গল্প-উপন্যাসই কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লেখালেখি। শুরুটা যদিও কবিতা দিয়ে। সেই স্বাধীনতার আগে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। লেখার বিষয় হিসেবে মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি নিবিষ্ট। ইতিহাসের প্রতি নিবেদিত থাকা তাঁর সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তে তাঁর সাহিত্যের চরিত্ররা লিপ্ত থাকে। ইতিহাসের চরিত্র নিয়েও তিনি লিখেছেন একাধিক উপন্যাস। দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের জীবন সংগ্রাম তিনি তুলে ধরেছেন। লোক-পুরান, পৌরাণিক চরিত্র ও কিংবদন্তির নানা অধ্যায় নিয়েও তিনি লিখেছেন। তবে ইতিহাসের প্রশ্নে তিনি বরাবরই বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাস, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, গণ-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদিকে বরাবরই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর লেখা সমালোচক ও পাঠকনন্দিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যকে নতুন সম্ভারে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।
দেশে কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই অন্যতম। লেখার সংখ্যা ও অনূদিত হয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার দিক দিয়েও তা বিবেচ্য। দেশ-বিদেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। লেখা ছাড়া বাংলা একাডেমি ও শিশু একাডেমির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। গত ১৪ জুন তিনি সত্তর-এ পা দিলেন। সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে এই কথাসাহিত্যিকের মুখোমুখি হয়েছিলেন অলাত এহ্সান।
অলাত এহ্সান : যদি এভাবে শুরু করি যে, কিছুদিন আগেই আপনার ৭০তম জন্মদিন পালন করলেন। এর মধ্যে অর্ধশত বছরের লেখকজীবন আপনার। এই অর্ধশত বছরে আপনার অনেক গল্প-উপন্যাসের বই আছে। এর মধ্যে উপন্যাসের সংখ্যাই বেশি। আমার কাছে আপনার বইয়ে বেশ দ্যোতনাময় মনে হয়। নামগুলোর কয়েকটা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়। যেমন ধরুন প্রকৃতিনির্ভর নাম, চিন্তানির্ভর, নদীনির্ভর আবার জীবনভিত্তিক। এভাবে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন যাপিত জীবন’, আবার ‘হেঁটে যাই জীবনভর’। মানে গল্প-উপন্যাসে তো নামকরণও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তো আপনি কীভাবে আপনার লেখার-বইয়ের নামকরণ করে থাকেন?
সেলিনা হোসেন : এটা তো আমাকে ভেবে বলতে হবে।
অলাত এহ্সান : আপনার গল্প-উপন্যাসগুলোর নামে একটা মিস্ট্রি আছে।
সেলিনা হোসেন : আসলে উপন্যাসের এই নামগুলো অনেক বিষয় থেকে বের করে এনেছি। আমি কতগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে নাম নির্বাচন করেছি। যেমন ‘নীল ময়ূরের যৌবন’।
