কখনও বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু। কখনও রাস্তা পারাপারের সময় পথচারীর মৃত্যু। বাসে বাসে সংঘর্ষ এমনকি ফুটপাথে ঘুমিয়ে থাকা ছিন্নমূল মানুষও প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার। আর এসব দুর্ঘটনা ঘুরে ফিরে কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় ঘটছে। পুলিশের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় রাজধানীর এমন ভয়ঙ্কর ও প্রাণঘাতী ৫৪ মোড় চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব মোড়ে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সাত বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯৫ জন মারা গেছে। এসব মোড়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৩১৫টি। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পাশাপাশি আহত হয় ১০৩ জন। অর্থাৎ, আহতের তুলনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। নিহতদের মধ্যে ৫৪ শতাংশের বেশি পথচারী। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে এসব দুর্ঘটনাপ্রবণ ভয়ঙ্কর মোড়ের মধ্যে কোনোটি বৃত্তাকার গোলচত্বর, কোনোটি ইংরেজি টি বর্ণের আকৃতির তিন মাথা, বহু রাস্তার সংযোগ, ক্রসিং চৌরাস্তা, বৃত্তাকৃতির তিন মাথা ও ক্রসিং, একটি বৃত্তাকার ও একটি ক্রসিং এবং কোথাও কোথাও রেলওয়ে ক্রসিং রয়েছে। ভয়ঙ্কর ও প্রাণঘাতী মোড়গুলো হলো- যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেট, সায়দাবাদ, শনির আখড়া ক্রসিং, স্টাফ রোড ক্রসিং (ঢাকা ময়মনসিংহ রোড), তোপখানা পুরানা পল্টন, সোনারগাঁও-পান্থপথ-ইটিভি, শাপলা চত্বর, ক্যান্টনমেন্ট জিয়া কলোনি গেট, প্রগতী সরণি (বাড্ডা), ওসমানী উদ্যান, জাসীমউদদীন রোড ক্রসিং, কাকলী ময়মনসিংহ রোড (কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ), কুড়িল বিশ্বরোড- লেভেল ক্রসিং, টঙ্গি ডায়ভারশন রোড, বিজয় সরণি, শাহবাগ, মহাখালী, পোস্তগোলা (রেলওয়ে ক্রসিং-মাদরাসা রোড ক্রসিং), হাটখোলা ক্রসিং (হাটখোলা রোড), কাকরাইল ভাসানী রোড, মগবাজার, নিউ স্কাটন-কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, মালিবাগ ক্রসিং, রোকেয়া সরণি (আগারগাঁও জংশন), রোকেয়া সরণি (মিরপুর ১০ গোল চত্বর), হোটেল শেরাটন (কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ-মিন্টু রোড), জিপিও (আব্দুল গণি রোড), মিরপুর ১০ গোল চত্বর, নতুন বিমানবন্দর রোড-বিজয় সরণি, কাকরাইল ট্রাফিক সিগনাল, নিউ মার্কেট-মিরপুর রোড, জোয়ার শাহারা, ডিআইটি এক্সটেনশন রোড-পুলিশ হাসপাতাল, মতিঝিল, জাতীয় সংসদ-মানিক মিয়া এভিনিউ-মিরপুর ক্রসিং, গুলিস্তান, শ্যামলী মিরপুর রোড-শ্যামলী সিনেমা হল, মিরপুর রোড-ক্রিসেন্ট লেক রোড ক্রাসিং, মৌচাক, গ্রিন রোড জংশন-সাইন্সল্যাব-মিরপুর রোড, সাতরাস্তা গোলচত্বর, মহাখালী ক্রসিং, আসাদগেট, রমনা-ভাষাণী গেট-স্টার গেট, কাটাবন ক্রসিং (এলিফ্যান্ট রোড), বেইলি রোড ক্রসিং-মনসুর আলী সরণি, বংশাল ক্রসিং-নর্থ সাউথ রোড, টিকাটুলি (নূর কমিউনিটি সেন্টার), রাসেল স্কয়ার, সুগন্ধা ক্রসিং, মানিক মিয়া এভিনিউ-ইন্দিরা রোড (রাজাবাজার), ফ্লাইং ক্লাব ক্রসিং, রেইনবো ক্রসিং (টঙ্গী ডাইভারসন রোড)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, পথচারীদের অসচেতনতা ও সড়কের ত্রুটির কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ত্রুটিযুক্ত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়েও দুর্ঘটনা ঘটছে। এআরআইর সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, মোড়গুলোতে অধিক যান ও মানুষ অবস্থান করে। চলাচলও হয় বহুমুখী। ফলে মোড়গুলোতে ঝুঁকির মাত্রা একটু বেশি। ঢাকার বাসচালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে। আর ফুটপাথ দখলের কারণে মানুষ যেভাবে সড়ক ধরে হাঁটে, তাতে হতাহতের সংখ্যা যে আরো বেশি নয়, সেটাই ভাগ্য। যানজট কিছুটা বাঁচিয়ে দিয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এসএম সালেহ উদ্দিন বলেন, ঢাকার পথচারীরা সবচেয়ে অরক্ষিত। এখানে বাসে বাসে ধাক্কাধাক্কি হয় প্রচুর। আর ধাক্কাধাক্কির