নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছেন হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জমি দখল, মাদক ব্যবসা, প্রতারণা এমনকি বিদ্যুৎ চুরির আসামিরাও। প্রার্থীদের মধ্যে অন্তত ১০ জন জেলা পুলিশ ও র্যাবের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। কাউন্সিলর পদে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন না হওয়ায় প্রার্থীদের কোনো দলীয় পরিচয় থাকছে না। তবে অভিযুক্ত প্রার্থীদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় রাজনীতিতে পদধারী নেতা বা এ দুই দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হবে। ২৭টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৫৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অভিযোগ মূলত সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। তবে ৭ মেয়র প্রার্থী ও ৩৮ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে থানায় বা সাধারণ মানুষের তেমন কোনো অভিযোগ নেই। জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁদের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী, অপরাধী ও নারায়ণগঞ্জের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণকারী অনেকেই এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা এখন জামিনে আছেন। ফলে পুলিশের কিছু করার নেই। তবে এর মধ্যে কারও জামিন বাতিল হলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মতিয়ার রহমান বলেন, ‘যাঁরা মামলার আসামি জামিনে থাকবেন না, তাঁরা নির্বাচন করতে পারবেন না। নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও সুন্দর করতে সন্ত্রাসীদের সাথে কোনো আপস নেই। যারা নির্বাচনকে ভুল পথে চালাতে চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।’ নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আরিফুল হক হাসানের বিরুদ্ধে মাদক মামলায় গত বছরের ২৮ মে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। আরিফুল স্থানীয়ভাবে নূর হোসেনের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত। চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল র্যাব-১১-এর সদস্যরা আরিফুলসহ ৪ জনকে মাদকসহ গ্রেপ্তার করেন। পরে আরিফুলসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাঁকে সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদ থেকে বরখাস্ত করে। নূর হোসেনের কাউন্সিলর পদ শূন্য হওয়ার পর উপনির্বাচনে তাঁর সহযোগী আরিফুল হাসান কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসারও অভিযোগ আছে। তাঁর নামে থাকা দুটি অস্ত্রের লাইসেন্সও জেলা প্রশাসন বাতিল করে। আরিফুল বলেন, তিনি সব মামলা থেকে জামিনে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো সাজানো। নগরীর ১২ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন নগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক শওকত হাশেম ওরফে শকু। তিনি ২০০১ সালের ১৬ জুন নগরীর চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বোমা হামলায় ২০ জন খুনের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত (চার্জশিট) আসামি। জেলহত্যা মামলার আসামি ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেমের ছোট ভাই শকু। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিশেষÿক্ষমতা আইনে পুলিশ নাশকতার অভিযোগে কাউন্সিলর শওকতকে গ্রেপ্তার করে এবং পরবর্তী সময়ে তাঁকে ঢাকায় নিয়ে টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নারায়ণগঞ্জের র্যাব ও পুলিশের সন্ত্রাসীর তালিকার প্রথম ১০ জনের মধ্যে ১ জন এই শওকত। অবশ্য তিনি এখন জামিনে আছেন। জানতে চাইলে শওকত হাশেম বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে তার সবই রাজনৈতিক। এখন তিনি জামিনে আছেন। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি কোনো অপরাধী নন। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে জেলার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে নাম রয়েছে মহানগর শ্রমিক লীগের সদস্যসচিব কামরুল হাছান ওরফে মুন্না ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবলীগের আহ্বায়ক মতিউর রহমান ওরফে সুন্দর মতির বিরুদ্ধে। কামরুল ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে এবং মতিউর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী। নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় কামরুল তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা ৭টি মামলার কথা উল্লেখ করেছেন। মামলাগুলো সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, দখল, প্রতারণা, বিদ্যুৎ চুরির বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী যুবলীগের নেতা মতিউর রহমান হলফনামায় তাঁর বিরুদ্ধে ২২টি মামলার কথা উল্লেখ করেছেন। মামলার মধ্যে আছে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমি দখল, দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রভৃতি। সদর থানার পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের মে মাসে মাদক ব্যবসার অভিযোগে মতিউরকে ধরতে পুলিশ তাঁর আইলপাড়ার বাসায় অভিযান চালায়। কিন্তু বাসায় যাওয়ার সামনের সড়কে বসানো সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মতিউর পালিয়ে যান। এ প্রসঙ্গে মতিউর প্রথম আলোকে বলেন, তিনি রাজনীতি করেন। ব্যবসা করেন। দীর্ঘদিন রাজনীতি করার কারণে প্রতিপক্ষ এসব মামলা দিয়েছে। তারাই নানা অভিযোগ ছড়াচ্ছে। এগুলো ঠিক না। তিনি জামিনে আছেন। