কিশোরগঞ্জে ২০১৬ সালের প্রায় পুরোটা সময়েই আলোচনায় ছিল পারিবারিক নৃশংসতা। পারিবারিক নৃশংসতার চরম নিষ্ঠুরতার বলি হতে হয়েছে অন্তত ৬ শিশুকে। জন্মদাত্রী মা অথবা জন্মদাতা পিতার হাতে নৃশংসভাবে জীবন দিতে হয়েছে তাদের। এদের মধ্যে চার শিশু মায়ের হাতে এবং দুই শিশু বাবার হাতে খুন হয়। মা এবং বাবার হাতে একের পর এক শিশু সন্তান খুন হওয়ার এমন অবিশ্বাস্য ঘটনার মতো প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাবার পরিকল্পনায় এক তরুণীও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বাইরে নিজ ঘরের আততায়ী অর্থাৎ স্বজনদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছে আরো অন্তত ২০ নারী-পুরুষ। এর মধ্যে গর্ভধারিণী মা যেমন নাড়িছেঁড়া ধন ছেলের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, তেমনি ঔরসজাত সন্তানের হাতে পৈশাচিকভাবে খুন হয়েছেন বাবা। আবার সহোদর ভাইদের হাতও রঞ্জিত হয়েছে ভাইয়ের খুনে রাঙা রক্তে। বাবা-মায়ের হাতে সন্তান, সন্তানের হাতে বাবা-মা এবং ভাইয়ের হাতে ভাই খুনের ঘটনার পাশাপাশি স্বামীর হাতেও নৃশংসভাবে জীবন দিতে হয়েছে স্ত্রীকে। ফলে বছরজুড়ে অন্যান্য ঘটনাকে ছাপিয়ে আলোচিত ছিল এসব পারিবারিক নৃশংস খুনের ঘটনা। ২০১৬ সালের শুরুতেই গত ২৬শে জানুয়ারি বাজিতপুরে নাড়িছেঁড়া ধন ছেলের হাতে খুন হন মোস্তফা বানু (৭০) নামে এক গর্ভধারিণী মা। উপজেলার দিলালপুর ইউনিয়নের দাড়িয়াকান্দি গ্রামে ঘাতক ছেলে জালাল (৩২) মা মোস্তফা বানুকে বটি দা দিয়ে জবাই করে হত্যা করে পালিয়ে যায়। পরদিন ২৭শে জানুয়ারি বিকালে মাতৃহন্তারক জালালকে বি-বাড়িয়া সদরের সোহাগপুরের মালিহাটি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই ঘটনার এক সপ্তাহ আগে গত ২১শে জানুয়ারি দুপুরে ভৈরবে সৎমায়ের হাতে খুন হয় সাড়ে তিন বছর বয়সী শিশুপুত্র আলভী। শিশুটিকে তার সৎমা কল্পনা বেগম বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেছে, এমন অভিযোগে শিশুটির বাবা আল আমিন মামলা করায় আদালতের নির্দেশে গত ১লা মার্চ দুপুরে দাফনের ৪০ দিন পর শিশুটির লাশ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়। এর মাঝেই গত ৩রা ফেব্রুয়ারি বিকালে হোসেনপুরের টানসিদলা গ্রামে পারিবারিক কলহের জের ধরে স্ত্রী নুরুন্নাহার (২৫) কে পিটিয়ে হত্যা করে বর্বর স্বামী সোহেল মিয়া। হত্যাকাণ্ডের প্রায় দুই মাস পর গত ২৬শে মার্চ ঘাতক স্বামী সোসেল ওরফে সোহেল এবং ভাসুর মানিক মিয়াকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। হোসেনপুরে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনের রাতেই লাঠি দিয়ে আঘাত করে এবং চাপাতি, ছোরা ও চাকু দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে ঘটনাস্থলেই খুন করা হয় জেলার নিকলী উপজেলার দামপাড়া পূর্ব নয়াহাটি গ্রামের দিনমজুর লোকমান মিয়াকে। চাচাতো ভাই হাবিবের কাছে থাকা এক লাখ টাকা ফেরত চাওয়ায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় লোকমান। গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি