মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ
শক্তিশালী অভিনেতা ছিলেন তিনি। সেসঙ্গে ছিলেন দাপুটে নির্দেশক। দেশীয় নাট্যাঙ্গনের এক মহীরুহই বলা যায় তাকে। তিনি খালেদ খান যুবরাজ। এই খ্যাতিমানের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৩ সালের এই দিনে ৫৫ বছর বয়সে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। তিনি স্ত্রী বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী মিতা হক ও একমাত্র মেয়ে ফারহিন খান জয়িতা এবং অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। খালেদ খান দীর্ঘদিন ধরে মোটর নিউরন সমস্যায় ভুগছিলেন। এর ফলে তার শরীরের মাংসপেশি অকেজো হয়ে যায়। সদা হাস্যোজ্জ্বল এ মানুষটি বন্ধুমহলে যুবরাজ নামে পরিচিত ছিলেন। ১৯৫৮ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শিক্ষাজীবনে ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম এবং ১৯৮৩ সালে ফিন্যান্স বিষয়ে এমকম সম্পন্ন করেন খালেদ খান। দীর্ঘ ২৮ বছর নিয়মিত থিয়েটার ও টিভি নাটকে অভিনয় করে শক্তিমান এক অভিনেতায় পরিণত হয়েছিলেন তিনি। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে একাধিক টিভি নাটকে অভিনয় করে তুমুল জনপ্রিয়তা পান। এদিকে ১৯৭৮ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে মঞ্চ নাটকে তার যাত্রা শুরু হয়। মঞ্চে তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘অচলায়তন’, ‘নুরলদীনের সারা জীবন’, ‘ঈর্ষা’, ‘দর্পণ’, ‘গ্যালিলিও’ ও ‘রক্তকরবী’। ‘ঈর্ষা’ নাটকে অভিনয়ের জন্য তিনি কলকাতা থেকেও ডাক পান। নাটকে সফলভাবে পথচলার পর পরিচালনাও শুরু করেন খালেদ খান। তার পরিচালিত উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’, ‘পুতুল খেলা’, ‘কালসন্ধ্যায়’, ‘মাস্টার বিল্ডার’, ‘ক্ষুদিত পাষাণ’সহ বেশ কিছু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় আলী যাকের, সারা যাকের, আতাউর রহমান, ফেরদৌসী মজুমদারদের অভিনয় দেখে অনুপ্রাণিত হতেন খালেদ খান। ১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে টিভি নাটকে অভিষেক হয় তার। তার অভিনীত প্রথম টিভি নাটক হলো ‘সিঁড়িঘর’। এরপর অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করে দর্শক হৃদয় জয় করেছেন। একাধিক নাটকে তার বেশ কিছু সংলাপও জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে নব্বই দশকের নাটক ‘রূপনগর’-এ তার ‘ছিঃ ছিঃ, তুমি এত খারাপ’ শীর্ষক সংলাপটি চলে আসে মানুষের মুখে মুখে। তার অভিনীত জনপ্রিয় নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোন কাননের ফুল’, ‘রূপনগর’, ‘মফস্বল সংবাদ’, ‘অথেলো এবং অথেলো’, ‘দমন’, ‘লোহার চুড়ি’, ‘সকাল সন্ধ্যা’সহ বেশ কিছু। মঞ্চ ও টিভি নাটকের ক্ষেত্রে খুব বেছে বেছে কাজ করার পক্ষপাতী ছিলেন খালেদ খান। সে কারণে তার করা বেশিরভাগ নাটকই ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। অভিনয়ের পাশাপাশি পেশাগতভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা সময় কর্মরত ছিলেন এ মানুষটি। এর মধ্যে ১৯৮৯ সালে ‘অক্সফাম’ নামক একটি এনজিওতে কাজ শুরু করেন তিনি। পরে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পদে বেক্সিমকো ফার্মায় কর্মরত ছিলেন। ২০০১ সালে একুশে টিভির জেনারেল ম্যানেজার, ২০০২ সালে ইউনিভার্সাল টেলিভিশনের হেড অব প্রোগ্রাম ও নিউজ, ২০০৫ সালে বেঙ্গল গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, ২০০৭ সাল থেকে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে ডেপুটি ডিরেক্টর (এডমিনিস্ট্রেশন) এবং ২০০৯ সাল থেকে সর্বশেষ তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মঞ্চ নাটকে অনবদ্য অবদানের জন্য ‘মোহাম্মদ জাকারিয়া পদক’, সেরা অভিনেতা হিসেবে ‘নুরুন্নাহার স্মৃতিপদক’, সেরা পরিচালক হিসেবে সিজেএফবি পুরস্কার এবং সেরা টিভি অভিনেতা হিসেবে ‘ইমপ্রেস-অন্যদিন’ পুরস্কার অর্জন করেছিলেন তিনি। বাংলা নাটকের অন্যতম প্রভাবশালী এ অভিনেতাকে স্মরণ করতে তার এলাকা মির্জাপুরে আয়োজন করা হয়েছে তিন দিনের নাট্যেৎসব। আর এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ২৩শে ডিসেম্বর উপস্থিত থাকবেন একসময়ের তুখোড় অভিনেতা ও বর্তমানের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এ আয়োজন হবে ২৩, ২৪ ও ২৫শে ডিসেম্বর। উৎসবের স্লোগান রাখা হয়েছে ‘আমরা নাটক বানাই আলোর খোঁজে’। মূলত মির্জাপুরের উয়ার্শী গ্রামের এ আয়োজনটি করেছে যুবরাজ নাট্য উৎসব কমিটি। আয়োজনের তিন দিনে চারটি নাটক মঞ্চায়ন হবে। এতে প্রাচ্যনাটের ‘কিনু কাহারের থেটার’, অবয়ব নাট্যদলের ‘ফেরিওয়ালা’ ও থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ‘আমেনা সুন্দরী’ নাটক থাকছে। এছাড়া স্থানীয় সংগঠন হঠাৎ নাট্য সমপ্রদায়ের ‘সঙযাত্রা’ নাটকটিও মঞ্চস্থ হবে উৎসবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.