ঢাকা ও গাজীপুর থেকে গ্রেফতার চার উচ্চশিক্ষিত নারী জঙ্গির কাছ থেকে মিলেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। এদের একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ইসতিসনা আক্তার ঐশীর ল্যাপটপে মিলেছে আরও ২৭ নারী জঙ্গির তালিকা। এদের সন্ধানে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা।
২৭ জঙ্গির ২৫ জনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুই গ্রুপে যুক্ত। সেগুলো হল- ইসলাম ক্লাস ফর গার্লস পেইজ-৩ ও ব্লাড রোজ। এ দুই পেজ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে র্যাব।
র্যাবের তথ্য মতে, এ জঙ্গিরা থ্রিমাসহ বিভিন্ন বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করে। তাদের মোবাইল ও ল্যাপটপ ব্যবহার করে টেলিগ্রাম আইডির মাধ্যমে আইএস সংক্রান্ত তথ্য পোস্ট করা হতো অনলাইনে। ২৭ জনের একজন নারী জঙ্গিদের মগজ ধোলাই এবং কয়েকজন আত্মঘাতী বাহিনী তৈরির কাজে নিয়োজিত। আর এসব নারী জঙ্গির পেছনে কলকাঠি নাড়ছে জামায়াতের আনুকূল্যে গড়া ছাত্রী সংগঠন ইসলামী ছাত্রী সংস্থা।
গ্রেফতার চার নারী জঙ্গিকে বুধবার পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর হাকিম প্রণব কুমার হুই এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে মিরপুর মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) শাহজালাল আলম তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চান। শাহজালাল আলম মিরপুর মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
রিমান্ডে নেয়া জঙ্গিরা হচ্ছে- আকলিমা রহমান মনি, ইসতিসনা আক্তার ঐশী, খাদিজা পারভীন মেঘলা ও ইশরাত জাহান মৌসুমী ওরফে মৌ।
ডাক্তার ঐশীর ল্যাপটপে থাকা ২৭ জনের মধ্যে কয়েকজনের তথ্য যুগান্তরের হাতে এসেছে। এদের মধ্যে ঐশীর মেডিকেল বন্ধু রাশেদা তানজুম হেনা ও তাসনীম নিশাদ প্রায় তিন বছর ধরে সক্রিয় রয়েছে জঙ্গি কার্যক্রমে। এ দু’জন ঐশীর সঙ্গে ধানমণ্ডির এক বাড়িতে তালিম নিত। বাবেয়া বিনতে আজহার নারী জঙ্গিদের মগজ ধোলাইয়ের কাজ করছে। মুন্নি, আমিনা, সুইটি, শাহিদা, তানিয়া, মারিয়া, মৌসুমী, সুলতানা, খালেদা, নিলুফা, তাহেরা, লাবিয়া, তমিনা ও শাপুর (পাকিস্তানি নাগরিক) দাওয়াতি কার্যক্রম ও অর্থ সংগ্রহে যুক্ত। এদের কয়েকজন সুইসাডাল স্কোয়াডের সদস্যও সংগ্রহ করে থাকে।
ডাক্তার ঐশীর বাবা ডাক্তার বিশ্বাস আক্তার হোসেন ঢামেক হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক। মা-ও চিকিৎসক, নাম নাসিমা সুলতানা। ঐশীর জনতা ব্যাংকের এক অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ টাকা রয়েছে। গোয়েন্দারা তার ব্যাংক হিসাবের তথ্য খতিয়ে দেখছেন।
মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী খাদিজা পারভীন মেঘলা স্বীকার করেছে, অধরা ধ্র“ব নামে তার একটি ফেসবুক আইডি আছে। এ ফেইক আইডিতে সে জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এ আইডিতে তার ১০০ ফ্রেন্ড রয়েছে, যাদের লক্ষ্য করে সে কাজ করছিল।
