আর্থিক কেলেংকারি, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ অনুমোদন ও যাচাই-বাছাই ছাড়া যত্রতত্র ঋণ দেয়ার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। এ কারণে গত ৬ মাসে সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক এগোচ্ছে তাতে খেলাপি ঋণ আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ অসৎ প্রক্রিয়ায় দেয়া এসব ঋণ সহজে আদায় হবে না। জড়িতদের বিরুদ্ধে সরাসরি কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
জানা গেছে- সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে ২০০৭ সাল থেকে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এমওইউতে খেলাপি ঋণ আদায়, ঋণ প্রবৃদ্ধি যথাযথ রাখা, লোকসানি শাখা ও পরিচালন ব্যয় কমানো, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও সুপারভিশনের উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তিন মাস পরপর ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে এসব লক্ষ্য অর্জনের মূল্যায়ন করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে শুধু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে হবে না। একই সঙ্গে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও বলে দিতে হবে। এরপর ব্যর্থ হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে করা বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়নে চার ব্যাংকের নাজুক পরিস্থিতি বেরিয়ে এসেছে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে তা না কমে উল্টো আরও আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, এমওইউ করে খেলাপি ঋণ কমানো যাবে না। এসব ঋণ অসৎ প্রক্রিয়ায় দেয়া হয়েছে। সোজা টাস্কফোর্স গঠন করে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। গুরুতর অপরাধের প্রমাণ পেলে প্রয়োজনে চাকরিচ্যুত করার পরামর্শ দেন তিনি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ৪ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ব্যাংকটিকে ১ হাজার ৮৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু কমানো দূরে থাক, নতুন করে আরও বেড়েছে ৬৩৮ কোটি টাকা। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৭৭ শতাংশই অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। একইভাবে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে কমানোর লক্ষ্য ছিল ৫৪০ কোটি টাকা। কিন্তু না কমে আরও বেড়েছে ১ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকটির ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ তুলনামূলক কম আছে। বর্তমানে জনতা ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৫৬ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আছে ৪ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে কমানোর কথা ৫৮০ কোটি টাকা। কিন্তু না কমে আরও বেড়েছে ৩৫২ কোটি টাকা। বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৮৮ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আছে ২ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে কমানোর কথা ২৮৩ কোটি টাকা। কিন্তু না কমে আরও বেড়েছে ১৯ কোটি টাকা। বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৯২ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকৃত চিত্র বের করার চেষ্টা করছি। সে কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি দেখা যাচ্ছে। এটা চিহ্নিত করেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্রে আরও জানা গেছে, গত জুন শেষে অগ্রণী ব্যাংকের মোট ৯৩২ শাখার মধ্যে লোকসানি শাখার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৯টিতে। অথচ গত ডিসেম্বরেও লোকসানি শাখা ছিল মাত্র ৩৪টি। জুন শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯৯ কোটি টাকা। অথচ গত ডিসেম্বর ও মার্চেও ব্যাংকটির মূলধন উদ্বৃত্ত ছিল।
জনতা ব্যাংকের ৯০৯ শাখার মধ্যে জুন শেষে লোকসানিতে গেছে ৭৪টি। যদিও গত ডিসেম্বরে লোকসানি শাখা ছিল মাত্র ১৫টি। জুন শেষে জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬৪ কোটি টাকায়। গত ডিসেম্বরে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৯ কোটি টাকা।
রূপালী ব্যাংকের ৫৬০টি শাখার মধ্যে জুন শেষে লোকসানি শাখা দাঁড়িয়েছে ১২৬টিতে। অথচ গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির মাত্র ১০টি শাখা লোকসানে ছিল। জুনে রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫২ কোটি টাকা, যা গত ডিসেম্বরে ছিল ২৪৫ কোটি টাকা।
এ ছাড়া চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সোনালী ব্যাংক লোকসান দিয়েছে ৩৪৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের ১৪৮ কোটি টাকা এবং বেসিক ব্যাংকের লোকসান ৪৮ কোটি টাকা। তবে এ সময়ে জনতা ব্যাংক ১৪১ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংক ৯ কোটি টাকা ও বিডিবিএল ব্যাংক ২ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.