গত ৭ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার বলেন, সাক্ষরতা নিয়ে লেটেস্ট কোনো সার্ভে (সমীক্ষা) নেই। তবে তার নিজের এলাকার শতভাগ মানুষ সাক্ষর। এমনি শতভাগ সাক্ষরতার অধীন আরও বেশকিছু এলাকা আছে। সেসব ধরেই তিনি মনে করছেন, দেশে সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ। যদিও সর্বশেষ ২০১১ সালে সরকারিভাবে সাক্ষরতার হার নিরূপণ করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিচালিত এ হিসাব অনুযায়ী সাক্ষরতার হার ছিল ৫৮ ভাগ। এর আগে ২০০৮ সালে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ও ২০০২ সালে ক্যাম্পে সাক্ষরতার ওপর সমীক্ষা চালায়। তখন সংস্থাটি সাক্ষরতার হার পেয়েছিল ৪১ দশমিক ৪ ভাগ। গত ১৪ বছরে তা বেড়ে হয়েছে মাত্র ৫১ দশমিক ৩ ভাগ।
এ প্রসঙ্গে ক্যাম্পের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, সাক্ষরতার বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য সরকারসহ আমাদের কারও কাছে নেই। এর মধ্যে উন্নয়নের নতুন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি (টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা) গ্রহণ করেছে বিশ্ব। তাই সাক্ষরতার বিষয়ে নতুন তথ্যের প্রয়োজনে এ সমীক্ষা চালানো হয়েছে। সেই সমীক্ষাতেই নতুন তথ্য উঠে এসেছে।
ইউনেস্কোর মতে, একজন সাক্ষরতাসম্পন্ন মানুষ লিখতে, পড়তে, হিসাব কষতে এবং বুঝতে পারবেন। এ চারটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে ব্যক্তির সাক্ষরতা নিরূপণ করা হয় বলে জানান ক্যাম্পের উপপরিচালক কেএম এনামুল হক। একসময় শুধু নাম লিখতে পারলেই ব্যক্তিকে সাক্ষর (অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন) বলা হতো। তিনি আরও বলেন, মোট সাক্ষরতার হার যাই হোক, বাংলাদেশের জন্য খুশির খবর হচ্ছে, তরুণদের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশই সাক্ষর। সাধারণত ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষকে তরুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ক্যাম্পের ‘সাক্ষরতা, দক্ষতা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা : বাংলাদেশে এসডিজি-৪’ শীর্ষক এ সমীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে দেশে যে ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ সাক্ষর মানুষ পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে শহরে ৫৯ দশমিক ৩ ভাগ এবং গ্রামে ৪৯ দশমিক ২ ভাগ। মোট জনসংখ্যার হিসাবে পুরুষদের সাক্ষরতার হার ৫০ দশমিক ৫ ভাগ, নারীদের ৫৩ দশমিক ২ ভাগ এবং অন্য জেন্ডারের সাক্ষরতার হার ৪০ দশমিক ১ ভাগ। এ সমীক্ষায় বয়সভিত্তিক সাক্ষরতাও বের করা হয়েছে। ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে সাক্ষরতার হার প্রায় ৪৭ দশমিক ২ ভাগ। ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে আছে ৭৪ দশমিক ৮ ভাগ। আর ৬০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষের সাক্ষরতার হার ২০ দশমিক ৭ ভাগ।
বিভাগভিত্তিক সবচেয়ে বেশি সাক্ষর মানুষ বরিশালে। সেখানে এর হার ৫৭ দশমিক ৩ ভাগ। সবচেয়ে কম ময়মনসিংহে ৪২ দশমিক ১ ভাগ। ঢাকায় ৪৮ দশমিক ৩ ভাগ ও চট্টগ্রামে ৪৫ দশমিক ৪ ভাগ। রাজশাহীতে ৫২ দশমিক ৯ ভাগ, খুলনায় ৫৩ দশমিক ৯ ভাগ, রংপুরে ৪৭ দশমিক ৩ ভাগ। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৬৩ দশমিক ৩ ভাগ ও মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫৬ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ সাক্ষর।
গত ৬ বছর ধরে দেশে সাক্ষরতার হার নিয়ে তথ্যবিভ্রাট চলছে। খোদ মন্ত্রী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্যেই রয়েছে বিরাট ফারাক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ১০১৫ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ৬৪ দশমিক ০৬ ভাগ। ২০১৪ সালে এটি ছিল ৬১ দশমিক ১৪ ভাগ। ২০১৩ সালে ৬১ দশমিক ০৪ ভাগ, ২০১২ সালে ৬০ দশমিক ০৭ ভাগ, ২০১১ সালে ৫৮ দশমিক ০৮ ভাগ মানুষ সাক্ষর ছিল। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফছারুল আমীন দাবি করেন, সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশে পৌঁছেছে। অবশ্য এর পরের বছর একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ সাক্ষর। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে ৪৫২ কোটি টাকার নিরক্ষরতা দূরীকরণ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদনের সময় পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, সাক্ষরতার হার ৬৭ ভাগ। আর ইউএনডিপির সর্বশেষ (২০১৪ সালের) পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক নিরক্ষর জনগোষ্ঠী হচ্ছে ৫৭ শতাংশ। আর গত ৭ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে গণশিক্ষামন্ত্রী বলেন, এ নিয়ে লেটেস্ট কোনো সার্ভে নেই। আমার নির্বাচনী এলাকাসহ অনেক এলাকাই ২০১৬ সালে শতভাগ মানুষ সাক্ষরতার আওতায় এসেছে। সেই হিসাবটা তেমনভাবে আসছে না। এসব ধরেই আমরা বলছি, এখন সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ।
ক্যাম্পের সূত্র জানিয়েছে, সাক্ষরতার পর্যায়, দক্ষতা অর্জন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং এসবের আর্থসামাজিক সম্পর্ক উদ্ঘাটনে এ স্টাডি চালানো হয়। দেশব্যাপী খানাজরিপ, সাক্ষরতা মূল্যায়ন পরীক্ষা এবং প্রশ্নমালা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় সমীক্ষায়। নমুনার বয়স সর্বনিু ১১ বছর। গোটা দেশকে দুটি নগরসহ ৯ ভাগে ভাগ করা হয়। মোট ১১ হাজার ২৮০ জন ব্যক্তির মাঝে এ সমীক্ষা চালানো হয়। নমুনার মধ্যে সাড়ে ৫৩ শতাংশই নারী। গত ১২ মে থেকে ১৮ জুলাই এ সমীক্ষা চলাকালে সাক্ষরতা-পরীক্ষা উত্তরদাতাদের বাড়িতেই নেয়া হয়। আগামী ১৯ ডিসেম্বর এ প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় গেলে ২০১১ সালের মধ্যে দেশে সাক্ষরতার হার শতভাগে উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছিল।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.