দেশে চাদর তৈরির সবচেয়ে অধিক কারখানা গড়ে উঠেছে রূপগঞ্জের কাঞ্চন এলাকায়। এখানকার শতাধিক কারখানায় তৈরি হচ্ছে উন্নতমানের চাদর। শীতের আগমনে কাঞ্চনে তৈরি চাদরের বেড়েছে চাহিদা। চাহিদা মেটাতে কাঞ্চন এলাকায় অবস্থিত পাওয়ারলুম কারখানাগুলো সচল থাকে রাতদিন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কর্মচারী আর মালিকদের কর্মকাণ্ডে কাঞ্চন এখন কর্মমুখর সজাগ জনপদ। ইতিহাস: স্বাধীনতার পরপর কাঞ্চন এলাকার মৃত মিছির আলী ভূঁইয়া প্রখম জাপান থেকে হ্যান্ড লুম মেশিন আমদানি করেন। তিনি প্রথম পলিস্টার সুতা দিয়ে পাতলা চাদর উৎপাদন শুরু করেন। তখন দেশজুড়ে পলিস্টার চাদরের কদর শুরু হওয়ায় একই এলাকার গোলজার হোসেন মোল্লা, হাজী রফিজউদ্দিন ভূঁইয়া, হাজী সাইজদ্দিন, মো. চান মিয়া, আলফাজদ্দিন, হাজী আবদুল বারেক মিয়াসহ অনেকেই হ্যান্ড লুম আমদানি করে চাদরের কারখানা গড়ে তুলেন। ১৯৮৩ সালে এলাকায় বিদ্যুৎ চলে আসলে তারা সবাই চাদর তৈরির জন্য বৈদ্যুতিক পাওয়ারলুম স্থাপন শুরু করেন। তারা তখন শিয়াল কোট ও এনডি নামক চাদর উৎপাদন করে দেশে শিয়াল কোট ও এনডি চাদরের বিশাল বাজার তৈরি করেন। এভাবে অবহেলিত কাঞ্চন হয়ে উঠে চাদরের পল্লী। চাদর শিল্পকে আরো উন্নত করার জন্য ১৯৯০ সালে বিদেশ থেকে জ্যাকেট মেশিন আমদানি করা হয়। আর সেই জ্যাকেট মেশিনের মাধ্যমে অত্যাধুনিক ডিজাইনের নানা বাহারি চাদর তৈরি শুরু হয়। বর্তমানে কাঞ্চন এলাকায় এম হালিম টেক্সটাইল, মজিদ টেক্সটাইল, চার ভাই টেক্সটাইল, রুপা টেক্সটাইল, সিদ্দিক টেক্সটাইল, কাঞ্চন টেক্সটাইল, আমির টেক্সটাইল, বিএম টেক্সটাইল, সাইজদ্দিন টেক্সটাইল, নুর মোহাম্মদ টেক্সটাইল, রহমান টেক্সটাইল, রায়হান টেক্সটাইল, আলম টেক্সটাইল, সাউদিয়া টেক্সটাইল, হানিফ টেক্সটাইল, মদিনা টেক্সটাইল, হাবিবুর টেক্সটাইল, মোতালিব টেক্সটাইল, কাউসার টেক্সটাইল, জয়নাল টেক্সটাইল, মাস্টার টেক্সটাইল, রউফ টেক্সটাইল, গাউছিয়া টেক্সটাইল, মোজাম্মেল টেক্সটাইল, মাহমুদা টেক্সটাইল, তারিক-বিন মজিদ টেক্সটাইল, আয়েশা টেক্সটাইল, খালেক টেক্সটাইল, শিল্পী টেক্সটাইল, তানভীর টেক্সটাইলসহ প্রায় শতাধিক পাওয়ারলুম কারখানা রয়েছে। এসব পাওয়ারলুম কারখানায় প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার লোক কাজ করে তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। বাজার: এ শিল্পকে প্রসার করতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে হাট। এদের মধ্যে দেশের বৃহত্তর পাইকারি বাজার নরসিংদীর শেখেরচর বাবুর হাট, রূপগঞ্জের গাউছিয়া মার্কেট, করটিয়া, শাহাজাদপুর, কুষ্টিয়ার পোড়াদহ, এনায়েতপুর, সোহাগপুর বেশ সু পরিচিত। সপ্তাহে একদিন করে সেসব এলাকায় হাট জমে উঠে। এছাড়া পর্যটন