আমাদের বাংলা ভাষার আদিনিবাস কিন্তু কয়েকশ শতাব্দীর বেশি। তার সঙ্গে আমি প্যারালাল করেছি আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা সংগ্রাম। আমি কোথাও উচ্চারণ করিনি। কিন্তু সেই দায়ভার থেকে দেখিয়েছি যে, কবি কাহ্নপা কীভাবে ভাষার জন্য লড়াই করছেন রাজ দরবারে, সংস্কৃত ভাষার বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত তাঁর হাতটা কেটে দেওয়া হয়েছে; যেহেতু তিনি রাজার জন্য কবিতা লিখতে রাজি হননি। আবার তাঁর বিরুদ্ধে অমানবিক আচরণের জন্য তাঁর জাতি-গোষ্ঠী, ওখানে ছিল তারা, নিম্নবর্গের মানুষেরা যখন বিদ্রোহ করছে, তখন তাদের ২৫ শে মার্চের রাতের মতো তাদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। কাহ্নপাকে নিয়ে যাচ্ছে অন্যরা, পাহাড়ের দিকে। তখন সেখানে একজন কাহ্নপাকে বলছে আপনাকে আমাদের দরকার, আপনি কবি, আপনি আমাদের পথ দেখাতে পারেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর একটা ছায়া এসেছে। আমি উপন্যাসটা শেষ করেছি এভাবে।
আমার কাছে এই উপন্যাসের নামটা যখন আসে, তখন মনে হয়েছিল আমি কি উজ্জ্বল সময়টাকে চিত্রিত করতে চাই? যা কিছু অত্যাচার, যা কিছু অন্যায় তার বিরুদ্ধে জিতেছে শুধু সংগ্রাম, দীপ্ত-দৃঢ় মানুষের দেখার জায়গা, তৈরি হওয়া জায়গা। এই যে, ‘নীল ময়ূরের যৌবন’। নীল ময়ূর এখানে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করেছি। ময়ূর যখন পেখন মেলে, তখন মনে হয় একটা বিশেষ দৃশ্য। সেই বিশেষ দৃশ্যের প্রতি আমরা অপলক তাকিয়ে থাকি। সবচেয়ে মনে হয়েছে তার তারুণ্যের প্রতীক, তার যৌবনের প্রতীক। এই রকম বিষয়টাকে ধরে আমি নামগুলো চিন্তা করেছি।
অলাত এহ্সান : আপনি বিষয় ধরে লেখেন, নামকরণের ভেতরেই দ্যোতনা থাকে, তাই না?
সেলিনা হোসেন : আমি আরেকটা বিষয় বলি। যেমন ‘পূর্ণছবির মগ্নতা’। যখন আমি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে বইয়ের নাম করেছি পূর্ণছবির মগ্নতা, তখন আমার মনে হয়ে শিলাইদহ-পতিসর পূর্ববঙ্গের এই সব অঞ্চলে না এলে রবীন্দ্রনাথের জীবনে জীবনকে দেখা, মানুষের দুঃখ-দৈন্য, প্রকৃতি দেখে রবীন্দ্রনাথের যে অসাধারণ স্মৃতিগুলো তাতে তিনি লিখছেন, এইগুলো তাঁর দেখা না হলে তিনি পূর্ণ হতেন না। সেই জন্যই বলেছি আমার এই ভূখণ্ডের ছবিই তাঁকে পূর্ণতায় মগ্ন করেছে। এ জন্যই ‘পূর্ণছবির মগ্নতা’। এই দেশকে দেখা, মানুষকে দেখা, দারিদ্র্যকে দেখা, প্রকৃতি দেখা, মানুষের জীবন দেখা, সংগ্রাম দেখা, এমনকি অস্পৃশ্যতা দেখা। একথা তো বলেছেন তিনি চিঠিতে কলকাতায় থাকলে আমি এই দৃশ্য দেখতে পেতাম না। জীবনটা যে কতটা আশ্চর্য সুন্দর, তাও আমি উপভোগ করতে পারতাম না।
অলাত এহ্সান : সাহিত্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে যে, লেখক সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ করতে গিয়ে, জীবনের প্রতি দায়বদ্ধ হতে গিয়ে শিল্পকে বঞ্চিত করে?
