দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে কৃষি ব্যাংকের ৬৬৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। ছয়টি আলাদা প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে এ অর্থ আত্মসাৎ করে। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রফতানি বিল বিক্রির মাধ্যমে ১২ লাখ ৫৩ হাজার ৮১০ মার্কিন ডলার পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে কৃষি ব্যাংক সাভার, কারওয়ান বাজার এবং বনানী শাখা থেকে ৬৬৪ কোটি টাকা নিয়ে আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার করে। প্রতিষ্ঠানুগলো হচ্ছে- মনোপ্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড, ফেয়ার ইয়ার্ন প্রসেসিং লিমিটেড, মেসার্স রোজবার্গ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আরএন সোয়েটার্স, মেসার্স ফিরোজ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স অটো ডিফাইন ও ফিরোজ ট্রেডিং। দুদক উপপরিচালক মো. সামছুল আলমের নেতৃত্বে দুই সদস্যের টিম অভিযোগ অনুসন্ধান শেষ করে এনেছে বলে জানা গেছে।
দুদক সূত্র জানায়, কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে আলাদা তিনটি ঋণের নামে ৬৬৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ব্যবসায়ী নামধারী ওই ৬ প্রতিষ্ঠানের কথিত মালিকরা। দুদক বলছে, এরা একটি চক্র। কৃষি ব্যাংক সাভার শাখার মাধ্যমে ‘মনো প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ হাতিয়ে নেয় ৭৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত ঋণসীমা ছিল ১০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৩০৮টি এলসি খোলা হয়। এর মধ্যে ১৫৭টি এলসির অনুকূলে মনো প্যাকেজিং কোনো পণ্য আমদানি করেনি। এলসিগুলোর মূল্যমান ৬৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এই এলসির বিপরীতে গ্রাহকের কোনো দায়ও দেখায়নি। এছাড়া মনো প্যাকেজিংয়ের ১৩ কোটি ১২ লাখ টাকার সিসি ঋণও রয়েছে। কৃষি ব্যাংক সাভার শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক বীরেন দাস, মাফতুন আহমেদ, প্রিন্সিপ্যাল অফিসার আবুল হোসেন, ম্যানেজার এবং প্রধান কার্যালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগের কর্মকর্তারা এ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে প্রথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে।
‘মেসার্স কেয়া ইয়ার্ন মিলস লিমিটেড’ কৃষি ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখা থেকে ঋণের নামে হাতিয়ে নেয় ১৫৪ কোটি টাকা। এই ঋণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে জামানত নেয়া হয় মাত্র ২০ কোটি টাকার সম্পত্তি। বর্তমানে কেয়া ইয়ার্ন মিলসের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ১৩৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এ টাকা আদায়ে কৃষি ব্যাংক কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি। একই শাখার গ্রাহক ‘মেসার্স ফেয়ার ইয়ার্ন প্রসেসিং লিমিটেডের মাধ্যমে ঋণের নামে আত্মসাৎ করা হয় ৪২০ কোটি টাকা। বিপরীতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে জামানত নিয়েছে ১১০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির স্থিতি ছিল ৩১৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা। গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংক শাখার কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে এ টাকা আত্মসাৎ করেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি কৃষি ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখা থেকে এলসির নামে ১২ লাখ মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করে।
অন্যদিকে কারওয়ান বাজার শাখা থেকে ‘মেসার্স রোজবার্গ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড’ হাতিয়ে নেয় ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে জামানত নেয়া হয় ৭ কোটি টাকা। সুদ এবং আসল মিলে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকের পাওনা ২১ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ৭ কোটি টাকার জামানতকৃত সম্পত্তির মধ্যে তৃতীয় পক্ষ (থার্ড পার্টি) জামিনদার রয়েছেন। কিন্তু জামিনদার মারা যাওয়ায় ওই জামানতও এখন অকার্যকর। অর্থাৎ প্রায় ২২ কোটি টাকার বিপরীতে ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো জামানতই নেই। কৃষি ব্যাংকের একই শাখার গ্রাহক ‘মেসার্স আরএন সোয়েটার্স লিমিটেড’ ১২ লাখ ৫৩ হাজার ৮১০ মার্কিন ডলার পাচার করে। ১১টি ভুয়া বিল দাখিলের মাধ্যমে এই টাকা উত্তোলন করে দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে।
কৃষি ব্যাংক বনানী কর্পোরেট শাখার গ্রাহক ‘মেসার্স ফিরোজ এন্টারপ্রাইজ’, ‘মেসার্স অটো ডিফাইন’ ও ‘মেসার্স ফিরোজ ট্রেডিং’ সিসি ঋণ হিসেবে ৫৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়া বিল অব এক্সচেঞ্জ হিসেবে ১৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা এবং এলটিআর হিসেবে ৪৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। ব্যাংকের ওই শাখায় তিনটি প্রতিষ্ঠানের বর্তমান স্থিতি ১১৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, কৃষি ব্যাংকের ৬৬৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হয় গত বছরের মে মাসে। এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা এবং প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রযোজ্য ধারায় মামলার সুপারিশসহ শিগগিরই অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেয়া হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.