আশুলিয়ার শ্রম আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করতে কারখানা কর্তৃপক্ষের মামলার পর সাধারণ শ্রমিক ও শ্রমিকনেতাদের আটক করা হচ্ছে। গত দুই দিনে ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১১ জনকে। এদিকে বন্ধ থাকা তৈরি পোশাক কারখানার মালিকেরা শ্রমিকদের সঙ্গে আপস না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর্থিক ক্ষতি যতই হোক, শ্রমিকেরা আন্দোলন ছেড়ে কাজ করতে অনুরোধ না জানালে কোনোভাবেই কারখানা খোলা হবে না। পুরো বিষয়টি তদারক করছেন পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর শীর্ষ নেতারা। আশুলিয়ার ৫৯ পোশাক কারখানা গতকাল বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো বন্ধ ছিল। প্রতিটি কারখানার মূল ফটকের সামনে শিল্প পুলিশ মোতায়েন ছিল। সড়কে ছিল পুলিশ ও র্যাবের টহল। গত মঙ্গলবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল বিজিএমইএ। বাইপাইলের ফাউন্টেন গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং নামের পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষ ১৩৫ জন শ্রমিককে গতকাল সাময়িক বরখাস্ত করেছে। কারখানার ফটকে গতকাল বরখাস্ত করা শ্রমিকদের নাম-ছবিসহ কয়েকটি তালিকা দেখা গেছে। গত বুধবার উইন্ডি অ্যাপারেলস ১২১ জন শ্রমিককে সাময়িক বরখাস্ত করেছিল। বন্ধ থাকা পাঁচটি পোশাক কারখানার প্রায় ২০ জন শ্রমিকের সঙ্গে গতকাল প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা অভিযোগ করেন, শ্রমিকদের গ্রেপ্তারে পুলিশ বিভিন্ন মহল্লায় অভিযান চালাচ্ছে। অনেককে আটক করে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। ভয়ে অনেক শ্রমিক গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। তবে একটি বড় গ্রুপের কারখানার মূল ফটকে তালা লাগানো থাকলেও কয়েক হাজার শ্রমিক গতকাল কাজ করেছেন। দুপুরের খাবার বিরতিতে কারখানার পেছনের ফটক দিয়ে শ্রমিকেরা যখন বের হচ্ছিলেন, তখন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের মধ্যে ফয়েজ বিশ্বাস ও সৈয়দ নঈম বলেন, পোশাক রপ্তানির স্বার্থে ফিনিশিং বিভাগের অন্তত আড়াই হাজার শ্রমিক নিয়মিত কাজ করছেন। মহিলা দলের নেত্রী গ্রেপ্তার: আশুলিয়ার শ্রম অসন্তোষের ঘটনায় সাভারের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা চেয়ারম্যান ও আশুলিয়া থানা জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভানেত্রী মিনি আক্তার এবং তাঁর বড় ভাই তোফাজ্জল হোসেনকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের আশুলিয়া, সাভার ও ধামরাই অঞ্চলের আহ্বায়ক সৌমিত্র কুমার দাস, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের আশুলিয়া অঞ্চলের সভাপতি আল কামরান ও সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহাম্মেদ, ঢাকা জেলা টেক্সটাইল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান, সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি সেন্টারের সংগঠক মোহাম্মদ ইব্রাহীম, তৃণমূল গার্মেন্টস ফেডারেশনের সভাপতি শামীম খান, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম, ঝুট ব্যবসায়ী ইসরাফিল এবং ব্যবসায়ী দুলাল মীরকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকা জেলার গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) উত্তরের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে গতকাল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে গত বুধবার ও গতকাল এই ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পোশাকশিল্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মহিদুল ইসলাম গতকাল মামলাটি দায়ের করেন। এতে নামে-বেনামে অর্ধশত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। মিনি আক্তারসহ ব্যবসায়ী ও শ্রমিকনেতাদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে আশুলিয়া থানার একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেন, ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি দেওয়ান মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে কয়েক হাজার শ্রমিক বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। মিনি আক্তারসহ বিএনপির স্থানীয় নেতা ও বিএনপির সমর্থক ব্যবসায়ীদের কথায় সেদিন শ্রমিকেরা স্মৃতিসৌধে যান। এই শ্রমিকদের একটি বড় অংশ চলমান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত আছে। এ ছাড়া গ্রেপ্তারকৃত শ্রমিকনেতারাও এবারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে ইন্ধন দিয়েছেন। ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বাধা: আশুলিয়ার বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়াসহ কয়েকটি দাবিতে ১২টি শ্রমিক সংগঠনের জোট গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের পূর্বনির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন করতে দেয়নি পুলিশ। ব্যানার কেড়ে নিয়ে মিলনায়তনে তালা লাগিয়ে দেয় পুলিশ। সেখান থেকে শ্রমিকনেত্রী মোশরেফা মিশুকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকার তোপখানা রোডে নির্মল সেন মিলনায়তনের সামনে গতকাল সকাল সোয়া ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করে গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের সমন্বয়ক রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ আমাদের ব্যানার কেড়ে নিয়ে গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করে। আমরা যাতে সংবাদ সম্মেলন করতে না পারি, সে জন্য মিলনায়তনের ফটকে তালাও লাগিয়ে দেওয়া হয়।’ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার উপপরিচালক মাসুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মোশরেফা মিশুকে আটক কিংবা গ্রেপ্তার করা হয়নি। আর মোশরেফা মিশু গত রাত নয়টায় প্রথম আলোকে বলেন, দিনভর ডিবি কার্যালয়ে আটকের পর সন্ধ্যা ছয়টায় তাঁকে ছাড়া হয়। এদিকে আশুলিয়ার শ্রম অসন্তোষ ও আটকের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল কমিশন শ্রমিকদের ওপর বল প্রয়োগ না করতে এবং তাঁদের সমাবেশের অধিকার ও বাক্স্বাধীনতা রক্ষা করতে অনুরোধ জানায়। একই সঙ্গে শ্রম অসন্তোষ নিরসনে আলোচনা করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ জানিয়েছে কমিশন। এ ছাড়া গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্টের নেতা সৌমিত্র কুমার দাসের মুক্তি দাবি করেছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। ছয়টি শ্রমিক সংগঠনের জোট শ্রমজীবী সমন্বয় পরিষদ গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে কাল শনিবারের মধ্যে শ্রমিকনেতা ও শ্রমিকদের নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, না হলে রোববার সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাইয়ের পোশাকশ্রমিকেরা কর্মবিরতি পালন করবেন। এদিকে ঢাকায় বিজিএমইএর কার্যালয়ে গতকাল দীর্ঘ সময় ধরে সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতারা অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। এতে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ। জানতে চাইলে বিজিএমইএর আরেক সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, আশুলিয়া এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি তদারকি করার জন্যই বৈঠকটি হয়েছিল। শনিবার আবার হবে। বন্ধ পোশাক কারখানা খোলার বিষয়ে বিজিএমইএ কী করছে জানতে চাইলে সংগঠনের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নয় দিন চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পরই কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হই। ফলে আমরা নতুন করে চেষ্টা করছি না। তবে শ্রমিকেরা যদি নিজেদের ভুল বুঝতে পারে ও কাজ করতে রাজি হয় এবং সেই কথা যদি কর্মকর্তাদের কাছে জানায়, তাহলে কারখানা খুলে দেওয়া হবে।’