সেলিনা হোসেন : না, প্রথমেই শিল্পসম্মত রচনা হতে হবে। এই দায়বদ্ধতার জায়গাটা আমি শিল্পসম্মত করে প্রকাশ করব। আমি যখন একটি চরিত্রের, একটি আবেগের জায়গা বর্ণনা করি তখন একটু লিরিক্যাল বর্ণনা হয়। তখন আমাকে অনেকে বলেন আপনার গদ্যটা কবিতা আক্রান্ত। এখানে আমি আপত্তি করি এজন্য যে, আমার শিল্পসম্মত রচনায় যদি একটি ক্যারেক্টারের এই আবেগের জায়গা থাকে তাহলে গদ্যটা এ রকম হবে না কেন? তাহলে তো আমার রচনা মার খাবে।
রচনা শিল্পসম্মত না হলে তো পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করতে পারবে না। তাহলে তো এটা পত্রিকার রিপোর্ট হবে। পত্রিকাতে আমাদের জীবনের অনেক কিছু রিপোর্ট করে। তাকে তো আমরা সাহিত্য বলি না।
অলাত এহ্সান : তাহলে কি আপনি এটা বলবেন যে, আপনার উপন্যাসগুলো যে সামাজিক বক্তব্য প্রধান হয় সেটা আপনি খুব সচেতনভাবেই করেন।
সেলিনা হোসেন : আমি খুব সচেতনভাবেই করি এবং শিল্পের জায়গা রক্ষা করেই করি। আমি কখনোই স্লোগানসর্বস্ব সংলাপ গল্পে ব্যবহার করি না। আমি যে স্লোগান মিছিলে দেব, সাহিত্যে ওটাকে সেভাবেই আনব না। আমি খুব সচেতন এই ব্যাপারে।
অলাত এহ্সান : তবে আপনার সাহিত্য নিয়ে এ পর্যন্ত যেসব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, তারা একটা বিষয় গুরুতরভাবেই সামনে এনেছেন, আপনি সাহিত্যকে সমাজবদলের হাতিয়ার হিসেবে দেখেন। ব্যাপারটা কি তাই? বা আপনি সাহিত্যকে কীভাবে দেখেন?
সেলিনা হোসেন : না, সমাজবদলের হাতিয়ার হিসেবে না। আমি ওভাবে বলব না। তবে সাহিত্য একজন মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পারে, সেই জায়গা থেকে আমি দেখি। মানুষ একে সমাজবদলের হাতিয়ার হিসেবে দেখবে কি না, ওই জায়গা আমি উপস্থান করব না। যিনি পাঠক তিনি ঠিক করবেন তিনি কী করবেন।
অলাত এহ্সান : সে ক্ষেত্রে সাহিত্যের যে বিনোদন উপযোগিতা, আমরা বারবার এই দ্বন্দ্বে উপনীত হই যে, সেটা খাটো হয়ে যায় কি না?
সেলিনা হোসেন : সাহিত্যের বিনোদন উপযোগিতা বলতে কী বোঝায়? ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল…’ এটা কি স্লোগান, না সংগীত?
অলাত এহ্সান : এক অর্থে সংগীত তো বটেই, বিশেষ সংগীত। তবে এখানে সময় ও প্রেক্ষিত বিবেচনায় আসছে। এটাকে আমরা গণসংগীত মনে করি। তবে একই সঙ্গে এটা স্লোগানের কাজটাও করে দিয়েছে।
সেলিনা হোসেন : কিন্তু সেই সুর, সেই বাণীর অপূর্ব সমাবেশ সবকিছু মিলিয়ে সেটা তো আর স্লোগান থাকছে না। কিন্তু বক্তব্যটা ভেতরে থেকেই যাচ্ছে। আমার সাহিত্যকে, আমার গল্প-উপন্যাসকে আমি এভাবে তৈরি করি। ভেতরে একটা মুখোশ থাকবে, কিন্তু সেটা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে যাবে। এর মানে এটা কোনো স্লোগান নয় যে আমি মিছিল বলব।
অলাত এহ্সান : সেক্ষেত্রে আমি আপনার লেখা নিয়ে একটা সমালোচনাকে উদ্ধৃত করতে পারি। সমালোচক বলছিলেন যে, আপনার সাহিত্যে নারী-চরিত্রগুলো বলিষ্ঠ, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও ঠিক তারা পুরুষতান্ত্রিক। সেটা কখনো পুরুষতন্ত্রকে মেনে নিচ্ছে, কিন্তু বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসছে না।
