নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও শক্তিশালীকরণে বিএনপির প্রস্তাবনাকে সরকার আমলে না নিলেও দলটি এই ইস্যুতে ক্ষমতাসীনদের চাপে রেখে জনমত সৃষ্টি করতে চাইছে। দলটির দায়িত্বশীলদের পর্যবেক্ষণ, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে জনমত সৃষ্টি করতে পারলে পরবর্তী সময়ে ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের’ যে কথা তারা বলছে, সে বিষয়েও ইতিবাচক ফল আনা সম্ভব।
তবে বিএনপি এর আগে ইসি গঠনের ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী ব্যবস্থা চাইছে, যা সব দলমতের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। ইসি পুনর্গঠন নিয়ে খালেদা জিয়া যে প্রস্তাবনা দিয়েছেন, সেটিকে সময়োপযোগী বলছেন দলটির নেতারা। এজন্য রাষ্ট্রপতির কাছে দলের প্রস্তাবনা এরই মধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছে বিএনপি। আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হচ্ছে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ। এই পরিস্থিতিতে গত ১৮ নভেম্বর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন ও শক্তিশালীকরণের প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপির বেশ কিছু প্রস্তাবনা ও সুপারিশ তুলে ধরেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে পরে এক টুইট বার্তায় বলেন তিনি। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ওই প্রস্তাবের বিপরীতে বলছে, সংবিধানে যেভাবে আছে সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। তিনিই ইসি নিয়োগে সবার সঙ্গে মতবিনিময় করবেন, সবার মতামত নেবেন। এ বিষয়ে গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগে মানুষ হত্যার জবাব দিন, পরে প্রস্তাব নিয়ে কথা হবে। নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি যে পদক্ষেপ নেবেন, সেটাই হবে। এখানে তাদের বলার কিছু নেই। এদিকে বিএনপির প্রস্তাবনা নিয়ে সরকার নেতিবাচক বক্তব্য রাখলেও তাতে আশা হারাচ্ছে না বিএনপি। বরং ইসি পুনর্গঠন নিয়ে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবনার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে কাজ করছে দলটি। এজন্য সভা- সেমিনারসহ প্রস্তাবনাটি জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাইছে বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনে বিএনপির প্রস্তাবের অনুকূলে জনমত গড়ে তুলতে পারলে ভবিষ্যতে তা দলের জন্য বড় অর্জন হিসেবে দেখা দেবে। তাদের পর্যবেক্ষণ, এই মুহূর্তে সরকারের জনপ্রিয়তা নেই। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে বিএনপি অনেক এগিয়ে থাকবে। সেজন্য অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করাই দলটির লক্ষ্য। আর এতে নিরপেক্ষ ইসি গঠনের বিকল্প নেই। সেজন্য যে করেই হোক, দল নিরপেক্ষ ইসি গঠনে খালেদা জিয়ার প্রস্তাবনার সূত্র ধরে সরকারকে চাপে রাখতে সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টা করবে দলটি। সেজন্য সরকার না চাইলেও প্রস্তাবনা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চলতে থাকুক- সেটিই চাইছে বিএনপি। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে নামতে চাইছে দলটি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার মতো কোনো প্রসঙ্গ সরকারি দল খুঁজে পাচ্ছে না। খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে সরকারি দল এখন নার্ভাস ফিল করছে। তিনি বলেন, কোনো দল বা গোষ্ঠীর জন্য নয়, দেশের জনগণকে মাথায় রেখে বিএনপি চেয়ারপারসন কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে আলোচনার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছে বিএনপি, আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য সমাধান চায়। অন্যদিকে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এ বিষয়ে সরকারকে বাধ্য করতে দলমত নির্বিশেষে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন প্রয়োজন, যাতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফল ঘটে। এর মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এজন্য সরকারকে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনে বাধ্য করতে হবে। এদিকে এরই মধ্যে ইসি নিয়ে খালেদা জিয়া যে প্রস্তাবনা দিয়েছেন সেটির কপি ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের দেয়া হয়েছে। দেশের উন্নয়ন সহযোগী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছেও তা পাঠানো হয়েছে। জনগণের কাছে প্রস্তাবনা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে এর কপিও বই আকারে ছাপানো হয়েছে। ইসি গঠন ও শক্তিশালীকরণে দেশের বিভিন্ন স্থানে সভা-সেমিনার শুরুও করে দিয়েছে বিএনপি। এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, ধারাবাহিকভাবে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে সভা-সেমিনার হবে। এরপর ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের এই আন্দোলনের সঙ্গে জনগণকে জনসভার মাধ্যমে আরও সম্পৃক্ত করা হবে। নিরপেক্ষ ইসি গঠন, বিএনপির প্রস্তাব এবং সরকারের অবস্থান নিয়ে জানতে চাইলে প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, পক্ষ বা নিরপেক্ষ নয়, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনই হচ্ছে মূল কথা। এক্ষেত্রে বিষয়টি হচ্ছে, বেশিরভাগের কাছে সেই কমিশন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে কি না। তিনি বলেন, দেখতে হবে সেটি মেজরিটি পারসনের কাছে একসেপ্টেবল হচ্ছে কি না। বিষয় হচ্ছে- ইসি কিভাবে তৈরি হচ্ছে, সেখানে কারা থাকবে। কারণ, নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। দু’চারটি কমিশন ছাড়া অন্যগুলোর দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা হয়েছে। এখানে ব্যক্তিগত ইমেজের ব্যাপার আছে, সোসাইটি, পরিবেশের ব্যাপার আছে। প্রাক্তন এই নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, ইসি গঠনের আগে সার্চ কমিটি নিয়েই যদি বিতর্ক এসে যায়, তাহলে এই প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে। সেজন্য সার্চ কমিটি নিয়ে যাতে বিতর্ক না হয়, সেটিই রাষ্ট্রপতি দেখবেন। ইসি গঠনের প্রস্তাব নিয়ে রাষ্ট্রপতি কাছে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বিএনপি ইসি পুনর্গঠনের প্রস্তাব নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছে। দেখা যাক কী হয়। তিনি অবশ্যই ভালো কিছু করবেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.