বৈদেশিক মুদ্রা পাচার ও অবৈধ লেনদেনে জড়িয়ে পড়ছে মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো। লাইসেন্সের শর্তও মানছে না অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় কঠোর বাংলাদেশ ব্যাংক। লাইসেন্স নেয়া ৬৩৬ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪২০টিই বাতিল করা হয়েছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়ম তদন্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন করে লাইসেন্স ইস্যু বন্ধ রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত লেনদেনসীমার বাইরেও ব্যবসা করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। দেশজুড়ে কয়েকশ’ দালালচক্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে এ ব্যবসা। প্রত্যন্ত অঞ্চল ও হাটবাজার থেকে সংগ্রহ করে মানিচেঞ্জারে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিচ্ছে এসব চক্র। আর জোগানের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে অর্থ পাচারকারীদের হাতে। পাশাপাশি ভুয়া ঠিকানায় ব্যবসা পরিচালনা করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হলেও নবায়ন করছে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বুধবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যুগান্তরকে বলেন, মানিচেঞ্জারের লাইসেন্স বাতিল করে ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। লাইসেন্স নিয়ে অবৈধ কার্যক্রম বা লাইসেন্স ছাড়া ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করতে দেয়া হবে না। এ ধরনের অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আরও পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আছেন। তারা এ বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করেই ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা যুগান্তরকে বলেন, মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কড়া নজরদারি রাখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন করে কোনো লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে না। আর কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত ৬৩৬টি মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে লাইসেন্স বাতিলের পর বর্তমানে ২১৬টি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১৬৮টি, চট্টগ্রামে ২১টি, খুলনায় ১৩টি, বগুড়ায় ৪টি, বরিশালে ২টি, রাজশাহীতে ৬টি, রংপুরে ৪টি ও সিলেট অঞ্চলে ১৫টি রয়েছে। তবে লাইসেন্স বাতিলের পর এ পর্যন্ত আদালতে ২৬টি মামলা হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আদালতের অনুমতি নিয়ে নতুনভাবে ব্যবসা করছে।
সূত্রমতে, মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স বাতিলের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করেছে। দেখা গেছে, ব্যবসা পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্তগুলো অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান পরিপূর্ণভাবে পালন করেনি। লাইসেন্স নেয়ার ঠিকানায় অস্তিত্ব নেই প্রতিষ্ঠানের। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যবসা আরম্ভ করা হয়নি। প্রতি মাসের লেনদেনের হিসাব বিবরণী কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। তদন্তকালে অনেক মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের কাছে অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ রাখার সন্ধান পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার ও অবৈধ লেনদেনে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ মিলেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সীমান্ত এলাকায় বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে মানিচেঞ্জার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ফৌজদারি অপরাধ বিবেচনায় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০১ সালে লাইসেন্স নেয়াকালে নগদ বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়করণের সর্বোচ্চ সীমা এক হাজার ডলার ছিল। তা এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকের সঙ্গে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার ছাড়করণের সীমা ২ হাজার ডলারে উন্নীত করার সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে।
ৃবাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেয়া শুরু হয়। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭-এর ৩ নম্বর ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সরকার এফই সার্কুলার নং-২ মোতাবেক এ লাইসেন্স ইস্যু করে। বিশেষ করে বহির্গামী ও অন্তর্মুখী পর্যটকদের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়কে ব্যবসা হিসেবে নিতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
জানা গেছে, লাইসেন্স নিয়ে অধিকাংশই জড়িয়ে পড়েছে অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যে। এর জন্য দায়ী করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঠিক নীতিমালার অভাবকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী বলেন, একজন বৈধ আয়ের ডলার নিয়ে এলেও তা কেনা যাচ্ছে না। কারণ পাসপোর্ট ছাড়া ডলার কেনা নিষিদ্ধ। এই নিয়মনীতি উপেক্ষা করে কিছু প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নিয়েও অবৈধ দালালদের মাধ্যমে ব্যবসা করছে। এ চক্রের সদস্য এক হাজারের বেশি। বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কিছু দালালের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে।
বাংলাদেশ মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের মহাসচিব একেএম ইসমাইল হোসেন বলেন, কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসির কারণে মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান ঘিরে এসব ঘটনা ঘটছে। গুণগত মানের সর্বোচ্চ একশ’ প্রতিষ্ঠান রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেয়া উচিত। সীমান্ত এলাকায় অবৈধ লেনদেনের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, অনেক ভুইফোঁড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। একাধিক শাখা ও ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে তারা ব্যবসা করছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে লাইসেন্স বাতিল হওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকা চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাতিল হওয়া প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করার কথা বলেও চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে বিজয় মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী হাফিজুর রশিদ ফকির জানান, দু’ভাবে সরকার এর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনতে পারে। রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা কেনার বিধান চালু এবং বিদেশফেরত প্রবাসীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অংকের মুদ্রা কেনার ক্ষমতা প্রদান।
জানা গেছে, বর্তমান মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো একজনের কাছ থেকে পাসপোর্টের অনুকূলে এক মাসে সর্বোচ্চ ৫ হাজার মার্কিন ডলার ক্রয় ও বিক্রয় করতে পারবে। কিন্তু বৈধ উপার্জন হলেও পাসপোর্ট ছাড়া কোনো মুদ্রা কেনার বিধান নেই। আবার এসব প্রতিষ্ঠান তাদের বৈদেশিক মুদ্রা কোনো ব্যাংকের কাছে বিক্রয় বা ক্রয় করতে পারে না।