ অবদানের কথা স্মরণ করেই তার নামে চাঁদের ওই খাদের নামকরণ করা হয়। কারণ, ওই বেতার যোগাযোগই পরবর্তী সময়ে স্যাটেলাইট যোগাযোগের উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করেছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.