দেশের রাজধানী মেগাসিটি ঢাকা হু হু করে বাড়তে থাকা জনসংখ্যা, সাঁই সাঁই করে উঠতে থাকা বহুতল ভবন, বিশাল মার্কেট কমপ্লেক্স, আধা ডজন ফ্লাইওভার, এই-এলো-বলে মেট্রোরেল ইত্যাদিতে উন্নয়নে টবগাচ্ছে। আবার মুদ্রার অপর পিঠের সত্য হলো_ দুনিয়ার জরিপে ঢাকা একটি প্রায় ‘অবাসযোগ্য’ নগর। উন্নয়নের গতির পাশাপাশি আমাদের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও নাগরিক-আচরণের নিম্নমান অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কদর্যভাবে ফুটে উঠল নগরের সর্বশেষ সুন্দরতম সংযোজন হাতিরঝিলে। অনেক টাকা খরচ করে প্রকল্প নির্মাণের পরে ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে চরম অবহেলার দৃষ্টান্ত আমরা বহুক্ষেত্রে স্থাপন করেছি। হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ অবশ্য এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। প্রাকৃতিক নিচু জলাভূমিকে সুবিন্যস্ত ঝিল, রাস্তা ও সেতু দিয়ে উন্নত করে রাজধানীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে যাতায়াত-পরিবহন সহজতর করা এবং নগরবাসীর চিত্তবিনোদনের উন্মুক্ত স্থানে পরিণত করার মূল প্রকল্পটি হয়েছে। চলাচলের রাস্তা খুলে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছিলেন ২০১৩ সালের সূচনায়। তখন মহাধুমধামে নৌকাবাইচ ও আতশবাজি হয়েছিল। এখন ভাসমান রেস্তোরাঁ, ওয়াটারট্যাক্সি, অ্যাম্ফিথিয়েটার প্রভৃতি পার্শ্বপ্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। গতকাল সমকাল-এ ‘দুর্গন্ধে ম্লান সৌন্দর্য’ শিরোনামে ঝিলের পানিতে নোংরা আবর্জনায় দুর্গন্ধে টেকা দায় বলে যে তথ্য জানা যায় তাতে সব আনন্দ ম্লান হয়ে আসে। হাতিরঝিল বর্তমানে রাজধানীর সুন্দরতম এলাকা এবং রাজধানীর মধ্যে বৃহত্তম জলাশয়। জল কেটে আঁকাবাঁকা ১৭ কিলোমিটার আধুনিক রাস্তা, সেতু, উড়াল রাস্তা, উড়াল সেতু, সন্ধ্যার পর জলে প্রতিফলিত রাস্তার আলো, সব মিলিয়ে প্রথম দিকে এলাকাটিকে ঢাকা নগরে এক টুকরো প্যারিস বলে অনেকে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। এখন গাছগুলো বড় হয়ে এলাকাটি সবুজ সৌন্দর্যে ভরে গেছে। বহু লোক বিকেলে সপরিবারে বেড়াতে আসেন। তেজগাঁও-গুলশান-বাড্ডা-বনশ্রী-নিকেতন-মগবাজারের মধ্যে থাকা পতিত জলাভূমিটি বদলে গিয়ে এখন নগরের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের দূরত্ব কমিয়েছে এবং খোলা আকাশের নিচে ঘোরার চাহিদা মেটাচ্ছে। এত কিছুর পরে যদি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এলাকাটি নোংরা হয়ে যায় তাহলে কী সার্থকতা ও কী সান্ত্বনা? খবরে বলা হয়েছে, কিছু অংশে বেড়াতে এসে নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পালাতে হয়। এমনকি পাঁচতারা হোটেল সোনারগাঁওয়ে পুলসাইডে বসে অতিথিরা অস্বস্তিতে ভোগেন। প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, ঝিলকে দূষিত পানি থেকে বাঁচাতে ঢাকা ওয়াসার তৈরি ট্রান্সফার টানেলে সমস্যা হয়েছে এবং একটি ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরি সম্পূর্ণ হয়নি। অন্য যে সমস্যাটি খবরে চিহ্নিত করা হয়েছে তা নগরবাসীর জন্য অতি লজ্জার। ঝিলের পানিতে ও রাস্তায়ও মানুষ মলমূত্র ত্যাগ করে। এমনকি পানি পর্যন্ত নেমে আসা বসার সিঁড়ি-ধাপগুলোর গোড়ার দেয়ালটি ‘টয়লেটে পরিণত’ হয়েছে। দিনে নিষিদ্ধ হলেও রাতে রিকশা চলে; রিকশা ও অটোরিকশা চালকরা অনেকে এলাকাটিকে রাতের ও ভোরের টয়লেট বানিয়েছেন। গুলশান ও বনানী লেকের সঙ্গে ঝিলের সংযোগ বা কোথাও বাসাবাড়ির সুয়ারেজ লাইন ঝিলে পড়ার জন্য দূষণ ঘটছে কি-না তা কর্তৃপক্ষকে দেখতে হবে এবং বিহিত করতে হবে। ওয়াসার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্তরা যে অপেক্ষায় বসে থাকবেন এটি ‘সমন্বয়হীনতা’ নামক দেশের একটি জটিল রোগের লক্ষণ। সিটি করপোরেশন বহুকাল থেকে সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একক বা সমন্বিত কর্তৃত্বে আনার কথা বলে কল্কে পাচ্ছে না। হাতিরঝিলের পরিবেশ নষ্ট হওয়ার জন্য যারা দায়ী তাদের জবাবদিহিতায় আনতে হবে এবং প্রয়োজনে লোকবল নিয়োগ করে পাহারা বসাতে হবে। দুষ্ট নাগরিকদের জরিমানাসহ শাস্তির ব্যবস্থা ও নাগরিক-সচেতনতা বাড়ানোর কার্যক্রম নিতে হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.