পরকীয়ার জের ধরে নিকলীরই এক মায়ের হাতে খুন হয় মোহাম্মদ আলী নামে মাত্র দেড় বছর বয়সী শিশুপুত্র। উপজেলার ছেত্রা পাথারকান্দি গ্রামের আনছর আলীর মেয়ে রেনু আক্তার নতুন সংসারে উপদ্রব মনে করে তার শিশুপুত্রকে খুন করে। ফেব্রুয়ারি মাসেই পাকুন্দিয়ায় যৌতুকের দাবি মেটাতে না পারায় উপজেলার হরশী গ্রামে গৃহবধূ শিরিনা আক্তার (২৪)কে পুড়িয়ে হত্যা করে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাবার বাড়ি থেকে এক লাখ টাকা যৌতুক এনে দিতে অস্বীকার করায় স্বামী রুবেল মিয়া (৩০), ভাসুর জুয়েল, দেবর খায়রুল ও শাশুড়ি নাসিমা মিলে শিরিনাকে মারপিট করে একপর্যায়ে তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি দুপুরে গৃহবধূ শিরিনার মৃত্যু হয়। ফেব্রুয়ারি শেষে মার্চের শুরুতেই গত ৫ই মার্চ সকালে কিশোরগঞ্জ সদরের মারিয়া ইউনিয়নের প্যারাভাঙ্গা গুচ্ছগ্রামে মাত্র ১৫ মাস বয়সী শিশুপুত্র মাহাথিকে গলা কেটে হত্যা করে মা ছালমা বেগম। এই ঘটনায় পুলিশের হাতে আটকের পর মা ছালমা বেগম আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে শিশুপুত্র মাহাথি হত্যার দায় স্বীকার করে। মানসিক অসুস্থতার জন্য সে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তার স্বীকারোক্তিতে জানায়। এমন উদ্বেগজনক অবস্থার মধ্যেই গত ৯ই মার্চ কটিয়াদীতে ঔরসজাত ছেলের হাতে খুন হন মুক্তিযোদ্ধা বাবা এমদাদুল হক মানিক (৬৫)। উপজেলা সদরের পশ্চিমপাড়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা এমদাদুল হক মানিককে ঘরের ভেতর প্রায় চার ঘণ্টা আটকে রেখে থানা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও এলাকাবাসীর সামনেই রড দিয়ে পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে মাদকাসক্ত ছেলে আনোয়ারুল কবীর জন (৩৮)। এর মাত্র তিন দিন পর গত ১৩ই মার্চ রাতে মাত্র দুইশ’ টাকার জন্য স্কুলছাত্র ছোট ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে নিহত হয় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার রশিদাবাদের বেরুয়াইল এলাকার কৃষক সোহেল মিয়া (৩৫)। গত ২১শে মার্চ সন্ধ্যায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আততায়ী সহোদর জিয়াউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র হৃদয় আহমেদ ইমরান। আটকের পরদিন ২২শে মার্চ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় এই ভ্রাতৃহন্তারক। গত ২৬শে মার্চ দুপুরে হোসেনপুরের মধ্য গোবিন্দপুর গ্রামে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভাতিজি রেখা আক্তারের হাতে খুন হন চাচা কাছুম আলী (৭০)। একই দিন ২৪শে মার্চ ভোরে পাকুন্দিয়া উপজেলার পাটুয়াভাঙ্গা ইউনিয়নের জুনাইল গ্রামে মাদকাসক্ত বাবা কাশেম মিয়া ঘুমন্ত চার বছর বয়সী শিশুপুত্র ইমরানকে কাস্তে দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে। পরে পাশের নির্মাণাধীন একটি ভবনের মেঝেতে গর্ত খুঁড়ে সেখানে শিশুপুত্রের লাশ রেখে মাটিচাপা