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী গোলাম মুহাম্মদ সাদরিলের বিরুদ্ধে হত্যাসহ ৯টি মামলা আছে। তিনি বিএনপিদলীয় সাবেক সাংসদ মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের ছেলে। ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক মাকছুদুল আলম খন্দকারের হলফনামা অনুযায়ী বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে এখন ২৪টি মামলা চলমান রয়েছে। অতীতে ছিল আরও ৩টি। মাকছুদুল জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকারের ছোট ভাই। মাকছুদুল বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে করা বেশির ভাগ মামলাই নাশকতার। ২০১৩ সালের শেষে ও ২০১৫ সালে করা। এ ধরনের মামলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অনেক আছে। র্যাব ও পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী অহিদুল ইসলাম ওরফে ছক্কু নগরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী। অহিদুল ১১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। ছাত্রদলের সাবেক নেতা। অহিদুলের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। অহিদুল নগরের খানপুরে মোকরবা রোড এলাকায় ব্যবসায়ী আবু তাহেরের ছেলে ইব্রাহীম রনিকে (২৮) বাসা থেকে ডেকে গুলি করে হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত (চার্জশিট) আসামি। এ ছাড়া ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর নগরীর গলাচিপা মোড়ে পুলিশের ওপর ককটেল নিক্ষেপের ঘটনায় দায়ের করা মামলায়ও অভিযোগপত্রভুক্ত। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শাহজালাল বাদল সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের আপন ভাতিজা। তাঁর বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির ৮টি মামলা এবং যশোরের কোতোয়ালি থানায় ১টি প্রতারণার মামলা রয়েছে। তাঁর নামে থাকা ২টি অস্ত্রের লাইসেন্স জেলা প্রশাসন ২০১৪ সালে বাতিল করেছে। সাত খুনের ঘটনার পর শাহজালাল এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এলাকায় ফেরত এলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। ১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী রওশন আলীর বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ৩টি মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একই ওয়ার্ডের প্রার্থী যুবলীগের নেতা ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে দুটি মামলা ছিল। সেই মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। এই ওয়ার্ডের আরেক প্রার্থী বিএনপি নেতা সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২টি মামলা বিচারাধীন। ২ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী বিএনপি নেতা ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৪টি মামলা বিচারাধীন। নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তাঁর ৪ সহযোগী হত্যার মামলার এজাহারে ইকবাল হোসেনের নাম থাকলেও পরে অভিযোগপত্র থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান জানান, জনপ্রতিনিধি যদি হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, বিদ্যুৎ চুরি, জমি দখল মামলার আসামি হন, তাহলে সেই নগর শান্ত হবে না। এ ক্ষেত্রে ভোটারদের সচেতন হতে হবে, যাতে কোনো খারাপ লোক নির্বাচিত হতে না পারেন। আরও যেসব কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা ছিল ও আছে: ২ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল হেকিমের বিরুদ্ধে ১টি মামলা রয়েছে। ৩ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী যুবলীগের নেতা তোফায়েল হোসেনের বিরুদ্ধে ২টি মামলা বিচারাধীন। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগের নেতা নজরুল ইসলামের ৩টি মামলা এবং ৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী নজরুলের বিরুদ্ধে ১টি মামলা রয়েছে। ৬ নম্বর ওয়ার্ডে সিরাজুল ইসলাম মণ্ডলের বিরুদ্ধে ১টি মামলা বিচারাধীন আছে। ৭ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের নেতা আলা হোসেন আলার বিরুদ্ধে ৩টি মামলা, হুমায়ূন কবীরের বিরুদ্ধে ৩টি এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা উজ্জ্বল হোসেনের বিরুদ্ধে ৪টি মামলা, আওয়ামী লীগের নেতা মহসিন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ৩টি মামলা, যুবদলের নেতা দেলোয়ার হোসেন খোকনের বিরুদ্ধে ৭টি মামলা, সাগর প্রধানের বিরুদ্ধে ৪টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ইস্রাফিল প্রধানের বিরুদ্ধে ১টি মামলা, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী শাহেন শাহ আহম্মেদের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা, আওয়াদ হোসেনের বিরুদ্ধে ১টি মামলা, ২১ নম্বর ওয়ার্ডের হান্নান সরকারের বিরুদ্ধে ৩টি, খোরশেদ আলমের ১টি, রেদওয়ানুল হক মামুনের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা, নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে ৪টি মামলা রয়েছে। ২২ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ জন প্রার্থী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সুলতান আহমেদের বিরুদ্ধে ৪টি, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে রাহাত মিয়ার বিরুদ্ধে ৩টি মামলা, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের এনায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে ৩টি, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কামরুজ্জামান বাবুলের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা আছে।