দিনক্ষণ ঠিক করে একেবারে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে আনন্দ প্রকাশে স্বাভাবিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। আনন্দ-ফুর্তি ও উৎসব করার জন্য দিনের বেলা বা বড়জোর সন্ধ্যারাতটাই উপযুক্ত সময়। মধ্যরাতে সব চরাচর যখন নিস্তব্ধতায় ঘুমিয়ে থাকে, তখন আকাশ বিদীর্ণ করে বোমা ফাটিয়ে বা আতশবাজি পুড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। উৎসব হলো তা-ই, যা বেশির ভাগ মানুষ উপভোগ করে। অল্প কিছু মানুষের উন্মত্ততা আর উৎসব এক জিনিস নয়। যে উৎসবের সঙ্গে বড় বড় রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পর্ক নেই, শ্রমিক সংগঠনের সম্পৃক্ততা নেই, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সায় নেই, সরকারের বা প্রশাসনের তো নেই-ই, তা আবার উৎসব কী? আর যে উৎসব পালনের সময় অন্যদের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করা হয় না; যেখানে সাধারণ সিভিক সেন্স কাজ করে না, সেটা কী ধরনের উৎসব? কেবল পাতলা ঘুমটা গাঢ় হয়েছে, ঘর-দরজা, খাট-বিছানা কেঁপে উঠল। আশপাশে বহু হাসপাতাল ও ক্লিনিক। তাতে বহু রোগীকে যন্ত্রণা উপশম করতে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়ানো হয়। আবাসিক ভবনগুলোতে কত হার্টের রোগী। ঘুমের ব্যাঘাতে তাঁদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কী দোষ পাখপাখালির? প্রচণ্ড শব্দে বিছানায় তিষ্ঠাতে না পেরে ছাদে গেলাম। আশপাশের গাছপালার ডাল থেকে কাক, শালিক, ঘুঘু প্রভৃতি এবং বিভিন্ন বাড়ির ছাদের কার্নিশ ও ঘুলঘুলিথেকে কবুতর ও চড়ুই ততক্ষণে উড়াল দিয়েছে। কিন্তু আতঙ্কিতে পাখিকুল যাবে কোথায়? তাদের ওড়ার জন্য আকাশ দিয়েছেন বিধাতা। কিন্তু আকাশে তো আগুন। যখন দেখলাম পাখিগুলো, কাকগুলো কা-কা করে আর্তনাদ করতে করতে রাস্তায় গিয়ে বসেছে মধ্যরাতে এবং ডানা ঝাপটাচ্ছে, তখন বড়ই করুণা হলো। কয়েকজন মানুষের বার্ষিক আনন্দে নিষ্পাপ পাখিদের এ কী দুর্দশা! পাখিকুল জানে না এটা বঙ্গ সন্তানদের থার্টি ফার্স্ট নাইট উদ্যাপন। আমাদের বাপ-দাদার চৌদ্দ গুষ্টি যা কোনো দিন দেখেনি, একাত্তরে তো নয়ই, সত্তরের দশকেও যা দেখিনি, তা-ই দেখতে হচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতিতে যাঁরা আমাদের আদর্শ, যাঁরা আমাদের নমস্য, সেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, মুহম্মদ কুদরাত-ই-খুদা, জয়নুল আবেদিন যে কাজ করেননি; আমরা তাঁদের থেকে বেশি আধুনিক হয়ে গেছি বলে তাঁদের চেয়ে ভালো কিছু করা শুরু করেছি। দেড়-দুই হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিতে যা ছিল না, তা-ই যোগ করেছি। যোগ অবশ্যই করতে পারি যদি তার উপযোগিতা থাকে এবং তা আনে উন্নত বাঙালি সংস্কৃতিতে উৎকর্ষ ও সৌন্দর্য। কিন্তু মধ্যরাতের ঘণ্টাখানেকের উন্মত্ততা কী যোগ করেছে আমাদের সংস্কৃতিতে?
