বৈশাখ উদযাপনে নারীরা: হেফাজতে ইসলামীর চোখ রাঙানিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বৈশাখ উদযাপন করেছে নারীরা। নিজেদের নিরাপত্তার বিধান নিজেরাই করবেন, এই মনোবল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসা হাজারও নারী মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে নেচে গেয়ে একপ্রকার প্রতিবাদই জানিয়েছেন।এর আগে সপ্তাহজুড়ে নতুন বছর বরণের উৎসাহ উদ্দীপনা এবং বাঙালি সংস্কৃতি ধারণে মানুষের আগ্রহ নষ্ট করতে ভয় দেখানোর জন্য একের পর এক ‘ফতোয়া’ দিয়েছে হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামী দলগুলো। সর্বশেষ জীবজন্তুর মূর্তি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা, মুখে উল্কি আঁকা এবং নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ ইসলাম সম্মত নয় ও বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি প্রচার চালানো হয় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও।
ভোর সাড়ে ৬টায় রমনা বটমূলে ছিলো ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ভোর থেকেই হেঁটে হেঁটে রমনা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে সববয়সী নারীরা। তাদের চোখে মুখে ভয়ের লেশমাত্র ছিল না। এমনকি অংশ নেওয়া অনেকেই বলছেন, এ ধরনের ভয়ভীতির পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইলে সবার আরও বেশি করে বাইরে আসা জরুরি। সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ছিলো চ্যানেল আই ও সুরের ধারার আয়োজনে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। ভোর সাড়ে ৫টায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ৫টা থেকেই অন্ধকারের মধ্যেই আসতে শুরু করে নারীরা। সাদা লাল শাড়িতে ভরে যায় প্রাঙ্গণ। পঞ্চাশোর্ধ আয়েশা বেগম এসেছেন ছেলের বউ নাতি নাতনিদের নিয়ে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা যদি এসবের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে না দিই তাহলে কী করে শিখবে এরা। ছেলে বিদেশে আছে বলে আমার বউমা বাসায় বসে থাকবে তাওতো হয় না। আর ছেলেরা ঠিক থাকলেইতো আমরা নিরাপদ। আমাদের ওপর দোষ চাপানোর কৌশল এখনকার প্রজন্ম মেনে নেবে না।
আর নারীনেত্রী ও অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান থাকলে এ ধরনের ‘ফতোয়াবাজি’ করার কথা ভাবতো না এসব সংগঠন। এরা কেবল ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করতে চায়। মানুষ সাংস্কৃতিকভাবে শক্তিশালী হলে তাদের কুসংস্কারগুলো শুনবে না, সেটা তারা জানেন এবং জানেন বলেই ভয় তৈরি করতে চান। হেফাজতে ইসলাম তাদের দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা ঈমান-আকিদা ও ইসলামী আদর্শের ঘোরতর বিরোধী। বর্ষবরণের নামে মূলত মুসলমনাদের ঈমান-আকিদাবিরোধী ভিনদেশি হিন্দুত্ববাদি সাংস্কৃতির প্রসার ঘটানোর চেষ্টামঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলা হয়, ইসলামের বিশ্বাস মতে কোনও জীবজন্তু, বন্যপ্রাণী ও দেবদেবীর মূর্তির কাছে কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করলে ঈমান থাকবে না। মুসলমানকে কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করতে হবে একমাত্র আল্লাহর কাছেই। সুতরাং মুসলমানদের জন্যে মঙ্গল শোভাযাত্রার সংস্কৃতি চর্চা অবশ্যই পরিত্যাজ্য চলছে।চারুকলা বিভাগের আয়োজনের অন্যতম শিক্ষক নেসার আহমেদ বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের হাত ধরে শুরু হয়নি। আমরা সামাজিক রাজনৈতিক যেসব বিষয়কে প্রতিরোধ করা জরুরি মনে করি, সেসব থিম ধরে মঙ্গল কামনায় এই র্যালি করে থাকি। এটাকে ভুল ব্যাখ্যা করার কোনও সুযোগ নেই। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া নারীরা নেচে আনন্দে রঙ মেখে বছরের শুরুর দিন উৎযাপন করেন। অংশ নেওয়া শেহরিন জামান বলেন, হেফাজত বা ইসলামী দলগুলো যে কথা বলার চেষ্টা করছে, সেটা নারীদের দমিয়ে রাখার অপচেষ্টা। আমরা কারো প্রয়োজনে বাইরে বের হই না, নিজের জন্যই বের হই। এটা যত তাড়াতাড়ি মেনে নেবে ততই তাদের জন্য মঙ্গল। তিনি বলেন, আগে আমি মঙ্গল শোভাযাত্রায় না এসে একটু দেরি করে বের হতাম। কিন্তু এবার প্রতিবাদের অংশ হিসেবে এই শোভাযাত্রায় এসেছি।
গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে নারী সমাজের ওপর সংঘবদ্ধ যৌন-নির্যাতনের ঘটনার উল্লেখ করে হেফাজতের বিবৃতিতে বলা হয়, শুধু গত বছর নয়, এর আগেও বহুবার বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে নারী নির্যাতন ও নারীদের সম্ভ্রমহানীর মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। তাই মা-বোনদের প্রতি আহ্বান জানাব, তারা যেন বর্ষবরণের নামে ইসলাম বিরোধী বিজাতীয় এসব অনুষ্ঠানে শরিক হওয়া থেকে বিরত থাকেন। ইসলাম অনাত্মীয় নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ অনুমোদন করে না এবং নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই পর্দার বিধান জারি করেছে।
নারীনেত্রী ও মানবাধিকার কর্মী খুশী কবীর বলেন, এসব হুমকি দিয়ে কখনোই নারীদের ঘরে আটকে রাখা যায়নি। যে কোনও আন্দোলনে এখন পর্যন্ত বাংলার নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকাতে ইসলামী দলগুলোর দেওয়া এসব হুমকি ধামকিতে সচেতন মানুষ কান দেয় না, এটা ঐতিহাসিক সত্য। উন্নয়নকর্মী চিররঞ্জন সরকার মনে করেন, মৌলবাদী নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বৈশাখী উৎসবে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ যেন সমাজে নতুন বার্তা। যুক্তিহীন নিষেধাজ্ঞা কোনও কালেই কেউ মানেনি।
তিনি বলেন, এবার পহেলা বৈশাখের উৎসব উদযাপনের ক্ষেত্রেও তাইই দেখা গেল। গতবছর এই দিনটিতে নারীর ওপর বেপরোয়া হামলা হয়েছে। হামলাকারীরা চিহ্নিতও হয়নি, ধরাও পড়েনি। সেই নপুংসকেরা হয়তো ভেবেছিল, এরপর নারীরা আর ঘরের বাইরে বের হবে না। সবাই ভয়ে ঘরে বসে থাকবে। পুরুষতন্ত্র ও ধর্মব্যবসায়ীদের আকাঙ্ক্ষাও কিন্তু তাই। কিন্তু তাদের বাড়া ভাতে ছাই পড়েছে। মেয়েরা ঠিকই উৎসবে অংশ নিয়েছে।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.