৯ জানুয়ারি তৃতীয়বারের মতো নগরপ্রধানের দায়িত্ব নিলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। এর আগে ২০০৩ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান, ২০১১ সালে সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংঘাতমুখর ও সন্ত্রাসকবলিত জনপদে তিনি শান্তি ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলেছেন মেয়র। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান
প্রথম আলো:একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তৃতীয়বার দায়িত্ব নেওয়ার পর আপনার অনুভূতি কী?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :আমি নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁরা আমাকে যে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছেন, সেটি আমার জন্য যেমন আনন্দের, তেমনি ভবিষ্যতের দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়েদিচ্ছে। আমি চেষ্টা করব, নারায়ণগঞ্জবাসীর ভালোবাসার প্রতিদান দিতে।
প্রথম আলো :এবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশননির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হওয়ায় সর্বমহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এই নির্বাচন স্থানীয় রাজনীতিতে কোনো গুণগত পরিবর্তন আনবে কি?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :গুণগত পরিবর্তন তো আনবেই। আগে থেকেই সেই ধারা শুরু হয়েছে। এই শহরের মানুষ উন্নয়ন ও শান্তির পক্ষেই রায় দিয়েছেন।
প্রথম আলো :আপনার দল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পরিবর্তন দেখছেন কি?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :দলীয় সভানেত্রী ইতিমধ্যে নেতা-কর্মীদের জানিয়ে দিয়েছেন তিনি কেমন নির্বাচন চান। তিনি সবাইকে মানুষের কাছে যাওয়ার জন্য বলেছেন, তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগাতেবলেছেন। কোথাও একটি ভালোনির্বাচন হলে, পরবর্তীকালে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই সেটি অনুসরণ করবেন, এটাই জনগণ আশা করে।
প্রথম আলো :নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রভাব কি জাতীয় নির্বাচনে পড়বে?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন যেভাবে হয়েছে তাতে সবাই এর প্রশংসা করেছে। আমার দলের নেতারাও বলেছেন, পরবর্তী নির্বাচনগুলো নারায়ণগঞ্জের মতোই হবে। এটি জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে আশা করি।
প্রথম আলো :একটি ভালো নির্বাচন হওয়ার জন্য রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, সরকার ও নির্বাচন কমিশন—কার কী ভূমিকা হওয়া উচিত।
সেলিনা হায়াৎ আইভী :দলের দায়িত্ব হবে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া। প্রার্থীর দায়িত্ব হবে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলা। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা। সরকারের কাজ হবে সেই দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা। নারায়ণগঞ্জে সবাই সেটি করেছে বলেই একটি ভালো নির্বাচন হয়েছে।
প্রথম আলো :বিজয়ের পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে যাওয়া কি শুধুই সৌজন্য, না অন্য কিছু আছে?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :এর ব্যক্তিগত সৌজন্যবোধও রাজনৈতিক—দুটো দিকই আছে। নির্বাচনে কেউ জয়ী হবেন, কেউ পরাজিত হবেন। তাই বলে তাঁদের মধ্যেব্যক্তিগত বাসামাজিক সম্পর্ক থাকবে না কেন? আর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে যাওয়া এটাই প্রথম নয়। ২০০৩ সালে বিএনপির সমর্থক প্রার্থী ছিলেন নূরুল ইসলাম সরদার। আমি কিন্তু তাঁর বাড়িতেও মিষ্টি ও ফুল নিয়ে গিয়েছিলাম। আর এর রাজনৈতিক তাৎপর্য হলো, নির্বাচনে যিনিই জয়ী হোন না কেন, তিনি সবাইকে নিয়ে কাজ করবেন, করা উচিত।