সেলিনা হোসেন : বেরিয়ে আসছে না? আচ্ছা, আমি একটা ঘটনা বলি। না পড়ে এই ধরনের সমালোচনায় আমি খুব বিরক্ত বোধ করি। ‘মতিজানের মেয়েরা’ আমার একটা গল্প আছে। সেই গল্পে মতিজান যখন ওর শ্বশুরবাড়ি গেল। ওর শাশুড়ির সঙ্গে ওপর প্রধান দ্বন্দ্ব হলো শাশুড়ি ওকে কনট্রোল করে নানাভাবে। তার স্বামী শ্বশুড়-শাশুড়ির একমাত্র ছেলে। এখানে নারীর যে একটা আধিপত্যের ব্যাপার সেটাকে চিত্রিত করা। আবার পুরুষের সঙ্গে ওর সংসারটা জমছে না। স্বামী বাজারে পতিতালয়ে যেতে বেশি পছন্দ করে। তার ফলে মাঝখানে ওর কোনো সন্তানও হচ্ছে না। এসবের মধ্যে বিয়ের কয়েক বছর পার হওয়ার পর শাশুড়ি দাবি করছে আমার বংশ রক্ষা করতে হবে, আমার সন্তান চাই। তোমার তো বোধহয় সন্তান হবে না, তাহলে আমি ছেলেকে আবার বিয়ে করাব।
তার ছেলেটা বাজারের এখানে-ওখানে সময় কাটায়, কারো সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক না। সে মায়ের এই আধিপত্যের জায়গাটা মানে না, আবার কোনো প্রতিবাদী ভূমিকাও পালন করে না। সে অন্য জায়গায় চলে যায়। এটা হিউম্যান ক্যারেক্টার। ওভাবে তৈরি করা যে, সমাজে নানা ক্যারেক্টারের লোক হতে পারে, সেই অর্থে। তো স্বামীটা বাজার থেকে সদাইপাতি করে যা লাগে সংসারে, তা হাট-বাজার করে একজন লোক দিয়ে বাড়িতে পাঠাত। ওই লোকের সঙ্গে ওর বৌয়ের সম্পর্ক হয়, দৈহিক সম্পর্ক হয় এবং সে প্রেগনেন্ট হয়।
গল্পে দুবার সে মা হয়। যখন সে প্রথম মা হলো তখন শাশুড়ির পরাজয় হলো যে, তাকে বাঝা বলা হতো, তার সন্তান হবে না। সে ক্ষিপ্ত হলো। আবার যখন সে দেখল মেয়ে হয়েছে, তখন সে অন্যরকম মূর্তি নিল আমার ছেলে চাই, নইলে আমার বংশ হবে না। দ্বিতীয়বারও মেয়ে হলো। একদিন সে লোকজন ডেকে বলল যে, এই মেয়েকে আমি বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেব, আমার ছেলেকে আবার বিয়ে করাব। তখন আমার সেই মতিজান বলছে যে, আপনার ছেলের জন্য যদি আমি অপেক্ষা করে থাকতাম তাহলে এই মেয়ে দুটোও আমার পাওয়া হতো না।
তাহলে তারা কী করে বলবে যে, আমার গল্পের চরিত্ররা গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারছে না?
আবার ‘আনবিক আঁধার’ উপন্যাসে আমি দেখিয়েছি, সেখানে কিন্তু মেয়েটি ঘর করবে, কারণ তার সন্তান আছে। মেয়েটি যখন দেখছে লোকটি অন্য নারীর কাছে যাচ্ছে, তখন আমি অন্য পুরুষের কাছে যেতে পারি না কেন? সে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কিন্তু সে ধাক্কা খাচ্ছে তার প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য যে, এই প্রতিবন্ধী সন্তানের খুব কষ্ট হবে। মা হিসেবে আমি তাকে কোথায় নিয়ে ভাসাব। আমি তা পারব না। আমি আমার মতো করে এনজয় করব আবার ছেলেটার জন্য ঘর ঠিক রাখব।
এই সিদ্ধান্তগুলো কি পুরুষতান্ত্রিক? এটা কি আপস করা?