এলাকাখ্যাত সিলেট, কক্সবাজারে রয়েছে বেশ চাহিদা। অপরদিকে রাজধানীর সদরঘাট, নিউ মার্কেটস বড় বিপণিবিতানে এ চাদরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জানা যায়, প্রতি পিস চাদর তৈরি করে তা বাজারজাত করা পর্যন্ত সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয় কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। আর প্রতি শীত মৌসুমে কাঞ্চন এলাকার এ সমস্ত পাওয়ালুম কারখানা থেকে প্রায় ১২ থেকে ১৪ লাখ পিস চাদর উৎপাদন করা হয়। এ ব্যাপারে চারভাই টেক্সটাইলে মালিক আবুল হোসেন বলেন, আমাদের দেশে ভারতীয় কাশ্মীরী চাদরের চাহিদা ও সুনাম রয়েছে অনেক। কিন্তু দাম বেশি থাকায় অনেকে তা কিনতে পারেন না। তাছাড়া কাশ্মীরী চাদরের নামে পাকিস্তান ও ভারতের টেক্সটাইল মিলে তৈরি নিম্নমানের চাদর আমাদের দেশে প্রবেশ করছে। তাদের চেয়ে অনেক উন্নতমানের চাদর আমাদের এলাকায় তৈরি হয়। গুণগতমান আর স্বল্প দামে অতি সহজে প্রায় সকলেই এ চাদর কিনে ব্যবহার করতে পারছেন। হালিম টেক্সটাইলের মালিক এম এ হালিম বলেন, আমাদের দেশে প্রতি বছর শীতের তাপমাত্র এক রকম থাকে না। যার দরুন প্রায় বছরই আমাদের লোকসানের বোঝা বইতে হয়। সরকার যদি এ চাদর শিল্পকে ব্যাপক প্রসার করার ব্যবস্থা করে দেয় । এমনকি এ দেশ থেকে বিদেশ এ চাদর রপ্তানি করার জন্য সহায়তা করেন তাহলে আমাদের এ চাদর শিল্প আরো ব্যাপক প্রসার লাভ করতে পারবে। তাছাড়া বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চাদরের চাদিহা তৈরি হবে। দেশে নকল চাদর প্রবেশ বন্ধ হবে। অনেক কারিগর ও মিল মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চাদর তৈরিতে মূলত উপকরণ হিসেবে চায়না থেকে আমদানি করা বিসকস সুতো, উলেন সুতো, লিলেন আর সাইজিংয়ের সুতোর ব্যবহার হয়ে থাকে। একটি ভালো মানের পুরুষদের ব্যবহারের চাদরের উৎপাদন খরচ ৮০০-৯০০ টাকা পরে যায়। এছাড়া সর্বনিম্ন দুই আড়াইশ’ টাকার মধ্যেও কাঞ্চনের চাদর পাওয়া যায় বলে জানা যায়। শেষ কথা: স্বাধীনতার পর থেকে শত প্রতিকূলতার মাঝে সরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই অনেকটা প্রচারবিমুখভাবে একটি সম্ভাবনাময় শিল্পকে স্থানীয়ভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। যদি সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায় দেশজুড়ে কাঞ্চনের মতো আরো অনেক অজোগায়ে তৈরি হবে আমাদের চাদর, বাংলাদেশের চাদর। রপ্তানি হবে বিশ্বজুড়ে, বন্ধ হবে নকল চাদরের প্রবেশ। বাঙালির হাতের ছোঁয়ায় চাদরের বিশাল বৃত্তের এক কোণে ঝলঝল করবে আমাদের হলোগ্রাম ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। তবেই সমৃদ্ধ হবে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.