একচালা টিনের ঘর। এক কক্ষের ঘরটিতে আসবাব বলতে দুটি কাঠের চৌকি, একটি টেবিল, একটি চেয়ার আর খাবার রাখার একটি তাক। এক চৌকিতে ঘুমান রাফেজা-রুবেল দম্পতি। অন্যটিতে রাফেজার মা সুফিয়া বেগম। খুলনা শহরের টুটপাড়া এলাকার দিলখোলা সড়কে অবস্থিত এই ঘর। মাসে ৯০০ টাকা ভাড়া। এই ভাড়া আর সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে নিরন্তর সংগ্রামের সাক্ষী যেন এই ছোট ঘরটি। রাফেজা খাতুন (১৯) ও রুবেল ফকির (২১) দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। চলতি বছরের ২৪ জুন তাঁরা বিয়ে করেন। দুজনই খুলনা সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজের শিক্ষার্থী। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন তাঁরা। জন্মান্ধ রাফেজার কাছে বাবার কোনোই স্মৃতি নেই। জন্মের আগেই তাঁর মাকে ছেড়ে চলে যান তাঁর বাবা। মেয়েকে নিয়ে তাঁর মায়ের কঠিন সংগ্রামও শুরু সেই থেকে। মানুষের বাসায় বাসায় ঠিকা কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন তিনি। কিন্তু শত কষ্টের মধ্যেও চোখের আলো থেকে বঞ্চিত রাফেজাকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করেননি সুফিয়া বেগম। মেয়েও দৃঢ়চেতা। খালিশপুরের গোয়ালখালি সরকারি অন্ধ বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে বরিশালের এআরএস বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করেন রাফেজা। আর এইচএসসি পাস করেন খুলনার সুন্দরবন কলেজ থেকে এ বছর। রুবেলের গল্পটাও প্রায় একই রকম। চার বছর বয়সে টাইফয়েডে নিভে যায় তাঁর চোখের আলো। তত দিনে মা-বাবাও আলাদা হয়ে গেছেন। রুবেল তাঁর বড় চাচার সহায়তায় শুরু করেন পড়াশোনা। শরীয়তপুর আঙারিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে এসএসসি এবং বুড়িরহাট আবদুর রাজ্জাক কলেজ থেকে ২০১৬ সালে এইচএসসি পাস করেন। এক ব্যক্তির সাহায্যে কম্পিউটার চালনা শিখেছেন তিনি। মুঠোফোন ব্যবহার করতে পারেন রাফেজা ও রুবেল। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মুঠোফোনের মাধ্যমেই তাঁদের পরিচয়। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, তারপর প্রেম, পরিণয়। এখন দুজনই চান উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে। এইচএসসি পর্যন্ত তাঁরা শিক্ষাবৃত্তি পেতেন। এখন তা বন্ধ। টাকার অভাবে উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণ নিয়ে দুজনই উদ্বিগ্ন। রুবেল বলেন, ‘কীভাবে পড়াশোনা চালিয়ে নেব, তা নিয়েই সারাক্ষণ ভাবি দুজন।’ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়ে-জামাতাকে নিয়ে ৫১ বছর বয়সেও সারা দিন হাড়খাটুনি খেটে যাচ্ছেন রাফেজার মা। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? সেই ভাবনাই এখন পেয়ে বসেছে তিনজনকে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.