মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও রাখাইন সম্প্রদায়ের নির্যাতন কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। উপরন্তু রোহিঙ্গাদের সেখানে ক্যাম্পবন্দি রাখার অভিনব কৌশল অবলম্বন করে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর, দোকানপাটসহ নানা প্রকার স্থাপনা ধ্বংস করছে। ফলে মংডু এলাকায় মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে আবার নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সদ্য অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। সরেজমিন কুতুপালং বস্তি এলাকা ঘুরে গত এক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমারের মংডু ও বুচিদংয়ের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নরনারীর সঙ্গে কথা বলা হয়। তারা জানান, নতুন করে নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়েছে। সেখানে খেয়ে মরার চাইতে এখানে না খেয়ে থাকবো, তবুও এখানে নিরাপদ। মংডু এলাকার নাইচাদং গ্রামের ছকিনা (২৪) জানায়, মংডু বাজারে তার স্বামীর একটি দোকান ছিল। মিয়ানমারের সেনারা গত শনিবার রাতে দোকানের মালামাল লুটপাট করে তার স্বামী অছিয়র রহমান (২৮)কে গলা কেটে হত্যা করেছে। সকালে গিয়ে দেখি তার স্বামীর রক্তাক্ত মরা লাশ। উপান্তর না দেখে দু’মেয়ে ও দু’ছেলেকে নিয়ে সহায়-সম্বল ফেলে উনচিপ্রাং সীমান্ত দিয়ে এপারে চলে এসেছি। প্রত্যক্ষদর্শী একজন ব্যবসায়ী নুরুল্লাহ (৪৫) জানায়, মিয়ানমারের সেনারা এবার ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে। তারা ঘরবাড়ি ধ্বংস করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের এক জায়গায় ক্যাম্পবন্দি করে জিম্মি অবস্থায় রাখার জন্য রোহিঙ্গাদের যাবতীয় স্থাপনা ধ্বংস করছে। অবস্থার অবনতি দেখে দু’মেয়ের ইজ্জত রক্ষার্থে অনেক কষ্টে নাফ নদী পার হয়ে বালুখালী পানবাজার সীমান্ত দিয়ে কুতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছি। সে জানায়, তাদের সঙ্গে আরো ৪০ পরিবারের দু’শতাধিক রোহিঙ্গা নারী শিশু কুতুপালং বস্তিতে এসে পৌঁছেছে। কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা নেতা ফয়সাল আনোয়ার জানায়, গত ৪-৫ দিন ধরে যেসব রোহিঙ্গা এসেছে তাদের মধ্যে অনেকেই ধর্ষিতা নারী। শিশুরা ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত। বয়স্করা ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েছে। এসব রোহিঙ্গারা সর্বস্বান্ত হয়ে এখানে আশ্রয় নিলেও পেটের তাগিদে রাস্তার আশপাশে বসে কিছু পাওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করছে। উত্তরাঞ্চল থেকে পর্যটকনামধারী বেশকিছু গাড়ি এসে রাস্তার ধারে ধারে থেমে থেমে রোহিঙ্গাদের অকাতরে টাকা ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছে। যে কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাড়ছে বলে সে দাবি করে। এদিকে স্থানীয় কিছু লোকজন আশ্রয়হীন রোহিঙ্গাদের পুঁজি করে ঝুপড়ি ভাড়া বাণিজ্যে নেমে পড়েছে। ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গি সংগঠনগুলো কতিপয় এনজিওর সঙ্গে আঁতাত ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ কাজে ব্যবহার করছে বিভিন্ন লেভেলে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে কুতুপালং ও টেকনাফের লেদা অরক্ষিত রোহিঙ্গা বস্তিতে নগদ টাকা বিতরণ করে যাচ্ছে বিভিন্ন টিমে ভাগ হয়ে অপরিচিত লোকজন। তারা ১ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত এক একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে প্রদান করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে টাকা প্রদানকারী ব্যক্তিরা জানান, তারা কারও নির্দেশে বা কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে এ টাকা বিতরণ করছেন না। তবে ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ থেকে সাহায্য হিসেবে নিয়ে তা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছেন। সরকারিভাবে এসব রোহিঙ্গার সাহায্য সহযোগিতা করা না হলেও বিভিন্ন এনজিও সংস্থা, ব্যক্তি ও জঙ্গি সংগঠনের উদ্যোগে অত্যান্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ত্রাণসামগ্রী বিতরণ চলছে বাধাহীনভাবে। সম্প্রতি কুতুপালং বস্তি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চাষাবাদের জমিতে প্রায় শতাধিক ঝুপড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে আশ্রয় নেয়া বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, এক একটি ঝুপড়ি ৫ শত টাকা করে ভাড়া নিয়েছে। কুতুপালং বস্তি ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক জানান, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা কুতুপালংয়ে আশ্রয় নিলেও তারা নিরাশ্রয় হওয়ার কারণে যে যেখানে পারে সেখানে অবস্থান নিয়ে কিছু পাওয়ার আশায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছে। পুলিশ শত চেষ্টা করেও তাদের বস্তি এলাকায় ফেরাতে পারছে না। সুজনের সভাপতি নূর মুহাম্মদ সিকদার জানান, প্রায় দেড় লক্ষাধিক রোহিঙ্গার ভারে ন্যূয়ে পড়া জনপদ উখিয়ার সাধারণ মানুষ তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এভাবে ঢালাও ভাবে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধ করা সম্ভব নয়। বস্তিসহ অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণ জরুরি বলে তিনি মনে করেন। আর তা হলে অভাবের তাড়নায় এসব রোহিঙ্গারা অপরামূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবে এটাই স্বাভাবিক। উখিয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকার পরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এমতাবস্থায় এসব রোহিঙ্গাদের ত্রাণসামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করা হলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আবুল খায়ের জানান, রোহিঙ্গাদের অকাতরে টাকা বিলি করার সুবাদে রোহিঙ্গারা উখিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। তাই অবৈধ লেনদেন বন্ধ করা না হলে এসব রোহিঙ্গার নিয়ন্ত্রণ করা কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। এ ব্যাপারে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিনের যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গা ও বস্তির রোহিঙ্গাদের ওপর কড়া নজরদারি রাখা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের মাঝে প্রসাশনের অনুমতি ছাড়া ত্রাণসামগ্রী বিতরণ বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.