অলাত এহ্সান : হ্যাঁ, তাহলে আপনাকে নিয়ে ওই সমালোচনা খণ্ডন হয়ে যাচ্ছে।
সেলিনা হোসেন : এ রকম অনেক চরিত্র আছে আমার গল্প-উপন্যাসের ভেতরে। আমি রেখেছি। কারণ আমাকে জীবনের পক্ষে কাজ করতে হবে। ইচ্ছে করলেই সারাক্ষণ ঘরে ভেঙে দেওয়াটা আমি যুক্তিযুক্ত মনে করি না। গল্পে কিন্তু আমাকে ধরতে হবে কতটা জীবনে পক্ষে, কতটা সমাজের পক্ষে, কতটা মানবিক চেতনাবোধের পক্ষে।
অলাত এহ্সান : আপনার সাহিত্যের যে জায়গাটা, একবার আপনাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি দেখিয়েছিলাম, আপনি ইতিহাসের এমন মুহূর্তের ভেতর দিয়ে হাঁটছেন যে, ইতিহাসের ওই পর্বগুলো আপনার লেখায় আবেদন তৈরি করছে এবং আপনি দায়িত্বের জায়গা থেকে তার স্বীকৃতি দিচ্ছেন। এই যে ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধ-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনের যে সংকট ইত্যাদি। আপনি এখন কোন বিষয় নিয়ে লিখছেন? এর আগে একবার আপনার সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম যে, আপনি অধুনালুপ্ত ছিটমহল নিলে লিখবেন। এবং আপনি এটা নিয়ে লিখলেনও ‘ভূমি ও কুসুম’। এখন কী নিয়ে লেখার কথা ভাবছেন?
সেলিনা হোসেন : গত বছরে যেটা প্রকাশ হয়েছে ‘হেঁটে যাই জনম ভর’। এটার একটা আলোচনা করেছে মোজাফফর হোসেন। তার আগের বছর প্রকাশ করলাম ‘দিনকালের কাঠ-খড়’। সেটা সুন্দরবনের পটভূমি, তারপরে সীমান্ত এলাকার পটভূমিতে লেখা। আসলে ঘটনাটি ফালানি নিয়ে। আমি অবশ্য বলি না সেখানে ফালানি কাজ করতে যাচ্ছে, গুলিবিদ্ধ হলো। তার আগে অনেক কিছু আছে। জলবায়ু পরিবর্তন। মানুষ কীভাবে জীবন-যাপন করছে। আসলে অনেকেই পড়ে না। না পড়ে, বহুদিন আগে পড়া একটা কিছু নিয়ে আলোচনা করে।
অনেকেই তো বলে, শহিদুল জহিরের উপন্যাস কিছু হয় নাই। আমি তো বলি, শহিদুল জহির একশো পৃষ্ঠার মতো একটা উপন্যাস লিখেছেন ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’, এর চেয়ে বড় লেখা আর কী হতে পারে? শক্তিশালী উপন্যাস। অনেকেই না পড়ে মন্তব্য করে তো!
আমার ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ থেকেও আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসটা। যেখানে আমি ছেলেটি ও মেয়েটির ভুবন দেখাচ্ছি। সেখানে ছেলেটি পা হারিয়ে এসেছে, আর মেয়েটি প্রেগনেন্ট পাকিস্তানি আর্মিদের দ্বারা। মেয়েটি বলছে তুমি পা দিয়েছো, আমার জরায়ু গেছে। আমরা একদিন ঠিক হয়ে হাত ধরে হাঁটব। ছেলেটি রাজি হচ্ছে। এসব জায়গাগুলো পরিবর্তনের কথা বলে উপন্যাস শেষ হয়েছে। ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসটায় আমি ‘১১ নাম্বার সেক্টর’কে ধরতে চেয়েছি। তারপরে রংপুরের জেলায় সৈয়দপুর। সেখানে আমার উপন্যাসের একটা ক্যারেক্টার করেছি লোকটাকে। কোনো নাম দেইনি, লোকটি যাচ্ছে। এটা তো ইতিহাসে একটা পৃষ্ঠা। লোকটি যাচ্ছে, এখানে যাচ্ছে ওখানে যাচ্ছে। যেখানে দেখাচ্ছি, ভাষা আন্দোলনে একটা ছেলে প্রাণ দিয়েছে, তার কোনো হদিস নেই। অনেকেই তো প্রাণ দিয়েছে। তাকে ট্রেস করে রাখা হয়নি। বাড়িতে তার স্ত্রী ছিল। আমি যুদ্ধের সময়টা নিয়ে আসছি। তার একটা ছেলে ছিল, সে কীভাবে গল্পটা বের করে নিয়ে যাচ্ছে। এই পুরো বিষয়টা ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসে এনেছি।