নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ায় সেলিনা হায়াৎ আইভীকে এখন আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলছেন সেখানকার মানুষ ও রাজনীতিকেরা। তাঁরা এ-ও মনে করছেন, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে ‘ওসমান পরিবারের’ একচ্ছত্র ক্ষমতা বলে যে ধারণা প্রচলিত ছিল, সেটিও এই নির্বাচনের পর ক্ষীণ হয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে আইভীর বিজয় নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত শুক্রবার নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে কথা হচ্ছিল দলটির জেলা সভাপতি আবদুল হাইয়ের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের স্থানীয়ভাবে বড় নেতাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই নির্বাচনে দলীয় মেয়রের পক্ষে ছিলেন। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে আবদুল হাই বললেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আইভীর বিজয়ের ফলে তিনটি পরিবর্তন এসেছে। এক. জেলার রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। দুই. নির্বাচনব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা আসবে। তিন. নারায়ণগঞ্জের মানুষ যে সন্ত্রাসী বা মাফিয়াদের পক্ষে নন, সুস্থ পরিবেশের পক্ষে, সেটা প্রমাণিত হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের কয়েকজন নেতা বললেন, সহজ করে বললে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের রাজনীতি একটি পরিবারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ কারণে নির্বাচনে তৃণমূল থেকে আইভীর নাম কেন্দ্রে পাঠানোই হয়নি। আর বিতর্কিত ও প্রভাবশালী এই পরিবারটির বিরুদ্ধে আইভী সব সময়ই উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। মানুষ এটা পছন্দ করেছে। আইভীকে নির্ভরতার জায়গা বলে মনে করা হয়। তাঁর এবারের বিজয়ের কারণে ওই পরিবারটি অনেকটাই কোণঠাসা হবে। তাঁরা বলছেন, ওসমান পরিবার কতটা চাপে পড়েছে তা সহজেই অনুমেয়। শামীম ওসমানকে সংবাদ সম্মেলন করে আইভীকে সমর্থন দিতে হয়েছে। এমনকি আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রকাশ্যে নৌকায় সিল দিয়ে বোঝাতে হয়েছে তিনি আইভীকে ভোট দিয়েছেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তিনজনের নাম পাঠানো হয়। এতে আইভীর নাম ছিল না। ওসমান পরিবার চেয়েছিল প্রার্থী হবেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। কিন্তু কেন্দ্র থেকে আইভীকে বেছে নেওয়া হয়, যিনি বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী শামীম ওসমানকে বিপুল ভোটে হারান। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল না, সেটাই এই নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে। শহর আওয়ামী লীগের এক নেতা বললেন, একটি পরিবারের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে তাঁদের পক্ষে বিবেচনা করে কাউকে প্রার্থী করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই এটা বুঝেছেন। কোনো পরিবারের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে এখানকার রাজনীতিকদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন। অবশ্য নিজেদের ভুলের কথা ঘুরিয়ে স্বীকারও করলেন আবদুল হাই। তিনি বলেন, ‘আমরা নাম পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু কেন্দ্র বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর চ্যানেলে খোঁজ নিয়ে কে জনপ্রিয় সেটা বের করেছেন। তাঁকে প্রার্থী করায় আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে।’ স্থানীয় নেতারা যাঁকে প্রার্থী হিসেবে চেয়েছিলেন, সেই আনোয়ার হোসেনও বললেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিজয় হয়েছে। এটা দলের জন্য ভালো হয়েছে। অবশ্য সদ্য বিজয়ী মেয়র আইভী কেবল তাঁর উন্নয়নচিন্তার কথা তুলে ধরলেন। কী করলে সিটি করপোরেশন এলাকার মানুষের উপকার হবে, সেগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করা এবং এর আগের মেয়াদের অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার ওপর জোর দিলেন। প্রথম আলোকে বললেন আগামী পাঁচ বছরে তিনি কী করবেন। কেন্দ্রওয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল থেকে দেখা গেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানের চেয়ে আইভী ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৫টি ওয়ার্ডে বেশি ভোট পেয়েছেন। কেবল ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডে আইভীর চেয়ে সাখাওয়াত বেশি ভোট পেয়েছেন। এ দুটি ওয়ার্ড সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় অবস্থিত। এখানকার সাংসদ শামীম ওসমান। বাকি বন্দর ও সদর থানার সব ওয়ার্ডে আইভী জিতেছেন। অর্থাৎ যে ১২টি ওয়ার্ডে বিএনপি জিতেছে, তার মধ্যে একটি ছাড়া (২ নম্বর ওয়ার্ড) বাকি ১১টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা জিতলেও সেখানে মেয়র পদে আইভী বেশি ভোট পেয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির প্রতিনিধি ও সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি মনে করেন, এই বিজয় বড় ও গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করবে, যা হবে ইতিবাচক। পরিবর্তনের মধ্যে থাকবে রাজনীতির গুণগত উন্নয়ন, শঙ্কা-ভয় থেকে বের হওয়ার উপায়, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয়ভাবে দলগুলোর জন্য শিক্ষা এবং সর্বোপরি নারায়ণগঞ্জে গডফাদার যারা নিজেদের সব ক্ষমতার আধার মনে করত, তাদের কাছে এই বার্তা যাবে যে তাদের সব চাওয়া পূরণ হবে না, সব সিদ্ধান্ত মানুষ মেনে নেবে না। রাজনীতিবিদেরা রাজনীতি নিয়ে বললেও সাধারণ মানুষ বিজয়ের পেছনে জোর দিয়েছেন আইভীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, তাঁর লক্ষ্য, দলমত-নির্বিশেষে কাজ করা এবং সন্ত্রাসী কাজের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকাকে। বিশেষ করে একটি পরিবারের বিরুদ্ধে তাঁর প্রকাশ্য অবস্থানকে। তাঁরা বলছেন, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রাখাটা যে প্রয়োজন, সে জন্য কাকে দিয়ে সেটা হবে সেটা নারায়ণগঞ্জের মানুষ বুঝেছে। এটাও এখনকার মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন বলে মনে করছেন তাঁরা। শহরের জামতলা এলাকার বাসিন্দা মঈনুল হক স্থানীয় একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনি বললেন, নারায়ণগঞ্জে আইভীর নিজস্ব ইতিবাচক ভাবমূর্তি আছে। তাঁর কোনো বাহিনী নেই। তাঁর লোক হয়ে কেউ সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে না। তাঁকে ভোট দেওয়ার এটাই কারণ। স্থানীয় ১১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের নেতা নইম ইসলাম বললেন, তিনি সাখাওয়াতকেই ভোট দিয়েছেন। এটা দলীয় কারণে। তবে বিএনপির অনেকেই আইভীকে ভোট দেন। কারণ, নারায়ণগঞ্জের মানুষ মূলত আওয়ামী লীগের অন্যায়-অত্যাচারের শিকার নন। তাঁরা একটি পরিবারের অপকর্মের শিকার, যেটি আওয়ামী লীগ পরিবার বলেই পরিচিত। আবার এই পরিবারের বিরুদ্ধে কেবল আইভীই সব সময় দাঁড়িয়েছেন। এখানে সন্ত্রাসের দলীয় চেহারা ভিন্ন হওয়ায় বিএনপির যাঁরা আইভীকে ভোট দেন, তাঁরা সবাই তাঁকে নৌকার প্রার্থী হিসেবে ভোট দেন না। মূলত আইভীর প্রতি আস্থা থেকে দেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.