বিদায়ী বছরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির বড় ঘটনা দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলন। তবে তার চেয়েও বেশি আলোচিত ছিল সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তন। সরকার ও দলকে আলাদা করার প্রয়াসও দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের সক্রিয় রাজনীতিতে আসার এখনই সময়—এমন আলোচনাও ছিল গেল বছর। দলটির নেতারা মনে করছেন, সব মিলিয়ে বছরটা ছিল সংগঠন গোছানোর। তবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মৌলিক যে উপাদান, তৃণমূলে সদস্য সংগ্রহ তা উপেক্ষিতই থেকেছে। টানা দুই মেয়াদে সরকারে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের পর থেকে টানা আট বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে একটানা এত লম্বা সময় আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল না। দলটির কোনো নেতারও টানা আট বছর সরকার বা রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে থাকার সুযোগ হয়নি। ফলে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন, প্রতিটি বছরই দলের ও দলীয় প্রধানের মুকুটে নতুন সাফল্যের পালক যুক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে সংগঠন গোছানোর কথা বলা হলেও তা ছিল শুধু কেন্দ্রীয় রাজনীতিনির্ভর। দিবসভিত্তিক কর্মসূচি আর প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের সরকারি কর্মসূচি ঘিরেই চলেছে দলীয় রাজনীতি। নতুন সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের যোগদান করাতেই বেশি তৎপরতা দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, বিদায়ী বছরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য কালো দাগ সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা বড় আকার নেওয়ার পেছনে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল অনেকটাই দায়ী—এই ধারণা দল ও দলের বাইরে বেশ জোরালো। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার পেছনেও দলের সাংসদ ও স্থানীয় নেতার জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ এসেছে। এর আগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ঠাকুরগাঁও, পিরোজপুর ও ফরিদপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় হিন্দু সম্পত্তি দখলের অভিযোগ ওঠে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। গেল বছরটি নির্বাচনের বছরও ছিল। সারা দেশে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শেষে। ওই নির্বাচনে ৭৬টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের ৮৬ জন বিদ্রোহী প্রার্থী হন। দলের পদ আছে এমন ৫৯ জনকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে বছর শুরু হয় দলীয় কোন্দল দিয়ে। তা অব্যাহত থাকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও। অনিবার্য ফল হিসেবে সংঘাত দেখা দেয় সারা দেশে। শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বেশির ভাগ প্রাণহানি হয় আওয়ামী লীগের এক পক্ষের সঙ্গে অন্য পক্ষের সংঘাতে। সর্বশেষ সম্পন্ন হয়েছে জেলা পরিষদের পরোক্ষ ভোট। এতেও দলের সিদ্ধান্ত না মেনে অনেকে বিদ্রোহী হন। অবশ্য নির্বাচনে বিদ্রোহের অভিযোগে যাঁদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তাঁরা সবাই দলের জাতীয় সম্মেলনের আগে সাধারণ ক্ষমা পেয়ে যান। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বহিষ্কার, কঠোর অবস্থান আবার নমনীয়তা—সবই কৌশলের অংশ। জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২২ ও ২৩ অক্টোবর। সাম্প্রতিক সময়ের সব কটি সম্মেলনই হয়েছে এক দিনে। এবার দুই দিনব্যাপী বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির আকার ৭৩ থেকে বৃদ্ধি করে ৮১ করা হয়। সম্মেলনের মূল পর্ব নেতৃত্ব নির্বাচনেও এবার আকর্ষণ ছিল। বিশেষ করে সম্মেলনের তিন দিন আগে থেকে সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তনের গুঞ্জন ওঠে। শেষ পর্যন্ত ওবায়দুল কাদেরকে দায়িত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। এর আগে টানা আট বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সক্রিয় নেই এমন অনেক তৃণমূল নেতাও কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে যান। দল ও সরকার আলাদা করার প্রয়াস থেকে সম্পাদকমণ্ডলীতে সাধারণ সম্পাদকের বাইরে মন্ত্রিসভার কাউকে রাখা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীসহ সভাপতিমণ্ডলীতে আছেন আরও ছয়জন মন্ত্রী। নির্বাহী সদস্য পদে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আছেন তিনজন। সব মিলিয়ে মোট ১০ জন মন্ত্রী নতুন কমিটিতে আছেন। আগের কমিটিতে এ সংখ্যা ছিল ১৫। সম্মেলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ রেহানা ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে কাউন্সিলর করা। তবে জয় কাউন্সিলে অংশ নিলেও শেখ রেহানা অংশ নেননি। সম্মেলনের প্রায় প্রতিটি পর্বেই জয়কে কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান দেওয়ার দাবি এসেছে কাউন্সিলরদের কাছ থেকে। এটাকে দলের নেতৃত্বে জয়ের আগমন বার্তা হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। সম্প্রতি শেখ রেহানার স্বামী অধ্যাপক শফিক আহমদ সিদ্দিক একটি বেসরকারি টিভিতে বলেছেন, জয় সরকারে আর শেখ রেহানা দলে এলে ভালো করবেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.