নেওয়া হচ্ছিল বাল্যবিবাহের খোঁজ। একপর্যায়ে তা বাদ দিতে হলো। এর বদলে খোঁজ নেওয়া শুরু করতে হলো প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর কজনের বিয়ে হয়েছে—সেই তথ্য। পাওয়া গেল মাত্র একজনকে। তাঁরও বিয়ে দেরিতে হয়েছে বর না পাওয়ার কারণে। এ অবস্থা রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের চর তারানগর ও চর খিদিরপুর গ্রামের। সম্প্রতিএ দুটি গ্রামের প্রায় ছয় শ পরিবারে খোঁজ নিতে গিয়ে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই বাল্যবিবাহের নজির পাওয়া গেল। বিষয়টি স্বীকার করে মুঠোফোনে ইউপির চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বলেন, ‘ওই দুটি গ্রামের সব মেয়েকেই অল্প বয়সে গোপনে বিয়ে দেওয়া হয়। বেশির ভাগ সময় নিবন্ধন করা হয় না। তাই আমরা জানতে পারি না। বাল্যবিবাহের দায়ে শাস্তি দেওয়া হলে হয়তো এই প্রবণতা কমবে। পাশাপাশি জনসচেতনতামূলক কাজও করতে হবে।’ সরেজমিনে দেখা যায়, পদ্মার ভাঙনে গ্রাম দুটি ভেঙে ছোট হয়ে এসেছে। গ্রাম দুটির প্রায় তিন শ পরিবার নদীর মধ্যে চরে এসে বসতি গড়েছে। তারপরও ভাঙনে ছোট হয়ে যাওয়া তারানগর ও খিদিরপুরে আড়াই থেকে তিন শ পরিবার থেকে গেছে। গ্রাম দুটিতে দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। এবারের নদীভাঙনে একটি বিদ্যালয় নদীর মধ্যের ওই চরে সরিয়ে নিতে হয়েছে। নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষার জন্য রয়েছে ‘আলোর পাঠশালা’ বিদ্যালয়। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয় শাহিনা খাতুনের। এক বছরের মাথায় সন্তানের মা। এর দুই বছর পর হয় আরও এক সন্তান। এখন শাহিনা পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। দেখে মনে হয়, অনেক বয়স হয়ে গেছে। আদতে তা নয়। তাঁর প্রথম সন্তানের বয়স এখন পাঁচ বছর। মেয়েকেও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে দেবেন কি না জানতে চাইলে, শাহিনা বলেন, ‘আমার মা-বাবা পাগল আছিল। আমরা তো আর পাগল না। মেয়ের বিয়ের বয়স হলে পরেই দেব।’ এক বছর আগে বিয়ে হয়েছে রুনা খাতুনের। তখন সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। এখন ঘরকন্না সামলাচ্ছে। বাড়ি গিয়ে দেখা যায় রুনা রান্নার কাজে ব্যস্ত। তার শাশুড়ি রোজিনা বেগম বলেন, বিয়ের পরও ছেলের বউকে অষ্টম শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। এই-ই অনেক। আর পড়াবেন না। এ দুটি গ্রামের মেয়েদের মধ্যে একমাত্র প্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হয়েছে নীলা বেগমের। তাঁর বয়স এখন ৩২। তাঁর মা রওশন আরা বেগম বলেন, ছেলে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই মেয়ের বিয়েতে দেরি হয়েছিল। প্রায় ২০-২২ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। এরপর স্বামী তালাক দিয়েছেন। এই চরে প্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হওয়া আরও দুজন নারীকে পাওয়া গেল। তাঁরা হলেন সফেদা বেগম (৪৫) ও মরিয়ম বেগম (৩৩)। তাঁরা দুজনেই পবা উপজেলার অন্য গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। বিয়ের পরে এই চরে এসেছেন। চর তারানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শামীমা আক্তার বলেন, এ বছরও এ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। গত বছর দুজন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছিল। এ রকম তো প্রতিবছরই হয়। প্রথম আলো ট্রাস্ট পরিচালিত আলোর পাঠশালার প্রধান শিক্ষক আরিফ হোসেন বলেন, এই বিদ্যালয় হওয়ার আগে এই এলাকার সব মেয়েরই পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার আগে বা পরেই বিয়ে হয়ে যেত। এখন তাঁরা অনেক বুঝিয়েও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে নিয়ে আসতে পারছেন না। হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ও চর খিদিরপুর গ্রামের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা বলেন, এখানে অল্পবয়সী মেয়েদের গোপনে বিয়ে হয়। কেউ টের পায় না। দু-একটা বাচ্চা হওয়ার পর তাঁদের কাছে বয়সের কাগজ নিতে আসে। তখন তো আর বিয়ে ভেঙে দেওয়া যায় না। বাধ্য হয়েই কাগজ দিতে হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সেলিম হোসেন বলেন, চরের ওই গ্রামগুলো বিচ্ছিন্ন এলাকায় হওয়ার কারণে প্রশাসনের নজরদারি কিছুটা কম থাকে। ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানরাও সেখানে স্থায়ীভাবে থাকেন না। তা ছাড়া সেখানকার লোকজন সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে আগেভাগেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া কর্তব্য বলে মনে করেন। প্রশাসন জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু ওখানকার বিষয়টি সেভাবে প্রশাসনের নজরে আসে না।