সরকারি দাপ্তরিক কাজকর্ম গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী হয়ে থাকে; শিক্ষা-বছর শুরু হয় জানুয়ারি থেকে। সুতরাং পয়লা জানুয়ারির একটা গুরুত্ব আছে। কিন্তু উৎসবের নামে উপদ্রব করে অন্যকে কষ্ট দেওয়ার অধিকার জাতিসংঘ ঘোষিত ইউনিভার্সাল ফান্ডামেন্টাল হিউম্যান রাইট নয়। উৎসবের নামে উচ্চবিত্ত শ্রেণির কিছু ছেলেমেয়ের অর্থহীন বাড়াবাড়ি এবং তার ফলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটার আশঙ্কা বরং সব নাগরিকের মানবাধিকার হরণ।
আনন্দ প্রকাশের জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে বড়লোকদের ছেলেমেয়ে যেমন রয়েছে, তেমনি সেই আনন্দে আগুন লাগানোর মতো দুষ্টুবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যত সহজে গরিবের বস্তিতে তল্লাশি চালাতে পারে, বিত্তবানদের বাড়িতে তা সম্ভব নয়। সুতরাং তাদের কার ঘরে কত পটকা, আতশবাজি মজুত আছে এবং ফ্রিজে কী পরিমাণ মদের বোতল রয়েছে, তা সরকারের কোনো কর্মকর্তার পক্ষেই আঁচ করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে গোয়েন্দাদের পক্ষে খুবই কঠিন, কোন গুপ্তঘাতকের কাছে কী রকম অস্ত্র রাখা আছে।
সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন দেশে থার্টি ফার্স্ট নাইট পালনকালে বহু দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিছু দুর্ঘটনা আকস্মিক, অনিচ্ছাকৃত, কিছু ঘটনা হিংসামূলক। যাকে অনেকে বলেন জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ। তা কে করে, কারা করে, কেন করে, তা গবেষণার বিষয়। হলি আর্টিজানের মর্মান্তিক ঘটনার পরে আমাদের সংশ্লিষ্ট সবার উৎসব উদ্যাপন ও জাতীয় জীবনযাপনের ব্যাপারে চিন্তাভাবনার পুনর্বিন্যাস প্রত্যাশিত ছিল।
ইস্তাম্বুলের এক অভিজাত এলাকার নাইটক্লাবে নববর্ষ উদ্যাপনের আয়োজনে যে রক্তবন্যা বয়ে গেল, তা একমাত্র ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন ঘটনা প্রতিবছরই কমবেশি বিভিন্ন দেশে ঘটে। আমাদের সৌভাগ্য হতাহতের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি নেই, কিন্তু বেদনার ব্যাপার এই যে বিভিন্ন দেশের বহু মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন। যখন হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী, তখন জাতীয় জীবনে যত সংযত থাকা যায়, ততই ভালো।
আধুনিক পৃথিবীর সবকিছুর মূলে অর্থনীতি ও রাজনীতি। এ দুটি জিনিস যে দেশে স্বাভাবিক ও ভালো, সেই দেশের মানুষ মোটের ওপর ভালো থাকে। বাংলাদেশে এই দুটি জিনিস আশাব্যঞ্জক ভালো নয়। সে জন্যই একটি বছর যখন পার হয়, তখন মানুষ প্রত্যাশা করে আগামী বছরটা যেন পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে ভালো যায়। অর্থনীতিতে জিডিপি বাড়াটা খুব জরুরি, কিন্তু জিডিপি বাড়াটাই কোনো জাতির জীবনে সব নয়। জিডিপি কোনো জাতির জীবনে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে পথের ভিখারি এবং ধনকুবের সমান চিন্তিত। জীবনের নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা অনেক জরুরি বিষয়।
নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনীতির বাইরে নয় বাংলাদেশ। উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে তার সুবিধা ও সমস্যা বাংলাদেশকেও স্পর্শ করে। আগামী বিশ্বায়ন নিয়ে সচেতন মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তা থেকে আত্মরক্ষার উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা থাকা প্রয়োজন। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় এমন কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে, যার প্রতিকারের পথ কারও জানা নেই। বিশ্বায়ন উন্নয়নশীল দেশের জন্য কতটুকু সুবিধা আর কতটা ক্ষতির দিক, তার বিচার-বিশ্লেষণ অনেক বেশি জরুরি অর্থহীন আমোদ-ফুর্তি করে সময় নষ্ট করার চেয়ে।