কারণে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। তবে এতে ভেতরের যাত্রীরা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিন্তু দুর্ঘটনায় পথচারী সম্পৃক্ত হলেই তা প্রাণঘাতী হয়। এটা বন্ধ করতে হলে প্রতিটি রুটে একটি কোম্পানির অধীনে সব বাস পরিচালনার পরামর্শ দেন তিনি। এতে বাসগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা কমে যাবে। ফুটপাথগুলো দখলমুক্ত করাসহ পথচারীদের সচেতন করার পরামর্শও দেন তিনি। তিনি বলেন, ঢাকার মোড়গুলোতে যেসব ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে সেগুলো পথচারীরা ব্যবহার করেন না। কারণ প্রত্যেকটি ফুটওভার ব্রিজ মানুষ চলাচরের মূল জায়গা থেকে একটু দূরে। তাই এতটা দূরে কেউ যেতে চায় না। যেমন শাহবাগ মোড় থেকে মৎস্য ভবনের দিকের রাস্তা পারাপারের ফুটওভার ব্রিজটি মূল মোড় থেকে খানিকটা দূরে নিয়ে ঢাকা ক্লাবের কাছে তৈরি করা হয়েছে। মানুষ অত দূরে গিয়ে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে চান না। ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করে। কাওরানবাজার খুবই ব্যস্ততম এলাকা হলেও একটি মাত্র পাতাল পথ রয়েছে তাও মূল মোড় থেকে সরিয়ে পূর্ণিমা হলের সামনে করা হয়েছে। কিন্তু বেশি মানুষ চলাচল করে সোনারগাঁ হোটেল ও একুশে টেলিভিশনের সামনে দিয়ে। পাতাল পথে যদি মিনিটে ১৫ জন লোক চলাচল করে পক্ষান্তরে সোনারগাঁ ও একুশে টিভির সামনের রাস্তা ব্যবহার করে কমপক্ষে ৩০ জন। ৫ থেকে ১০ মিটিটের সিগনালে রাস্তার দুই পাশে মানুষের বড় জমায়েত তৈরি হয়। এআরআইয়ের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকার সবচেয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান হচ্ছে উত্তরার জসীমউদদীন সড়কের মোড়টি। সাত বছরে এই মোড়ে ২৪টির ওপরে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১৭ জন, যার মধ্যে ১৬ জনই পথচারী। রাজধানীর ফার্মগেট, কাকলী, যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদ মোড়ে ছয় বছরে ৬৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ৫১ জনের। এর মধ্যে পথচারীই ৪০ জন। এআরআইয়ের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত সাত বছরে ১০টি করে দুর্ঘটনা ঘটেছে এমন মোড়ের মধ্যে রয়েছে সোনারগাঁও-পান্থপথ-ইটিভি মোড়, বিজয় সরণি, জোয়ার সাহারা, শ্যামলী সিনেমা হলের সামনের মোড়। ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বলছে, ঢাকার কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় ঘনঘন দুর্ঘটনা হয়। তবে এসব স্থান স্থায়ী নয়। একেক বছর একেক স্থানে বেশি দুর্ঘটনা হয়। তারপরও যেসব স্থানে দুর্ঘটনা হয় সেসব স্থানে অতিরিক্ত ট্রাফিক সার্জেন্ট দায়িত্ব পালন করে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল বলেন, ঢাকা শহরে ২০০টির বেশি কোম্পানির গাড়ি চলাচল করে। এমনকি একই রুটে একাধিক কোম্পানির গাড়ি চলে এতে একে অপরের মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়। আর প্রতিযোগিতা থেকে দুর্ঘটনা ঘটে। নগর পরিবহনে শৃঙ্খলা আনার জন্য কোম্পানিগুলোকে একীভূত করে মাত্র ৫টি কোম্পানিতে আনার চেষ্টা চলছে। কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন ক্রসিং বা সিগনালে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে খুব শিগগিরই ইউলুপ নির্মাণ করা হবে। ইউলুপ নির্মাণের সঙ্গে পর্যাপ্ত ফুটওভার ব্রিজও নির্মাণ করা হবে। এগুলো হলে দুর্ঘটনার পরিমাণও অনেক কমে আসবে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ আসাদুর রহমান মোল্লা বলেন, রাজধানীতে চলাচলকারী নগর পারিবহনে রুটের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। একই সঙ্গে বাড়ছে একই রুটে একাধিক কোম্পানির গাড়ি চলাচল। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে কোম্পানি এবং রুটের সংখ্যা কমাতে পারলে দুর্ঘটনা কিছুটা কমতো। একই সঙ্গে সড়কে পথচারী চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে পর্যাপ্ত ফুটপাথ এবং ওভারব্রিজ নির্মাণ করা গেলে দুর্ঘটনা কমানো যেত।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.