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটায় আবেগের জায়গা তৈরি করেছে যে, মা ছেলেটাকে উৎসর্গ করেছে। তারা ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসটা পড়ে কথা বলে না।
অলাত এহ্সান : তো যদি প্রশ্নে ফিরি, আপনি এই মুহূর্তে কী নিয়ে লিখছেন বা লিখতে চাচ্ছেন। আমরা তো দেখি আপনি একেক সময় একেকটা বিষয় নিয়ে ভাবেন, প্রস্তুতি নেন, তারপর উপন্যাস লেখেন।
সেলিনা হোসেন : এই মুহূর্তে আমি (১৯৭১ সালের) ৭ই মার্চের বিকেলটা ধরে একটা উপন্যাস করার চেষ্টা করছি। সমকাল ঈদসংখ্যায় পঞ্চাশ পৃষ্ঠা লিখেছি। পঞ্চাশ পৃষ্ঠায় তো আর লেখা হয় না, আমাকে তিনশো পৃষ্ঠা লিখতে হবে।
এই ভাষণটি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের কীভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। সেই মুক্তিযোদ্ধা একজন বাদামওয়ালা হতে পারে, একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হতে পারে। আমি অজস্র ক্যারেক্টার আনব যারা সেই দিন মাঠে ছিল। একেকজন একেকটা লাইন নিয়েছে। কেউ তো আর পুরোটা মুখস্থ করেনি।
একজন বুড়ি মা ভিক্ষার থালা নিয়ে রেসকোর্সের কাঁটাতারের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন আমার নায়ক-নায়িকা রিকশায় ওই দিক দিয়ে যাচ্ছে। তখন তাদের দিকে তাকিয়ে চোখ-মুখ উজ্জ্বল করে বলে ব্যাডা এ্যাকখান। ওর কিন্তু ভাষণ নিয়ে বড় কিছু নাই। ‘ব্যাডা এ্যাকখান, কতা কইল!’
এইটা হবে আমার নেক্সট উপন্যাস। আমি কতখানি আনতে পারব তা নিজেও আঁচ করতে পারছি না।
অলাত এহ্সান : সমাজতাত্ত্বিকভাবেও কিন্তু একটা কথা সত্য যে, হাজার হাজার ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বসবাসের ফলে নারীর ভেতরেও পুরুষতন্ত্র জেঁকে বসা অস্বাভাবিক কিছু না। এবং তেমনটা ঘটেছেও। তাই নারী সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে সাহিত্যেও পুরুষতান্ত্রিক চরিত্ররা থেকে গেছে। সেই দিক দিকে আপনার কোনো কোনো গল্পের চরিত্র পুরুষতন্ত্রের এটা ভাঙতে চেষ্টা করছে। আমাদের দেশের সাহিত্য কি নারীবাদের প্রতিনিধিত্ব করে?
সেলিনা হোসেন : আমাদের দেশের ক্রিটিকরা ওভাবে দেখতে পারেন না। ক্রিটিকরা তাদের দৃষ্টি ডেভেলপ করুক। ক্রিটিকরা তো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন। যখন সমালোচনার জায়গায় যান, তখন নারীদের লেখায় আগে ওই জায়গাটা খোঁজেন। আমরা মনে করি না নারীরা ওভাবে কিছু করছে। এখন অনেক ভালো ভালো লেখা হচ্ছে। যখন রাবেয়া খাতুন ‘মধুমতি’ উপন্যাসটা লেখেন নদীর পটভূমিতে, তাঁতিদের পটভূমিতে তখন সমগ্র সমাজ উঠে আসছে না? এই বড়দিকটিকে বিশেষায়িত কী করে? ফলে ওই বড়দিক তুলে ধরার আগেই জীবনে পুরুষতন্ত্র খুঁজছে কেন?