আশির দশক থেকে একটি নতুন বিত্তবান শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে আমাদের দেশে। তাঁদের কেউ কঠোর পরিশ্রম করে বিত্তবান হয়েছেন এবং কেউ ফাঁকতালে প্রায় রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাঁদের সন্তানদের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলা অস্বাভাবিক নয়। শিক্ষার মান যা-ই হোক তার প্রসার ঘটেছে। তাঁদের সবার কর্মসংস্থান করা সরকারের সাধ্যের বাইরে। উদারীকরণ ও বেসরকারীকরণই সব সমস্যার সমাধান নয়। শিক্ষিত বেকারের বিড়ম্বনার কথা কর্তাব্যক্তিরা ভাবেন না। তাঁরা মাইক্রোফোনের সামনে কথা বলার সময় জোর গলায় বলেন, আগে একজন দিনমজুর এক দিন কাজ করে এক-দেড় কেজি চাল কিনতে পারতেন, আজ একজন দিনমজুর এক দিনের মজুরি দিয়ে ১০ কেজি চাল কিনতে পারেন। কিন্তু কর্তারা এ কথা বলেন না যে একজন দিনমজুর সারা দিন কাজ করে একটি ছোট ইলিশ মাছের অর্ধেক এবং আধা কেজি ডাল ও এক কেজি তরিতরকারি কিনতে পারেন না। বাঙালি গরিবের খাদ্য বলতে শুধু চাল বা আটা নয়। শুধু চাল সেদ্ধ করে এবং আটা গুলিয়ে খেয়ে যদি বাঁচা যেত, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকত না একজন মানুষও।
উন্নয়ন নিয়ে আমরা বড়াই করি। যে উন্নয়নের সুবিধা অন্তত ৯৫ শতাংশ মানুষ পায় না এবং নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়নির্বিশেষে যদি জনগণ না পায়, সেই উন্নয়ন অর্থবহ নয়। সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ খুব ভালো থাকলে, তাকে ভালো থাকা বলে না।
আমাদের অর্থনীতি মোটের ওপর স্বাভাবিক থাকলেও রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে। অসুস্থ রাজনীতির মধ্যে সুস্থ-স্বাভাবিক অর্থনীতি প্রত্যাশা করা যায় না। সে জন্য শুধু সরকারকে দোষ দেওয়া যাবে না। বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা ঘুমিয়ে থাকলে এবং গা বাঁচিয়ে চললে দেশে সুস্থ রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সব দায়দায়িত্ব সরকারের একার নয়; বরং ক্ষেত্রবিশেষে সরকারের বাইরে যারা, তাদের দায়িত্বই বেশি। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সুবিধার জন্য সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন, আবার সরকারকে ভালো হতে বলবেন এবং তাঁদের কথা সরকার শুনবে, তা হয় না।
সাধারণ মানুষ আজ রাষ্ট্র থেকে অনেক কিছু চায়। ৫০-৬০ বছর আগে মানুষ তা প্রত্যাশাও করত না। আজ খুব সাধারণ নাগরিকও স্বাস্থ্যসেবা চায়।
মানসম্মত আধুনিক শিক্ষা চায়। সন্তানের কর্মসংস্থান চায়। সবচেয়ে বেশি চায় নাগরিক অধিকার। মানুষ হিসেবে মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার। বাল্যবিবাহ ক্ষতিকর—এ কথা আজ যত মানুষ উপলব্ধি করছে, আগে তার দশ ভাগের এক ভাগ মানুষও তা করত না। মানুষের সচেতনতা বেড়েছে, সুতরাং তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে মানুষ আর বোকা নেই। যা খুশি তা-ই করে রাষ্ট্র পার পাবে না।
ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে জীবনের সব ক্ষেত্রেই সামাজিক মূল্যবোধের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সামাজিক মূল্যবোধ ব্যক্তিজীবনের মতো রাষ্ট্রীয় জীবনেরও সবকিছু প্রভাবিত করে। যখন আমরা সীমাহীন দুর্নীতির কথা বলি, তখন সামাজিক মূল্যবোধের বিষয়টিকে সবার আগে বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের সমাজে একধরনের স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে; কিন্তু তাকে স্থায়িত্ব দিতে হলে অনেক জরুরি কাজ করতে হবে। সে সবই হওয়া উচিত নতুন বছরের ভাবনা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.