নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে অনুসন্ধান কমিটির (সার্চ কমিটি) প্রস্তাবিত নামগুলো আগেভাগে প্রকাশ করার পক্ষে মত দিয়েছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা। তাঁর যুক্তি হচ্ছে নামগুলো প্রকাশ করা হলে তাঁদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে। গণমাধ্যম তাঁদের চুলচেরা বিশ্লেষণ করবে এবং জনগণ তাঁদের সম্পর্কে জানতে পারবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিবেচনার সুযোগ পাবেন। গতকাল শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে শামসুল হুদা এ কথা বলেন। আজ রোববার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ শুরুর এক দিন আগে ‘দ্য ঢাকা ফোরাম’ নামের একটি নাগরিক সংগঠন এ বৈঠকের আয়োজন করে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বৈঠকে বক্তারা নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দেন। এর পাশাপাশি সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন তৈরির আহ্বান জানান। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ ফেব্রুয়ারিতে শেষ হবে। গতবারের মতো এবারও অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে নতুন কমিশন গঠন করার প্রস্তুতি চলছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আগে নাম প্রকাশ করার সুবিধা ব্যাখ্যা করে শামসুল হুদা বলেন, ভারতে কয়লাখনির লাইসেন্স দেওয়ার কারণে মামলা হওয়া এক ব্যক্তিকে দুর্নীতি দমনবিষয়ক সচিব করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। মনমোহন সিং বলেছিলেন, তাঁর অধীনে তিনি কাজ করেছেন, তিনি ওনাকে চেনেন। কিন্তু ভারতের গণমাধ্যম ও বিরোধী দল এমন হইচই শুরু করে যে তাঁর বদলে আরেকজনকে নিতে হয়। শামসুল হুদার মতে, ‘সেই সুযোগটা আমাদের এখনো আছে। কারণ, ফেব্রুয়ারিতে কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। অনেক আগে থেকে প্রস্তাবিত নামগুলো জানতে পারলে এবং গণমাধ্যম তৎপর হলে কিছু ভালো লোক আমরা পেতে পারি।’ সাবেক ওই প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, প্রতিবার নির্বাচন এলে চার-পাঁচ মাস আগে থেকে আলোচনা শুরু হয়। অথচ সারা বছর আর কোনো কথাবার্তা নেই। গতবার অনুসন্ধান কমিটির যে ফল পাওয়া যায়, সেটার দুর্বলতা ছিল। ওটা এমন সময়ে করা হয়, যখন তাঁরা বিদায় নিচ্ছিলেন। পরে শোনা যায়, কারও কারও ছাত্রজীবনে বা পরে দলীয় পরিচয় ছিল। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, অনুসন্ধান কমিটি করার প্রস্তাব দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, অনেক আগেই নামগুলো প্রকাশ হবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাঁর সব খবর বের করবেন। এই বিশ্লেষণটা গতবার দুর্ভাগ্যজনকভাবে হয়নি। তিন সদস্যের কমিশন চালিয়ে আসা শামসুল হুদা বড় আকারের ইসি গঠনে আপত্তি জানান। তাঁর যুক্তি, এতে জটিলতার সুযোগ তৈরি হয়। ভারতের দৃষ্টান্ত টেনে শামসুল হুদা বলেন, ভারতের মতো বড় দেশে নির্বাচন কমিশন তিনজনে চালাচ্ছেন। এখানে এতটুকু দেশে পাঁচজন থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। বিদায়ী কমিশনের কাজের সমালোচনা করতে গিয়ে এর বিশালত্বের দুর্বলতার দিকটি তুলে ধরেন শামসুল হুদা। তাঁর মতে, যেসব অকাণ্ড হয়েছে, সে জন্য সিইসিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ, সংবিধানে আছে, সিদ্ধান্ত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। কোনো সময় মতভেদ হলে ভোটাভুটি হবে। সুতরাং তাঁরা আরও চারজন নিলেন, এটা একটা সর্বনাশের সৃষ্টি করেছে। শামসুল হুদা মনে করেন, নিরপেক্ষ লোক নিয়োগ পেলে নির্বাচন কমিশনের বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোতেই নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব। তাঁর মতে, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কম নয়। প্রয়োগ করতে চাইলে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। তবে তিনি মনে করেন, ভালো নির্বাচন করা শুধু নির্বাচন কমিশনের একার দায়িত্ব নয়। বাংলাদেশে একটা ভালো নির্বাচন করতে হলে যেসব প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা লাগে, সেখানে সমস্যা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, ‘আমাদের সময় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দুইটা শর্ত ছিল। ভোটার তালিকা ঠিক করতে হবে এবং সব রাজনৈতিক দলকে অংশগ্রহণ করতে হবে। আমরা তিনবার নির্বাচনের তফসিল পরিবর্তন করেছি। কারণ, বিএনপি সম্মতি দিচ্ছিল না। কিন্তু আমরা দৃঢ় ছিলাম, বিএনপি না আসলে এই নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না।’ সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের জন্য যে সার্চ কমিটির কথা বলা হচ্ছে, তার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। সার্চ কমিটি একটা অ্যাডহক অ্যারেঞ্জমেন্ট, যেটা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান করেছেন। এখনো একটি অ্যাডহক সার্চ কমিটির কথা সবাই বলছেন। কিন্তু কেউই বলছেন না যে একটা আইন তৈরি হোক। আমরা এটা স্থায়ী করব।’ এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আইন প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও বিচার—এই তিন ধাপে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। সংসদ আইন প্রণয়ন করে। নির্বাচন কমিশন সেই আইন অনুসারে নির্বাচন করে। এতে কোনো বিরোধ দেখা দিলে বিচার করতে হয়। এই তিনের সমন্বয় না হলে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হয় না। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অন্যতম উপাদান। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করার ক্ষেত্রে একটা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়। কিন্তু এরপর ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও পৌর নির্বাচনের কারণে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি হয়েছে। এসব নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা দেওয়ার অবকাশ খুব একটা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও দ্য ঢাকা ফোরামের সভাপতি সালেহউদ্দিন আহমেদ সৎ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে যাতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠন হয়, সে জন্য গণমাধ্যমকে ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে আইনের শাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সেরাজুল ইসলাম। অন্যান্যের মধ্যে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক সচিব সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ, মিজানুর রহমান খান প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সঞ্চালনা করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মাসুদ আজিজ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.