অলাত এহ্সান : তাহলে এই সময় যারা সাহিত্য করছেন, তাদের যে দায়িত্ব, নিজেকে উন্মোচন করা সেই দায়িত্ব কে কে পালন করছেন? বা কে কে লিখছেন বলে আপনি মনে করেন? নারীজীবনের একান্ত যন্ত্রণার দিকটির কথা বলছি।
সেলিনা হোসেন : আচ্ছা, নারীর জীবনটা কি সাহিত্যের একটা বড় বিষয়, নাকি সামাজিক জীবনটাই বড় বিষয়?
অলাত এহ্সান : সামাজিক জীবনকে বড় হিসেবে ধরে নিলেও বলা যায়, আমরা যখন সমাজে আলো ফেলছি তখন একটা অংশ সচেতনভাবে আঁধার রেখেই যাচ্ছি।
সেলিনা হোসেন : হুম, আমরা নিজেরাই, আমাদের পুরুষ লেখকরা নিজেদের বলয় থেকে বের হতে পারে না। পুরুষ লেখক না, পুরুষ সমালোচকরা।
অলাত এহ্সান : আবার সমালোচনারও একটি পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র আছে। সমাজে ধারণা আছে যে, যারা উচ্চ কটিতে বাস করছে তারাই কেবল সমালোচনা করতে পারবে। আবার সমালোচনায় সমালোচক তাঁর ক্ষমতাই ব্যবহার করেন। আর ক্ষমতা ব্যবহার করতে গিয়ে পুরুষতান্ত্রিক হয়ে ওঠেন, তাই না? এ ক্ষেত্রে নারী সমালোচক ও পুরুষ সমালোচক বলে পার্থক্য থাকছে না।
সেলিনা হোসেন : একদম।
অলাত এহ্সান : নারী-পুরুষে ভেদে নয়, সাহিত্যিক হিসেবেই আমাদের আপনি একজন যিনি অনেক লিখেছেন, এখনো লিখছেন। আপনার লেখা সমালোচক ও পাঠক দুই বিচারেই সফল। এই সাফল্যের ফলে একজন লেখকের তৃপ্ত হওয়ার সুযোগ কতটুকু? আপনি নিজেও কতটুকু তৃপ্ত?
সেলিনা হোসেন : না, নিজের তৃপ্ত হওয়ার আমার কোনো সুযোগ নেই। তবে আমি মূল্যায়নের জায়গাটা অনেক সময় দেখি। সেই জায়গা থেকে বলব যে, একজন লেখককে যদি মূল্যায়ন করতে হয়, তাহলে তার সবকিছু নিয়েই মূল্যায়ন করা উচিত। সে নারীবাদী লেখক, না পুরুষের বিরুদ্ধে লিখছে, না সমাজের বিরুদ্ধে লিখছে, এই উচ্চারণগুলো যেন না থাকে। খুঁজতে হবে শিল্পসম্মতভাবে কতটা সাহিত্য করি, সেই সাহিত্যে জনজীবন কতটা এসেছে, সামাজিক জীবন কতটা আছে। সাহিত্যের জন্য, গল্পের জন্য এগুলো তো আমাকে নিতেই হবে। আমি তো মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে আকাশ থেকে নামাতে পারব না। সে তো দরিয়া পাড়ের জেলে হবে, বা কামার বা কুমোর হবে, বা একজন দিনমজুর হবে বা একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হবেন। আমি তো এভাবেই লিখব। সেভাবে যদি আমি তাকে সামাজিক প্রেক্ষিতে দেখতে চাই তাহলে তার চারপাশের জীবন কি আসবে না! তাহলে কেন ভেঙে দেখা হবে?
অলাত এহ্সান : হ্যাঁ, সমাজেই, জীবনেই ওই সব ঘাত থাকে। যাই হোক, আমরা যেটা বলছিলাম আমাদের দেশে বয়োজ্যেষ্ঠ যারা লেখেন, তাঁদের মধ্যে আপনার বিস্তৃতি অনেক। দেশের বাইরেও আপনার বই মানুষ পড়ে। সম্মাননাও পেয়েছেন দেশে-বিদেশে। তো এসব অর্জনের মধ্যদিয়ে আপনি কি আসলে তৃপ্ত? কিংবা আপনার অতৃপ্তি কোথায়?