প্রথম আলো :যেখানে পাঁচ বছর জনপ্রিয়তা ধরে রাখা কঠিন, সেখানে কী করে ১৩ বছর জনপ্রিয়তা ধরে রাখলেন?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :নগরের উন্নয়ন ও মানুষের আস্থা অর্জনের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মানুষ আমার কাজ দেখেই ভোট দিয়েছেন। গত নির্বাচনে একটি প্রচার ছিল যে বিএনপি প্রার্থী প্রত্যাহার করায় আমি জয়ী হয়েছি। এবার বিএনপিরপ্রার্থী শেষ পর্যন্ত ছিলেন। তারপরও ৭৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ের পেছনে মানুষের ভালোবাসা ও আস্থাই কাজ করেছে। নারায়ণগঞ্জবাসী আমাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। আমি নগরবাসীর সঙ্গে থেকে তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চেষ্টা করেছি, ভবিষ্যতেও করব। আমি একটি দল করি এ কথা সত্য; কিন্তু সিটি করপোরেশনের কাজ করতে গিয়েআমি কারও প্রতি বৈষম্য করিনি। এ কারণে সব দলের এবং দলের বাইরের মানুষেরও ভোট পেয়েছি।
প্রথম আলো :আগে নির্দলীয় মেয়র ছিলেন। এবার দলের মেয়র হিসেবে আপনাকে বাড়তি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে কি না?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :আমি মনে করি না চ্যালেঞ্জ হবে। আমি তো নগরবাসীর উন্নয়নে কাজ করব। সেখানে যেমন আওয়ামী লীগের সমর্থক আছেন, তেমনি অন্যান্য দলের সমর্থকও আছেন। ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
প্রথম আলো :তৃণমূল আওয়ামী লীগ থেকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে যে মনোনয়ন প্রস্তাব গিয়েছিল, তাতে আপনার নাম ছিল না। অন্য তিনজনের নাম ছিল? কিন্তু দলের মনোনয়ন বোর্ড আপনাকেই মনোনয়ন দিয়েছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :সেই প্রস্তাব দলের সাধারণ নেতা-কর্মীদের ছিল না। একজন ব্যক্তির ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, দল মনোনয়ন না দিলে নির্বাচন করব না। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার জন্য রাজনীতি করি না।
প্রথম আলো :সিটি মেয়র হিসেবে আপনি পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করে ফের নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু ২০১৩ সালে নির্বাচিত হয়েও কয়েকজন মেয়র দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করেছে।
সেলিনা হায়াৎ আইভী :এ ক্ষেত্রে আইনটি সংশোধন করলে ভালো হয়। কেননা, একজন জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত বা পদচ্যুত করা হলে তাঁকে যাঁরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন, তাঁদেরই বঞ্চিত করা হয়। আবার যাঁরা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁদেরও এমন কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া ঠিক নয়, যা জনগণের জন্য ক্ষতিকর।
প্রথম আলো :স্থানীয় সরকার সংস্থার ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেক দিন ধরেই কথাবার্তা চলছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা কতটা ক্ষমতায়িত?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :আমি বলব, স্থানীয় সরকারেরক্ষমতায়নে সরকারের সদিচ্ছা আছে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করার কথা বলা আছে। তবে বাস্তবায়নের কাজটি তো সহজ নয়। ক্ষমতার আরও বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। নগর সরকার ব্যবস্থাপনা বা সিটি গভর্নেন্স অত্যন্ত জরুরি। তাতে নগরের সেবা যথাক্রমে গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওয়াসা, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন কার্যক্রমে সমন্বয় আনা যাবে। এখন যে যার খুশিমতো কাজ করছে। জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। একই ছাতার নিচে সব সংস্থা কাজ করলে সেই দুর্ভোগ ও অপচয় কমবে।
