পুলিশ সদস্য মফিজুল ইসলাম। পুরো পা প্লাস্টার করা। তিন মাস আগে মোটরবাইক দুর্ঘটনার শিকার হন। হাড় ভেঙে গেছে। দুর্ঘটনার পর থেকে এত দিন তিনি রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু) চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর ভাষায়, এখন ‘রেস্টে’ থাকার জন্য রাজারবাগে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি হতে এসেছেন। তিনি জানালেন, এখানে ওষুধ পর্যাপ্ত আছে। খাবারের মানও ভালো। গতকাল বৃহস্পতিবার কথা হয় মফিজুল ইসলামের সঙ্গে। শুধু তিনি নন, পুলিশ ও পুলিশ পরিবারের অনেক সদস্যই অন্য হাসপাতালে জটিল রোগের জন্য চিকিৎসা শেষে এ হাসপাতালে ভর্তি হন বিশ্রামে থাকার জন্য। এর মূল কারণ হাসপাতালটিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অন্যান্য জনবলের অভাব। হাসপাতাল ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, জনবলের অভাবে হাসপাতালটিতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব (সিজার), শিশুদের খতনাসহ ‘মাঝারি’ ধরনের অস্ত্রোপচারগুলো করা সম্ভব হলেও জটিল অস্ত্রোপচার হয় না। একইভাবে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও রোগীদের অন্য হাসপাতালে যেতে হয়। হাসপাতালটিতে কর্মরত চিকিৎসকের সংখ্যা ৫৬ জন। নার্সের সংখ্যা মাত্র ৩০ জন। আয়াসহ অন্যান্য জনবলের ঘাটতিও প্রকট। জানা গেল, ক্যানসারের রোগীরা বাইরে থেকে চিকিৎসা নিয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি হন নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার জন্য। এখানে জটিল কিডনি চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই। সিটিস্ক্যান মেশিন নষ্ট হয়ে আছে এক বছর ধরে। এন্ডোসকপি বাইরে থেকে করতে হয়। ডায়ালাইসিসের কোনো ব্যবস্থাও নেই। জটিল রোগীদের জন্য আইসিইউ, সিসিইউয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই লাশ বহনকারী গাড়িও। পুলিশ সদস্য ও তাঁদের বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান বা কেউ যদি পুলিশ সদস্যের ওপর নির্ভরশীল থাকেন তাঁরা ২৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে বিনা মূল্যে বিভিন্ন চিকিৎসার সুবিধা পাচ্ছেন। ঢাকার বাইরে পুলিশ হাসপাতালগুলোর অবস্থা খারাপ বলে সবার ভরসার জায়গা এ হাসপাতাল। এ ছাড়া রাজারবাগের আশপাশে বসবাসকারী কেউ দুর্ঘটনাজনিত বা অন্য কোনো কারণে হাসপাতালে এলে তাদেরও ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। নারী ও শিশুদের নাক, কান, গলা, চক্ষুসহ যেকোনো রোগের জন্য হাসপাতালে ওয়ার্ড আছে একটি। এতে আছে ৫২ শয্যা এবং চারটি কেবিন। গতকাল এ ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি ছিল ২১ জন। দুপুরের দিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নার্স বললেন, ‘চারজন সিজারের রোগীসহ ২১ জনের জন্য নার্স আছি মাত্র দুজন। শিশুদের জন্য স্পেশাল কোনো নার্স নেই। আমরাই সব কাজ করি।’ হাসপাতালের পরিচালক (ডিআইজি) লুৎফর রহমান মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৫৪ সালে যাত্রা শুরু করে হাসপাতালটি। তখন ছিল ৭৫ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। পরে জনবল ও অবকাঠামো বাড়িয়ে ২৫০ শয্যা করা হয়। তবে পুলিশ বাহিনীতে জনবল বাড়ায় হাসপাতালের পরিধি বাড়িয়ে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট করা ও জনবল বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। শুধু সিজার হয়: এই হাসপাতালে জনবলের অভাবে স্বাভাবিক প্রসবের কোনো ব্যবস্থা নেই। আছে শুধু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা। প্রসব ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে পরে অস্ত্রোপচার হচ্ছে তা নয়। আগে থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী এ অস্ত্রোপচারগুলো হয়। ফলে যে নারী পুলিশ বা পুলিশ পরিবারের নারী সদস্যদের সন্তান হবে তাঁদের আগে থেকেই বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে। এ হাসপাতালে যেহেতু স্বাভাবিক প্রসবের সুযোগ নেই তাই যাঁরা স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করতে চান তাঁরা অন্য হাসপাতালে ভর্তি হন। অন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কোনো জটিলতার কারণে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হলে যে খরচ হয়, তা নিজেদেরই শোধ করতে হয়। হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবাই ভাবে স্বাভাবিক প্রসব খুব সহজ। বিষয়টি আসলে খুবই কঠিন একটি কাজ। স্বাভাবিক প্রসবের জন্য রোগীর সঙ্গে একজন চিকিৎসককে ১২ ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হতে পারে। এ হাসপাতালে জনবলের সংকট থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না।’ এ চিকিৎসক জানালেন, সপ্তাহে গড়ে ১২ থেকে ১৩টি অস্ত্রোপচার করে সন্তান প্রসব হচ্ছে। কোনো কোনো সময় দিনেই হয় সাত থেকে আটটি অস্ত্রোপচার। সন্তুষ্ট সবাই: হাসপাতালটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বহির্বিভাগে প্রতিদিন হাজার খানেক রোগীর চাপ থাকে। এর বাইরে হাসপাতালটি বেশ ছিমছাম। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য একটি ব্রেস্টফিডিং কর্নার আছে। স্তন ক্যানসার পরীক্ষার জন্য আছে মেমোগ্রামের ব্যবস্থা। আছে একটি ব্লাড ব্যাংক। দশতলা ভবনের হাসপাতালটিতে সংক্রামক ব্যাধি, মেডিসিন, অর্থোসার্জারি, সার্জারি, নারী, শিশুসহ বিভিন্ন বিভাগ ও ওয়ার্ড আছে। তবে প্রতি ওয়ার্ডেই ভর্তি রোগীর সংখ্যা কম। ঢাকার মধ্যে যাতায়াতের জন্য আছে চারটি অ্যাম্বুলেন্স। প্রতি ফ্লোরে আছে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। হাসপাতালটিতে যত সমস্যাই থাকুক না কেন বা যেটুকুই চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাচ্ছে, তা নিয়েই রোগী ও কর্মরত ব্যক্তিরা সন্তুষ্ট।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.