দেয় বর্বর বাবা। পরে ২৬শে মার্চ দুপুরের দিকে দাদা সুলতান মিয়া ছেলে কাশেমের কাছে গিয়ে নাতি ইমরানের খোঁজ করতে গেলে ধরা পড়ে বাবার হাতে শিশুপুত্র খুনের এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটি। পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর শিশুসন্তানকে হত্যার দায় স্বীকার করে নেয় ঘাতক বাবা কাশেম। পরে আদালতেও ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় সে। গত ৪ঠা মে নিকলীতে স্বামীর হাতে এক গৃহবধূ ও তার একমাত্র শিশুসন্তান খুন হয়। উপজেলার ছাতিরচর পুরানহাটি গ্রামে গৃহবধূ শুকতারা আক্তার (২২) ও তার তিন বছর বয়সী শিশুপুত্র মাহিন (৩) খুনের ঘটনায় নিহত শুকতারা আক্তারের বাবা রজব আলী বাদী হয়ে নিকলী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়েরের পর স্বামী মাসুক মিয়া (২৮) কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৫ই মে সকালে বাজিতপুর উপজেলার কৈলাগ ইউনিয়নের কুক্রারাই গ্রামে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চার সন্তানের জননী ময়না বেগম (২৭) কে কুপিয়ে হত্যা করে পাষণ্ড স্বামী সিদ্দিক মিয়া। করিমগঞ্জে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে জন্মদাতা বাবার পরিকল্পনায় মাদরাসা ছাত্রী আছমা আক্তার মীরা (১৯) খুন হয়। গত ১০ই আগস্ট রাতের এই কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেয় চাচা খুর্শিদ মিয়া ও চাচাতো ভাই সাদেক মিয়া (২৮)। করিমগঞ্জ উপজেলার ভাটিয়া জহিরকোনা গ্রামের ওই মাদরাসা ছাত্রীকে গলা কেটে হত্যার পর বাড়ি সংলগ্ন একটি ঝোপে তার লাশ ফেলে রাখা হয়। পরে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে, আছমা আক্তার মীরা হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী তার বাবা আনোয়ারুল হক আঙ্গুর। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে তিনি তার স্বজনদের নিয়ে এই হত্যার ছক সাজিয়েছিলেন। ১০ই সেপ্টেম্বর সকালে ভৈরবে আড়াই বছর বয়সী শিশুপুত্র ইয়ামিনকে পুড়িয়ে হত্যা করে মা শিরিন বেগম (৩০)। উপজেলার শিমুলকান্দির চানপুর গ্রামে মোবারক মিয়ার স্ত্রী শিরিন বেগম জ্বলন্ত চুলায় শিশুপুত্র ইয়ামিনকে গুঁজে দিয়ে ভাতের ফুটন্ত হাড়ি সেই চুলায় ঢেলে দেন। রান্নাঘরের অদূরে বসে থাকা শিরিনের পাঁচ বছর বয়সী অপর ছেলে রিফাত সেই দৃশ্য দেখে প্রতিবেশীদের খবর দিলে শিরিন পালিয়ে যান। এ সময় প্রতিবেশীরা জ্বলন্ত আগুন থেকে শিশু ইয়ামিনের প্রায় অঙ্গার হয়ে যাওয়া মৃতদেহ উদ্ধার করে। এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাশের নবীপুর গ্রাম থেকে শিরিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এছাড়া গত ২৩শে নভেম্বর সকালে পাকুন্দিয়ায় উপজেলার সুখিয়া ইউনিয়নের খলিশাখালী গ্রামে গাছ বিক্রির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে ছোট ভাইয়েরা মিলে বাসচালক বড় ভাই লিটন মিয়া (৫০) কে কুপিয়ে হত্যা করে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.