প্রথম আলো :নগরের উন্নয়ন ও নগরবাসীর কল্যাণে আগামী পাঁচ বছরে আপনার পরিকল্পনা কী?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :আমরা ইতিমধ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি একটি পরিকল্পনা নিয়েছি। সবুজ, পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব নগর গড়ে তোলাই এর উদ্দেশ্য। এই মুহূর্তে আমার অগ্রাধিকার শীতলক্ষ্যার ওপর একটি সেতু নির্মাণ। এতে নদীর পূর্বও পশ্চিম পারের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ সহজ হবে। একই সঙ্গে যেসব খাল ও পুকুর ভরাট বা দখল হয়ে গেছে, সেগুলো উদ্ধার করা। প্রতি ওয়ার্ডে না পারলেও তিন ওয়ার্ড মিলে একটি করে খেলার মাঠ নির্মাণ করা হবে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যা বাড়ছে, শিল্পকারখানা বাড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারিত হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি। প্রথমত, নগরের বর্জ্য রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সড়ক ও ফুটপাতগুলো প্রশস্ত করতে হবে। বিকল্প সড়ক নির্মাণ করতে হবে। ১০-১৫টি সার্কুলার রোড তৈরি করারও পরিকল্পনা আছে। সিটি বাস সার্ভিস চালু করারও চিন্তা আছে।
প্রথম আলো :নির্বাচনের আগে বলেছিলেন সংস্কৃতিচর্চার উন্নয়নে ততটা মনোযোগ দিতে পারেননি। এ ব্যাপারে কী করবেন?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :নগরবাসীর জন্য একটি উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করব, যেখানে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ সংস্কৃতিচর্চা ও বিনোদনের সুযোগ পাবেন। আলী আহমদ চুনকা পাঠাগার ও মিলনায়তন শিগগিরই উদ্বোধন করা হবে।
প্রথম আলো :সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে মার্কেট ও ফ্ল্যাট নির্মাণ করা নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, ব্যবসা করা সিটি করপোরেশনের কাজ নয়।
সেলিনা হায়াৎ আইভী :সিটি করপোরেশন স্বাবলম্বী না হলে নগরের উন্নয়ন করবে কীভাবে? বরিশাল সিটি করপোরেশন কয়েক মাস ধরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। আমরা আয় বাড়াতে পেরেছি বলেই উন্নয়নকাজ করতে পারছি। কর্মীদের বেতন-ভাতাও দিতে পারছি। নিউইয়র্ক সিটি করপোরেশন বিমানবন্দরও পরিচালনা করছে। আমরা ক্ষমতায়ন চাইব, আবার সরকারের মুখাপেক্ষী হব, সেটি হতে পারে না। কোনো দেশে এটি হয় না। এ ছাড়া আমরা শুধু মার্কেট-ফ্ল্যাট করিনি, চারটি হাসপাতালও নির্মাণ করেছি সরকার ও এডিবির সহায়তায়। শহরে ভালো স্কুল নেই। আমরা স্কুলও প্রতিষ্ঠা করব। তবে আমাদের মূল যে দায়িত্ব রাস্তাঘাট সংস্কার করা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সেগুলো অবশ্যই করব।
প্রথম আলো :সাত খুনের মামলার রায় হয়েছে, অপরাধীরা সর্বোচ্চ শাস্তি পেয়েছেন। কিন্তু তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাসহ অনেক হত্যার বিচার হয়নি, তদন্ত আটকে আছে।
সেলিনা হায়াৎ আইভী :সাত খুনের বিচারের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই রায় কার্যকর হলে স্বজনেরা এই সান্ত্বনাটুকু পাবেন যে হত্যার বিচার হয়েছে। অনুরূপভাবে ত্বকীসহ অন্যান্য হত্যার তদন্ত ও বিচার দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। ত্বকী হত্যার ঘটনা ঘটেছে সাত খুনেরও অনেক আগে।মামলার আসামিরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।
প্রথম আলো :বিজয়ের ব্যাপারে কতটা নিশ্চিত ছিলেন?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :এই নির্বাচনের আগে অনেক কথা হয়েছে। অনেকে ‘ভোট বিপ্লবের’ কথা বলেছেন। কিন্তু আমি মোটেই বিচলিত ছিলাম না। নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল। আমি তাঁদের জন্য সাধ্যমতো কাজ করেছি, তাঁরাও প্রতিদান দিয়েছেন। এবারও আমাকে কঠিন অবস্থার মধ্যে যেতে হয়েছে, নানা বাধাবিপত্তি পার হতে হয়েছে।
প্রথম আলো :তিনবার স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করে জয়ী হলেন। ভবিষ্যতে আপনার জাতীয় রাজনীতিতে আসার চিন্তাভাবনা আছে কি না?
সেলিনা হায়াৎ আইভী :এখনো আমি জাতীয় রাজনীতির কথা ভাবছি না। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নিয়ে থাকতে চাই। নারায়ণগঞ্জ আমার জন্মশহর; এই শহরের মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে থাকতে পারাই আমার পরম পাওয়া।
প্রথম আলো :আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সেলিনা হায়াৎ আইভী : আপনাকেও ধন্যবাদ।
তথ্যসূএ: প্রথম আলো
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.