সেলিনা হোসেন : আমি আসলে তৃপ্ত না, অতৃপ্তও না। আমার মনে হয়েছে আমার মগ্ন চৈতন্যে যে বিষয়গুলো কাজ করেছে সেই বিষয়গুলোকে সাহিত্যে রূপায়িত করা দরকার। যতদিন সামর্থ্য থাকে করব এটা, এটার বাইরে যাব না। কারণ এই লেখালেখির জন্য জীবনের জাগতিক উন্নতির অনেক কিছু ত্যাগ করেছি। আমি তার মধ্যে ঢুকিনি। আমি সব সময় চেয়েছি আমার লেখালেখির জগৎটা ঠিক থাকুক।
অলাত এহ্সান : আপনার লেখক-জীবনই ৫২ বছরের। আপনার সময় থেকে এখন পর্যন্ত অনেকের লেখা আপনি সম্যকভাবে দেখেছেন। তরুণদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ বেশ ভালো। এই সময়ে অনেকে লিখছেন। এর মধ্যে কার কার লেখা আপনার কাছে মনে হয়েছে যা সময় উত্তীর্ণ, বা আপনার মনে ধরেছে।
সেলিনা হোসেন : এভাবে একজন-দুজন করে বললে খুব সমস্যা হবে। তারপর এখন স্মৃতি একটু ইয়ে হয়। নাম মনে আসছে না। আবার কেউ হয়তো ভালো লিখছে তার নাম উচ্চারণ করতে ভুলে গেলাম। এ সমস্ত কারণে নাম না বলি। এই সময়ে আমি কিন্তু খোঁজ রাখার চেষ্টা করি। এটা আমার দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে। ’৪৭-এর পর থেকে এই দেশে বাংলা ভাষার একটা নতুন সূচনা হয়েছে। এই সূচনার অনেকগুলো সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে। যেই প্রেক্ষাপট এই ভূ-খণ্ডের বাঙালির রয়েছে, তা আর কোনো ভূ-খণ্ডের বাঙালিদের এটা ফেস করতে হয় না। যেমন ভাষা আন্দোলন, যেমন সামরিক শাসন, যেমন ’৬৯-এর গণ-আন্দোলন, তারপর মুক্তিযুদ্ধ। আমরা ব্যক্তিজীবনের সমস্যা-সংকটের বাইরে, ইতিহাসের উপাদানের ভেতর যখন ব্যক্তিকে স্থাপন করব, তখন বিষয়গুলোকে দেখতে পাব, মূল্যায়ন করতে পারবে, উপস্থাপন করতে পারব অন্য দেশের বাঙালি সেটা উপস্থাপন করতে পারবে না।
অলাত এহ্সান : একটা জায়গা এসে মনে হয় আমাদের শেষ করতে হচ্ছে। যে বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক সংকট, সশন্ত্র সাম্প্রদায়িক তৎপরতা, ধর্মীয় উন্মাদনা আমাদের লেখালেখিকে আরেকটা সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না তো?
সেলিনা হোসেন : আমার মনে হয়, এই প্রশ্নের দুই অর্থ হতে পারে। যারা একটু নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করবেন তারা হয়তো লেখার বাইরে যেতে পারেন যে, আমি আর লিখব না। আবার যাঁরা সাহসিকতার সঙ্গে উচ্চারণ করেন যে, আমাদের আরো বেশি লেখা উচিত। বরং যারা এইভাবে নষ্ট কাজ করছে, যারা মন্দের পথে যাচ্ছে, তারা ধর্মান্ধ। ধর্ম তো এটা নয়। ধর্মের সত্যও নয় যে, মানুষকে হত্যা করা। তারা তো আরো বেশি করেই লিখবে।
অলাত এহ্সান : এই একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক যে, আমাদের আরো লেখা উচিত। এবং এই জায়গা সংকটের গভীরটা কোথায় সেটা বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই লেখা উচিত।
সময় দেয়াওর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সেলিনা হোসেন : আপনাকেও ধন্যবাদ। আবার আলাপ হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.