সে স্বীকার করেছে- মৌ তাকে জানায়, ২০১৬ সালে ঠিক নবুয়তের আদলে মুসলিম উম্মাহর জন্য একজন খলিফা আসবে। তিনি সারা বিশ্ব শাসন করবেন। এসব কথা বলে মৌ তাকে প্রথম খেলাফতের দাওয়াত দেয়। পরে তাকে কিছু জিহাদি বই দেয়। প্রায় তিন বছর ধরে তারা এক হয়ে কাজ করছে। তাদের ব্লাড রোজ নামে একটি গ্রুপ আছে। গ্রুপের সদস্যরা সামাজিক মাধ্যমে নানা কৌশলে সদস্য সংগ্রহ করে।
মানারাত ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী আকলিমা রহমান ওরফে মনি। সে জানিয়েছে, হিজবুত তাহরির ও কথিত আইএসের জন্য সে লোক রিক্রুটের দায়িত্বে ছিল। জামায়াতের ছাত্রী সংস্থার বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করে দুই বছর ইন্টারনেটের মাধ্যমে আইএসের বিভিন্ন তথ্য আপলোড করে তা বিভিন্নজনকে পাঠাতে।
এছাড়া বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ (ইয়ানত) করে জঙ্গিদের ফান্ডে দিত। এ টাকা তার কাছ থেকে গ্রহণ করত টঙ্গীর আনসার আলী। এই আনসারের মাধ্যমে মাহমুদুল হাসান নামে আরেক জঙ্গির কাছে অর্থ যেত।
সম্প্রতি মাহমুদুলকে র্যাব গ্রেফতার করে। পরে তার তথ্যের ভিত্তিতে নারী জঙ্গি নেটওয়ার্কের তথ্য পাওয়া যায়।
মানারাতের একই বিভাগের নতুন শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান মৌসুমী (মৌ) গোয়েন্দাদের জানায়, সে আল কায়দা নেতা আনওয়ার আওলাকীর জীবনদর্শনের অডিও এবং ভিডিও সংগ্রহ করে। পরে তা অনেকের মাঝেই ছড়িয়ে দেয়। তার মা মাকসুদা রহমান জামায়াতের সমর্থক।
ইশরাতের তথ্য অনুযায়ী, আওলাকীর অডিও লেকচারের ২২টি সিরিজ সে নিজে শোনে। পরে বাংলায় ডাবিং করা আরও ৩০টি সিরিজ সংগ্রহ করে। মাসখানেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের প্রভাষক আবদুল আজিজ তাকে পেন ড্রাইভে করে কিছু তথ্য দেয়। আজিজ আরবিও শেখাতেন। তিনি দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন। আজিজের মতোই তাদের জিহাদি সংক্রান্ত শিক্ষক হিসেবে কাজ করে জিয়াউর রহমান নামে আরেকজন। এরা আত তামকিন সাইটের মাধ্যমে লেকচার শোনারও পরামর্শ দেয়।
জিজ্ঞাসাবাদে ইশরাত আরও জানায়, তারা বড় একটি গ্রুপ তৈরির চেষ্টা করে। এজন্য আনসার ইসলামিয়া ও খিলাফাহ নিউজ নামে দুটি লিংক তারা ছড়িয়ে দেয় সামাজিক মাধ্যমে। এছাড়া তাদের দলের সদস্যরা আইএসের স্বর্ণমুদ্রা সংক্রান্ত তথ্য নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি করে।
র্যাব-৪-এর অধিনায়ক অ্যাডিশনাল ডিআইজি খন্দকার লুৎফুল কবীর যুগান্তরকে বলেন, আমরা প্রাপ্ত তথ্যগুলো খতিয়ে দেখছি। পাশাপাশি বিভিন্ন ডিভাইস ল্যাপটপ ও পেন ড্রাইভে যাদের নাম এসেছে তাদের ধরতে অভিযান চলছে।
তিনি বলেন, গ্রেফতার চার জঙ্গিকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মঙ্গলবার ওই চারজনকে গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদি বই, ডকুমেন্টারি, অডিও ও ভিডিও উদ্ধার করা হয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.